নদীমাতৃক বাংলাদেশের অতি পরিচিত পাখি পানকৌড়ি। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ থেকে তোলা
পানকৌড়ি মন ডুবছে সারাক্ষণ/ঐ পদ্মচোখের নীল সায়রে/খুঁজছে গুপ্তধন...। আসলেই যেন গুপ্তধন খুঁজে বেড়ায় পানকৌড়ি। আকাশে ওড়ার সময় অন্য সব পাখির মতো দেখালেও, জলে নামতেই সে তুমুল ডুবুরি। ডুব দিয়ে অনেক গভীরে চলে যেতে পারে। শিকার ধরতে ওস্তাদ। একবার ডুব দিলে সাধারণত কিছু না কিছু তুলে আনবেই। আর ব্যর্থ হলে আবার ডুব। সফল হওয়ার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে ডুব-সাঁতার। মূলত এই প্রক্রিয়ায় খাদ্য সংগ্রহ করে পাখিটি।
লম্বা ঠোঁটের মাঝখানে ফেলে বড়সড়ো মাছ তুলে আনতে জুড়ি নেই তার। গ্রামে নদী খাল বিলে পানকৌড়ির এমন মাছ শিকারের দৃশ্য বিরল নয়। তবে রাজধানী শহরে দৃশ্যটি দেখে চমকিত হতে হয় বৈকি। হ্যাঁ, এই শহরে নদী মরে গেছে। গাছ খুব কম। তার পরও কিছু পাখি টিকে আছে। আছে পানকৌড়িও।
কয়েকদিন আগে, মানে, গত রবিবার কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ এলাকায় গিয়ে পানকৌড়ি দেখার সুযোগ হয়েছিল। ছোট ছোট দলে বিভক্ত ছিল পাখিগুলো। এভাবেই নাকি দলবেঁধে চলতে পছন্দ করে ওরা। অবশ্য যার মাছটি তাকেই শিকার করতে হয়। ফলে প্রত্যেকে তৎপর হয়েছিল। কিছু সময় পানির নিচে ডুব দিয়ে থেকে মাথা যখন তুলছিল তখন দেখা যাচ্ছিল ইয়া বড় মাছ ঠোঁটে ধরা! জলজ্যান্ত মাছ আপ্রাণ চেষ্টা করছিল মুক্ত হওয়ার। সম্ভব করে তুলতে পারছিল না। আসলে এ কারণেই পানকৌড়িকে চৌকস শিকারি বিবেচনা করা হয়।
অনুমান করা যায়, শিকারের প্রায়োজনেই নদ-নদী, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল, বিল-ঝিল ঘিরে আবাস গড়ে তুলে ওরা। সমুদ্রতীরবর্তী গাছের ডালে বা পাহাড়ে বাসা বানায় এরা। বাসাতেই ডিম দেয়। বাচ্চা ফুটায়। মজার তথ্য হলো, প্রথমে ডিম হয় নীলচে ধরনের। ক্রমে ধবধবে সাদা হয়ে যায়। তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহ ডিমে তা দেওয়ার পর বের হয়ে আসে ছানা। এ অবস্থা থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে তিন বছরের মতো সময় লাগে।
জলচর পানকৌড়ি দেখতে কালো। ফ্যালাক্রোকোরাসিডি গোত্রের পাখি ফ্যালাক্রোকোরাক্স গণের অন্তর্ভুক্ত। যদিও শ্রেণিবিন্যাসে বর্গ, গোত্র এবং গণ নিয়ে কিছু অমত দ্বিমত রয়েছে। তার পরও, বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে প্রায় ৪০ প্রজাতির পানকৌড়ি বিচরণ করছে।
কবি আল মাহমুদের বিখ্যাত একটি গল্প আছেÑ পানকৌড়ির রক্ত। সেখানে পাখিটির দীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি অংশে তিনি লিখেছেন: ‘কালো একটা বড় সাইজের পানকৌড়ি। আমার অবস্থান থেকে বাঁশটা পঁচিশ গজও হবে না। পাখিটা বসার সময় একটা সুন্দর শব্দ করছিল আর ভেজা পাখা নাড়ছিল। পাখিটার বসায়, পাখা নড়ায়, গায়ের কুচকুচে কালো রঙে একটা জীবিকাবিজয়ী প্রাণীর দর্প ফুটে বেরুচ্ছিল।
সতর্কতামিশ্রিত একধরনের দৃষ্টিপাতে, যা কেবলমাত্র বুনো পাখ-পাখালিরাই পারে,
পানকৌড়িটা আমাকে একবার দেখে নিয়ে খালের পানির দিকে তাকাল। আমি মুহূর্তে অনেক দূরে দাঁড়ানো আদিনাকে ভুলে গিয়ে পাখিটাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। দেখামাত্রই পাখিটাকে, আমার বেশ ভালো লেগেছে। বলা যায়, পাখিটার স্বতঃস্ফূর্ততা ও সৌন্দর্য আমার মন কেড়ে নিল।’
কবির মন কেড়ে নেওয়া পানকৌড়ি অপনারও পছন্দ হবে। মন কাড়বে। সময় সুযোগ করে একবার দেখে তো আসুন!