কলাপাড়ায় খাপড়াভাঙ্গা গ্রামে রাখাইনদের প্রাচীন এই বৌদ্ধমঠসহ মন্দিরটির এখন ভগ্নদশা
সাগরপারের জনপদ পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় খাপড়াভাঙ্গা গ্রামে দেড়শ’ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরটি মঠসহ সংরক্ষণের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়ার এক যুগ পরও কিছুই করা হয়নি। উল্টো ২০১২ সালে দেওয়া সাইনবোর্ডটিও উধাও হয়ে গেছে। রাখাইন পাড়ার জীর্ণদশার এই মন্দিরটির এখন চরম ভগ্নদশা। মঠের ওপরের অংশ অনেকটা ভেঙে গেছে। মন্দিরটির স্থাপনাশৈলীতে রয়েছে প্রাচীন আদল। রাখাইনরা এই বৌদ্ধ মঠসহ মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের প্রতি দাবি করে আসছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় অফিসের একটি টিম ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওই এলাকা পরিদর্শন করে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তাবনা আকারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছেন বলে তখন জানিয়েছিলেন।
ওই টিমের প্রধান খুলনা অফিসের তৎকালীন সহকারী গবেষক গোলাম ফেরদৌস বিষয়টি তখন নিশ্চিত করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাগরপারের এই জনপদের রাখাইন জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্য ধরে রাখার লক্ষ্যেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর বৌদ্ধ মন্দিরটির স্বকীয়তা বজায় রেখে সংস্কার করলে এখানে দেশী-বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটবে। গৌতম বুদ্ধের দেহধাতু যেমন, চুল ও নখের উপাদানের ওপরে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বলে তিনি প্রবীণ রাখাইনদের কাছ থেকে জেনে নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশে এই আদলের আরেকটি মন্দির রয়েছে রামুতে। রাখাইন জমিদার ম্রাথা চৌধুরী ইংরেজদের কাছ থেকে জমি পত্তন নিয়ে খাপড়াভাঙ্গায় বৌদ্ধমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেও জানান গোলাম ফেরদৌস। পক্ষিয়াপাড়ার বাসিন্দা রাখাইন প্রয়াত প্রকৌশলী ট্যানথান জানিয়েছিলেন, এই বৌদ্ধ মান্দরটি বৌদ্ধদের আদী থেরোবাদ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। ভিন্নতর কিছু বৈশিষ্টও রয়েছে মন্দিরটিতে। যা ভারতের বিহারের বৌদ্ধগয়ায় সম্রাট অশোকের আমলে প্রতিষ্ঠিত কিছু মন্দিরের সঙ্গে সদৃশ্য রয়েছে বলে এ প্রকৌশলী দাবি করেন। কলাপাড়া উপজেলার পর্যটন পল্লী গঙ্গামতি যাওয়ার পথে চরচাপলী বাজারের ঠিক উল্টোদিকে শিববাড়িয়া নদীর উত্তর পাড়ে বৌদ্ধমন্দিরটির অবস্থান। খাপড়াভাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত।
রাখাইনদের ভাষ্যমতে, এই জনপদের বনজঙ্গল সাফ করে বসতি গড়ে তোলার পরে বিহারসহ মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। ছিল আশপাশে রাখাইনদের বাড়িঘর, পাড়া। এমনকি মন্দিরের ২০-২৫ হাত দূরে রাখাইন জমিদার মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা ম্রাথা চৌধুরীকে এখানে সৎকার করা হয়। সেই শ্মশানটিও বেদখল হয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে রাখাইনদের ওই স্পটে কোনো বাড়িঘর এখন নেই। রয়ে গেছে বৌদ্ধমঠসহ মন্দিরটি। বর্তমানে এই বৌদ্ধ মন্দিরটির অবস্থান ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নে। এখনো প্রায় ৬০ ফুট উচ্চতা রয়েছে মঠটির।
জীর্ণদশার মন্দিরটিতে ছিল গৌতমবুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি। ভেতরে কাঠের ও পাথরের অসংখ্য মূর্তি ছিল। এ সবের একটিও নেই। নেই কোনো দরজা। মন্দিরটি ইটগুলো জীর্ণদশার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে। পলেস্তরাসহ ইটের গাঁথুনি খসে পড়ছে। চারদিকে পুরনো ইট-সুরকি ধূলির মতো উড়ে যাচ্ছে। ভেঙে বেরিয়ে গেছে লাল ইটের গাঁথুনি। কোন প্রাণীর কঙ্কালের মতো দেখায়। এখন ধসে পড়া সময়ের ব্যাপার। মঠের চারদিকে মাস্তুল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছে সয়লাব হয়ে ঢেকে গেছে। কাছাকাছি গেলে গা ছমছম করে। একধরনের ভৌতিক অবস্থার শিহরণ জাগায় মনে। মঠের ওপরে সাপের বসবাস দেখতে পায় বলে স্থানীয়রা জানান। কয়েক বছর আগে লোকজন ধাওয়া করে একটি সাপ মেরে ফেলেছেন বলে জানান কেউ কেউ। আশপাশের জায়গা সব দখল হয়ে গেলেও মন্দিরটি সাপের বসবাসের কারণে ভয়ে কেউ ভাঙ্গেনি বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
প্রাচীন এই মঠসহ মন্দিরটি দেখতে এখনো কিছু পর্যটক আসেন এখানে। ২০১২ সালে বাঁশের কয়েকটি চেরা চারদিকে দেওয়া ছিল। একটি সাইনবোর্ড লটকানো ছিল। যেখানে লেখা ছিল খাপড়াভাঙ্গায় অবস্থিত মন্দিরটি সংস্কার ও দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন বজন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো। তিনি চট্টগ্রাম জেলার ডাবলমুড়িং উপজেলার মোগলতুলি গ্রামের শাখ্যমান বৌদ্ধ বিহার অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োজিত রয়েছেন। এখন বাঁশের বেড়া কিংবা ওই সাইনবোর্ডটি নেই। আর মন্দিরটি মঠসহ যে কোনো সময় বিধ্বস্তের শঙ্কা করছেন রাখাইন জনগোষ্ঠী। প্রাচীন এই পুরাকীর্তি রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সচেতন মানুষ।