শাহজাদপুরে কবিগুরুর কাছারিবাড়ি
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সাহিত্য গগনে ও বিশ্বের জ্ঞান পরিমন্ডলে উজ্জ্বল তারকারূপে আজও চির দেদীপ্যমান, ভারস্যাটাইল জিনিয়াস্ (বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন) খ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীর এক অনুপম নিদর্শন! রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত করতোয়া নদী, কবির সেই ছোট নদীর উত্তর পশ্চিম তীরে সিরাজগঞ্জ জেলার মফস্বল শহর ‘সাজাদপুরে’ (শাহজাদপুরে) কবিগুরুর কাছারিবাড়ির অবস্থান। ছোট নদীর পূর্বের নাম ছিল খোনকারের জোলা। করতোয়া নদী বিধৌত বোনাজন আর উর্বর মাটির মফস্বল শহর শাহজাদপুর। এখানকার মাটির ঘ্রাণ কবির সাহিত্য সৃজনের প্রেরণা জুগিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের, রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বিশ্বের।
আমাদের অনেক দীনতা আছে, আছে অভাব। তবুও আমরা বলতে পারি, আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছেন! বাঙালি সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতা আর মননশীলতার অসামান্য রূপকার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি শাহজাদপুরে এসেছিলেন জমিদারি দেখাশোনার কাজে। এখানকার নদী-নালা, খাল-বিল এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এখানে তিনি সাময়িকভাবে বসবাস করেছেন। তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহে। এখানকার করতোয়া ও শাখানদী খোনকারের জোলা (ছোটনদী)র প্রতি কবির ছিল গভীর টান। করতোয়া বিধৌত শাহজাদপুরের প্রকৃতিকে ভালোবেসে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে হৃদয় উজাড় করে দিয়ে তিনি রচনা করেছেন দুর্লভ সাহিত্য। এখানে এসে কবিগুরু শুধু দুর্লভ সাহিত্যই রচনা করেননি, চিন্তাভাবনা করেছেন এলাকার অবহেলিত মানুষজনের সুখ-দুঃখ ও এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারেও।
জানা যায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুরবাসীকে গাভী পালনে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি জমিদারি তদারকি করতে শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িতে আসেন। শাহজাদপুর অঞ্চলে কবিগুরু পশুপালনের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে উপমহাদেশের হরিয়ানা ও মুলতান থেকে তিনি বেশকিছু উন্নতজাতের ষাঁড় ও গাভী শাহজাদপুরে নিয়ে আসেন। মূলতঃ সেই সময় থেকেই শাহজাদপুরের বাথানে দেশী উন্নতজাতের গরুর মধ্যে সংকরায়ন শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে, উন্নতজাতের গাভীর ওপর নির্ভর করে পরবর্তীতে শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ী এলাকায় গড়ে ওঠে মিল্কভিটার বিশাল কারখানা।
পাল্টে যেতে থাকে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা। প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ডখ্যাত এলাকা হিসাবে শাহজাদপুর দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। এটাও ছিল কবিগুরুর অসামান্য অবদান। শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত একটি ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিন তৌজির অন্তর্গত ডিহি শাহজাদপুরের জমিদারি একদা নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারির অংশ ছিল। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র তের টাকা দশ আনায় এই জমিদারি কিনে নেন। জমিদারির সঙ্গে সঙ্গে ওই কাছারিবাড়িও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আগে ওই কাছারিবাড়ির মালিক ছিল নীলকর সাহেবরা। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল সময়কাল পর্যন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার কাজে শাহজাদপুরে সাময়িকভাবে বসবাস করতেন। তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সম্ভবত এই কারণেই শিলাইদহে তার বাসগৃহ কুঠিবাড়ী নামে এবং শাহজাদপুরের বাড়িটি কাছারিবাড়ি নামে পরিচিত। শাহজাদপুরে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন পালকিতে, নৌকায় ও পায়ে হেঁটে।
শাহজাদপুর পৌর এলাকার প্রাণকেন্দ্র দ্বারিয়াপুর বাজারে অবস্থিত উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাটের দক্ষিণ পাশে এক সবুজ শ্যামল পরিবেশে কাছারিবাড়ির অবস্থান। শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন। ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার এবং উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। ভবনটির দ্বোতলার সিঁড়ি ব্যতীত মোট সাতটি কক্ষ রয়েছে। ভবনটির উত্তর দক্ষিণে একই মাপের প্রশস্ত বারান্দা, বারান্দার গোলাকৃতির জোরামাপের খাম, উপরাংশে আছে অলংকরণ করা বড় মাপের দরজা, জানালা ও ছাদের ওপরে প্যারাপেট দেওয়ালে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়ে। ভবনটির জানালা দিয়ে চারপাশের মনোরম, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ কবি উপলব্ধি করতেন। কাছারিবাড়িতে বসেই কবি প্রাণভরে ছোটনদী দেখতেন ও শুনতেন ছোটনদীর স্রোতধারার মিশ্রিত সুর।
শাহজাদপুরে এসে মানুষ ও প্রকৃতিকে কবি গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন। এখানে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সাহিত্য সৃষ্টির নানা উপাদান। এখানে অবস্থানকালে তিনি রচনা করেন- কাব্য : সোনারতরী , বৈষ্ণব কবিতা, দুটি পাখি, আকাশের চাঁদ, পুরস্কার, যমুনা, হৃদয়, ভরা ভাদরে, প্রত্যাখ্যান ও লজ্জা। চিত্রা: চিত্রা, শীত ও বসন্তে, নগর সংগীত। চৈতালী : নদীযাত্রা, মৃত্যুমাধুরী, স্মৃতি বিলয়, প্রথম চুম্বন, শেষ চুম্বন, যাত্রী, তৃণ, ঐশ্বর্য, স্বার্থ, প্রেয়সী, শান্তিময়, কালিদাসের প্রতি, কুমার, মানসলোক, কাব্যপ্রার্থনা, ইছামতী নদী, শুশ্রƒষা, অশিক্ষাগ্রহণ, বিদায়। করুণা: নববিবাহ, রজ্জিতা, বিদায়, হতভাগ্যের গান, গতোনিক, বঞ্চনা, সংকোচ, মানসপ্রতিভা, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ব্যবধান, তারাপ্রসন্নের কীর্তি, ছুটি, সম্পত্তি, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি, ইত্যাদি। ছিন্ন পত্রাবলী: ৩৮টি বিভিন্ন ছিন্ন পত্রাবলী। প্রবন্ধ : পঞ্চভূতের অংশবিশেষ। নাটক : বিসর্জন।
শাহজাদপুর কাছারিবাড়ির দোতলার উত্তর পাশে লিচুগাছ ও শোভা বর্ধনের জন্য নানা ফুলের গাছে ঘেরা কবি গুরুর অপরূপ কাচারিবাড়িটি বহুদূরের পথিকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাছারিবাড়ির চারদিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের আশপাশে রয়েছে নানা দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষের বাগান। কাছারিবাড়ির ভেতরে একটি বকুলগাছ ছিল। কবি ওই গাছের নিচে বসে কবিতা লিখতেন। ওই বকুলগাছটি মারা গেলে সেখানে আরও একটি বকুলের চারা রোপণ করা হয়েছে। সেই চারাটিও দিনদিন বড় হচ্ছে। কবিগুরুর কাছারিবাড়ি অঙ্গনে রবীন্দ্র স্মৃতি মিলনায়তনের উত্তর পার্শ্বে কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে অভিশপ্ত নীলকুঠি! শাহজাদপুর উপজেলার রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে স্থাপিত ইংরেজ নীলকর সাহেবদের অবর্ণনীয় অত্যাচার আর নির্যাতন এবং নীলচাষের নির্মম ইতিহাস বিজড়িত ‘নীলকুঠি’ সংস্কারের অভাবে ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির উত্তর-পশ্চিম অঙ্গন জুড়ে নীলকর সাহেবদের নানা স্মৃতি আজও বিদ্যমান রয়েছে সেখানে।
শাহজাদপুরের অধিকাংশ জমিদারির সিংহভাগই ছিল ইংরেজ নীলকর সাহেবদের নানা স্মৃতিবিজড়িত। অনুমান ১৬০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংরেজ নীলকর সাহেবরা নীলচাষ করতে শাহজাদপুরে এসেছিলেন। ওই সময়ে শাহজাদপুরের দারিয়াপুর ও কান্দাপাড়ার মাঝামাঝি এলাকায় বিশাল জায়গা জুড়ে নীলকর সাহেবরা তাদের বাসস্থান ও নীলচাষের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। এটি ওই সময়ে শাহজাদপুরবাসীর নিকট নীল কুঠিবাড়ী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে ওই কুঠিবাড়ীর পশ্চিম ও পূর্ব আঙ্গিনায় নীলকর সাহেবরা ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মাণ করেন দুটি লাল রংয়ের দালান। পূর্ব আঙ্গিনার নিচ ও দোতলাতে নীল কার্যালয় বা হেড অফিস হিসাবে নীলকর সাহেবরা ব্যবহার করতেন। ওইসব ভবনে স্থানীয় কৃষকদের ধরে এনে জোরপূর্বক নীলচাষে বাধ্য করতে তাদের ওপর অমানুষিক নির্মম নির্যাতন চালাতেন নীলকর বাবুরা। সেই অভিশপ্ত নীলকুঠির ধ্বংসবিশেষ আজও কালের সাক্ষী হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সংস্কারের অভাবে ইতিহাসে বর্বরোচিত ইন্দো-ইউরোপীয় শৈলীতে নির্মিত ‘নীলকুঠি’ ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে।
১৯৬৯ সালে প্রত্নত্তত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় কবিগুরুর কাছারিবাড়ি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ওই ভবনটির বিভিন্ন সংস্কার করে ভবনটিতে রবীন্দ্রভিত্তিক আলোকচিত্র ও এ বাড়িতে কবির ব্যবহৃত প্রাপ্ত আসবাপত্র নিয়ে একটি স্মৃতি জাদুঘরের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দক্ষিণ দিকের দরজা দিয়ে ওই জাদুঘরে প্রবেশ করতে হয়। নিচতলা ও দোতলার বিশাল হলরুমসহ জাদুঘরের সকল কক্ষ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। চারদিকে পাকা দেওয়ালে বেষ্টিত কাছারিবাড়ির অঙ্গনও বেশ বড়। এখানে রয়েছে রবীন্দ্র মিলনায়তন, কবির ব্যবহৃত সামগ্রীর মধ্যে চৌকি, লেখার জন্য ডেস্ক, সোফাসেট, আরাম কেদারা, আলনা, আলমারি, সিন্দুক, ঘাস কাটার যন্ত্র, ওয়াটার ফিল্টার, ল্যাম্প, কবির স্বহস্তে আঁকা ছবি, দেশী বিদেশী রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানীসহ গুণীজনদের সঙ্গে কবির অগণিত ছবি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেঘেরা আম, জাম, জামিনি, কামিনি, বকুল গাছের সুশীতল ছায়া কবিগুরুর এসব অতীত স্মৃতি আর নেই। হারিয়ে গেছে স্মৃতির পট থেকে। কবির স্মৃতিবিজড়িত বকুলগাছ মারা গেছে।
বকুলগাছের পূর্বদিকে একটি ইঁদারা ছিল যা ভরাট হয়ে গেছে। পূর্বদিকের দোতলায় ওঠার সিঁড়িটি অনেক আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ কবির সেই স্মৃতিবিজড়িত ছোট নদী অনেক আগেই মরে গেছে। ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বই ও পা-ুলিপি খোয়া গেছে।
এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি বিশাল ও অত্যাধুনিক মিলনায়তন। কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছরই সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন ২৫,২৬ ও ২৭ বৈশাখ এ তিন দিনব্যাপী নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কাছারিবাড়িতে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে কাছারিবাড়ির কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রবীন্দ্র অনুরাগীরা। তিনদিনের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে থাকে রবীন্দ্র সংগীত, নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি, কবিতালেখ্য, গীতিনৃত্য, গীতিনাট্য, নাটক, গ্রামীণ মেলা, রক্তদান কর্মসূচি, আলোচনাসভা, প্রবন্ধ পাঠসহ নানা আয়োজন। এই তিনদিনের ব্যাপক অনুষ্ঠান মালাকে ঘিরে পুরো শাহজাদপুর উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে। এ উপলক্ষে শাহজাদপুরে বসে গ্রামীণ মেলা ।
দেশে সর্বপ্রথম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে শাহজাদপুরের বিসিক বাসস্ট্যান্ডে। দেশের খ্যাতিমান ভাস্কর্য নির্মাতা মৃণাল হক ওই ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে, শাহজাদপুরসহ সিরাজগঞ্জবাসীর প্রাণের দাবিতে শাহজাদপুরে কবিগুরুর স্মৃতি চির অম্লান রাখতে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ’ নামের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।