রাতে গাছ ভর্তি শিউলি ফুল। তবে ভোর হতে না হতেই ঝরে যায়
শিউলি ফুল নিশ্চয়ই দেখেছেন? কিন্তু রাতে দেখেছেন কি? প্রিয় ফুল রাতে ফোটে। সকাল হতে না হতেই ঝরে যায়। তাই টাটকা দেখতে চাইলে রাতের যে কোনো সময় গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। গাছটি আবার দুর্লভ। যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না। এর পরও রাজধানী ঢাকাতেই প্রথমবার গাছভর্তি শিউলি দেখার বিরল সুযোগ হয়েছিল আমার। সংস্কৃতি অঙ্গনের চেনামুখ সংগঠক মানজার চৌধুরী সুইটের মনিপুরীপাড়ার বাসার সামনে একটি গাছ আছে। নরম ডালপালা ছড়িয়ে থাকা গাছে সারা বছর পাতা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না।
তবে শরৎকালে ফুলে ফুলে গাছ একেবারে ছেয়ে যায়। তেমনই এক শরতের দুপুরে সেখানে গিয়ে শিউলি দেখেছিলাম, মনে আছে। নিচে তখন শিউলি ফুলের বিছানা। ঝরেপড়া ফুলের কিছু আবার পাতার ওপর আটকে ছিল। ক্ষণে ক্ষণে গড়িয়ে পড়ছিল সেখান থেকে, নিঃশব্দে ঝরেপড়া যাকে বলে। হাতেগোনা কিছু ফুল গাছে ফুটে থাকতে দেখেছি। ওইটুকুন দেখেই কী যে খুশি হয়ে গিয়েছিলাম! কিন্তু তখনো জানতাম না, রাতে গাছটি আরও কত মোহনীয় হয়ে উঠতে পারে। মোবাইল ফোন থেকে টর্চের আলো ফেলতেই চোখ একদম কপালে উঠলো।
এত ফুল! থোকা থোকা ফুলে গাছভর্তি। রাতের আকাশে জ্বলতে থাকা তারার মতো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ঘন সবুজ পাতার মাঝে টুকরো টুকরো আলো ছড়িয়ে আছে। এই মাত্র ফোটা অসংখ্য ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আশপাশের সব ভবনে ছড়িয়ে পড়েছিল। নাকে এসে লাগতেই দারুণ স্নিগ্ধ একটা অনুভূতি হচ্ছিল ভেতরে। একে স্বর্গীয় অনুভূতিই বলতে হবে। পরবর্তী বছরগুলাতে ফুল ফোটার খবর পেলেই সেখানে ছুটে গেছি। এবার যাওয়া সম্ভব না হলেও ফুল ফুটেছে, অনুমান করতে পারি। কারণ এখন শিউলি ফোটার ভরা মৌসুম।
এরই মাঝে ঢাকার রাস্তায় শিউলি ফুলের মালা বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। দুর্গোৎসবের প্রস্তুতিও চলছে এখন। শিউলির ফুলে তাই পূজার ঘ্রাণ। মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, মাটিতে ঝরেপড়া শিউলি দিয়ে দেবীর পূজা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনা বাধা নেই। তাই পূজায় শিউলি ব্যবহৃত হয় সব সময়।
হিন্দুদের পুরাণেও দারুণ সব গল্প আছে শিউলি নিয়ে। পুরাণে ফুলটিকে ‘পারিজাত’ নামে পাওয়া যায়। পারিজাতকে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে স্বর্গের শোভা হিসেবে। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, কৃষ্ণের দুই স্ত্রী সত্যভামা ও রক্তকামিনী। উভয়েরই ইচ্ছে তাদের বাগান পারিজাতের ঘ্রাণে ভরে উঠবে। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা। মর্তে কেন আসবে? কৃষ্ণ তবুও ফুলটি সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। স্ত্রীদের খুশি করতে লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙে নিয়ে আসেন তিনি।
পরে সত্যভামার বাগানে এটি রোপণ করা হয়। সেখান থেকে ফুলটি সুগন্ধ ছড়ায়। রক্তকামিনীর বাগানেও এই ফুল ফোটে। এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র পারিজাতের ডাল ভেঙে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে ভীষণ রেগে যান। কৃষ্ণকে শাপ দেন, বলেন, কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই। কোনদিন ফল ধরবে না, তার বীজে কখনো নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না। ঘটনা তা-ই ঘটেছিল কিনা, সেটি অন্য আলোচনা। তবে পারিজাতের মতো সুগন্ধী একটি ফুল ঠিকই পাওয়া হয়েছিল পৃথিবীর!
আরেকটিতে আমরা মূল চরিত্র হিসেবে পাই এক রূপবতী রাজকন্যাকে।
রাজকন্যাকে অনেক রাজপুত্র নিজের করে পেতে চান। কিন্তু রাজকন্যার পছন্দ সূর্যকে। তেজদ্বীপ্ত সূর্যের জন্য সে কী আকুলি বিকুলি তার। আর কাউকে নয়, তার সূর্যকেই চাই। কিন্তু হায়! সূর্য এই ভালোবাসার মূল্য বুঝে না। একদমই সাড়া দেয় না রাজকন্যার আহ্বানে। অধরা হয়ে দূর আকাশেই থেকে যায়। এমন নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের ঘটনায় প্রেমিকার বুক ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ব্যথা সইতে না পেরে তিনি বেছে নেন আত্মহননের পথ। শাস্ত্র মেনে তার শরীর দাহ করা হয়।
দাহ করা হয় বটে। রাজকন্যার দেহভস্ম থেকে জন্ম নেয় একটি গাছ। গাছে চমৎকার ফুল ফোটে। রাতে ফোটা শুভ্র সুন্দর ফুল সকালে তেমন দেখা যায় না। সূর্যের স্পর্শ পাওয়া মাত্রই অশ্রুবিন্দুর মতো ঝরে পড়ে। দুঃখিনী রাজকন্যার নামে এই ফুলের নামকরণ করা হয় ‘পারিজাতিকা।’ পৌরাণিক এই কাহিনী অনুযায়ী, পারিজাতিকা বেদনার প্রতীক। ব্যর্থ প্রেমের আলেখ্য।
এবার মর্ত্যে ফিরি। কবিগুরুর লিখেছিলেন, ‘পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি...।’ পাচ্ছেন তো এখন? নজরুলও শিউলি ফুলে শরৎ খুঁজে পেয়েছিলেন। পছন্দের ঋতুকে স্বাগত জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে।’ কবি আবিদ আজাদ দেখেছিলেন অবশ্য মরা শিউলি গাছ। বিচ্ছেদের কষ্ট থেকে প্রেমিকার উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন : ‘যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে জনহীন কোন/পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে/একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি।’ কবি আজ নেই। কী হলো তার প্রেমিকার? জানা যাবে না কোনোদিন। তবে এ কবিতা শিউলির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ফুলটি শেফালি, শেফালিকা, নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন, হারসিঙ্গার, কোরাল জেসমিন, রাগাপুষ্পি, খারাপাত্রাকা এবং প্রবক্তা নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম নিক্টান্থেস আরবর-ট্রিসটিস। লাতিন শব্দ নিক্টান্থেস অর্থ সন্ধ্যায় ফোটা। আরবর-ট্রিসটিস হচ্ছে বিষণœ গাছ। রাতে ফোটে সকালে ঝরে যায় বলে একে ‘ট্রি অব সরো’ বলেও ডাকা হয়। নজরুল তাই হয়তো লিখেছেন : ‘দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়।’
উদ্ভিদবিদদের বর্ণনা মতে, এটি গুল্ম জাতীয় গাছ। ফুলের ছয়টি শুভ্র সাদা পাপড়ি। বৃন্তটি কমলা রঙের টিউবের মতো দেখতে। গাছ সাদামাটা। নরম। লম্বায় ১০ মিটারের মতো হয়। পাতা ৬-৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী সাজানো থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকাজুড়ে শিউলি ফুটে। শুধু তাই নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গ ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের প্রধান ফুল।
বাংলাদেশেও শিউলির তুলনা কেবলই শিউলি। সবুজ ঘাসের ওপর সারারাত ধরে জমা হওয়া শিউলি খুব ভোরে সযতেœ কুড়িয়ে নেন ফুলপ্রেমীরা। গ্রামীণ বালিকারা, তরুণীরা ঘুম থেকে উঠে শিউলি কুড়োতে বের হয়ে যায়। আঁচল ভর্তি করে শিউলি নিয়ে ঘরে ফেরে তারা।
শুভ্র সুন্দর ফুল কুড়িয়ে দেখতে পারেন আপনিও। মুঠোভর্তি শিউলি ফুল জীবনের অনেক অপ্রাপ্তির কথা মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে।