ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

গীনসবার্গের সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড

একাত্তরের অসীম বেদনা যেভাবে কবিতা হয়ে উঠেছিল

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

একাত্তরের অসীম বেদনা যেভাবে কবিতা হয়ে উঠেছিল

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার বাঙালি যশোর রোড দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়। গীনসবার্গ (ইনসেটে)

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কম কবিতা লেখা হয়নি বাংলায়। তবে বিদেশী এক কবির কবিতা, বলা চলে, অন্য রকম ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। এই কবি ছিলেন আমেরিকান। তার দেশের সরকার যখন বাংলাদেশের গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল, যখন অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।  একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে যশোর রোডের আশপাশ এলাকা ঘুরে শরণার্থীদের কষ্টের জীবন নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি।

তার পর দেশে ফিরে গিয়ে লিখেছিলেন অমর কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড।’ একাত্তরের অসীম বেদনাকে প্রতি পঙ্ক্তিতে ধারণ করেছিল এই কবিতা। বঞ্চিত-নিপীড়িত বাঙালির কষ্টের কথা তিনি কবিতার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন। বিশ্ব জনমত তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছিল তার কবিতা।   
কবিতা প্রকাশের কাল ১৪ থেকে ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১। ইংরেজিতেই লেখা হয়েছিল। পরে বাংলা অনুবাদ হয়েছে। কবিতা থেকে হয়েছে গানও। রং তুলিতে আঁকা অনবদ্য ছবি, শৈল্পিক  পোস্টার হয়েছে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার আশ্রয়ে। আরও কত কি!
কেন? কীভাবে এমন পর্যায়ে পৌঁছল একটি কবিতা? আজ সেপ্টেম্বর মাসের বিদায়বেলায় হলেও আসুন, একবার জেনে ইতিহাসটি স্মরণ করি। করা যাক। ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান কবিদের অন্যতম একজন ছিলেন গীনসবার্গ। নানা ধরনের পাগলামো ছিল তার। আলেচিত ছিলেন প্রথাবিরোধী হিসেবেও।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবিদের সঙ্গে  যোগাযোগ ছিল। সে সূত্রে ১৯৬২ সালে প্রথম কলকাতা সফর করেন তিনি। ৬৪-তেও এসেছিলেন। এরপর আসেন ১৯৭১ সালে। এবার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশ। দেশটির বাঁচার লড়াই প্রত্যক্ষ করা। পাশে দাঁড়ানো। এ কাজে তাঁকে সাহায্য করেন কবিবন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তার বাসায়ই ওঠেন গীনসবার্গ। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সংযোগকারী সড়ক যশোর রোডের ভারত অংশে তখন শতশত শরণার্থী শিবির।

স্বজনহারাদের মতো এসব শিবির ঘুরে  বেড়ানো শুরু করেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় আসে  সেপ্টেম্বর। এ সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করে এ অংশের অবস্থাটি সম্পর্কে জানার উদ্যোগ নেন কবি। কিন্তু যে রাস্তা দিয়ে এগোবেন  সে যশোর রোড তখন পানির নিচে। সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে আসা কবির কাছে এতে কোনো বাধা মনে হয়নি। তাই নৌকোয় করে বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমানন্তে পৌঁছেন তিনি।

এ সময় তার সঙ্গে সুনীল ছাড়াও ছিলেন আরেক আমেরিকান কবি জন গীওরনো। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা নিজ চোখে  দেখেন। ছবি তুলতে ভালবাসতেন গীনসবার্গ। তাই একটি ক্যামেরাও সঙ্গে নিয়েছিলেন। শরণার্থী শিবিরের অসংখ্য ছবি তুলেছিলেন তিনি। এর কিছুদিন পর ফিরে যান নিউইয়র্কে। তবে ফিরে গিয়েই মূলত জানান দেন, আছেন তিনি। নিজ অ্যাপার্টমেন্টে বসে কবি এ সময় রচনা করেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড।’ 
কবি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শরণার্থী শিবির ঘুরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল আমার। অক্টোবরে নিউইয়র্কে ফিরে গেলাম। প্রতিদিনই ভাবতে থাকি বাংলাদেশের জন্য আমি কী করতে পারি। হঠাৎ মাথায় এলো, আমি কবিতা লিখতে তো পারি। লিখেও প্রতিবাদ করা যায়। কদিন ঘরে থেকে লিখলাম দীর্ঘ কবিতা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। 

বিভিন্ন তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ চার্চে বাংলাদেশের সমর্থনে আয়োজিত আসরে সদ্য লেখা কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান কবি। মার্কিন সরকারের প্রচারণার বাইরে গিয়ে তার কবিতা সমবেত সুধীকে জানায় ‘মিলিয়নস অব সোলস নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান/হোমলেস অন যশোর রোড আন্ডার গ্রে সান/আ মিলিয়ন আর ডেড, দ্য মিলিয়নস হু ক্যান/ওয়াক টুওয়ার্ড ক্যালকাটা ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান’। 
কবিকণ্ঠ শুনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের সমর্থনের কথা জানান সমাবেশে আগত বিভিন্ন দেশের নাগরিক। পরে কবিতাটিকে সুরে বাধেন গীনসবার্গ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের আরেক অকৃত্রিম বন্ধু সুহৃদ পৃথিবী বিখ্যাত গায়ক বব ডিলানসহ আরও কয়েকজনের সহায়তায় তিনি নিজই কনসার্টে গেয়ে শোনান গানটি। এভাবে শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন গীনসবার্গ। প্রায় একই সময় কলকাতাসহ সারা ভারতবর্ষে বিশালাকৃতির পোস্টার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গীনসবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। পোস্টার বিক্রির অর্থও শরণার্থী শিবিরের ফান্ডে জমা হতে থাকে।
বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে গেঁথে যাওয়া কবিতাটি বাংলায় অনুবাদ করেন খান মোহাম্মদ ফারাবী, শুভঙ্কর দাশসহ অনেকে। তবে বর্তমানের শ্রোতারা খুব পরিচিত কলকাতার মৌসুমী  ভৌমিকের গাওয়া ‘যশোর রোড’ গানটির সঙ্গে। গীনসবার্গের কবিতা থেকে  তৈরি এ গান বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে দুই বাংলায়। গীনসবার্গের বাংলা ভাবানুবাদ আরও বেশি মর্মস্পর্শী।

গানের শুরুটা এ রকম : ‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে/শত শত মানুষের দল/যশোর রোডের দু’ধারে বসত/বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল/কাদামাটি মাখা মানুষের দল/গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে/আকাশে বসত মরা ঈশ্বর/নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে। পরের অংশে দুর্দশার একই চিত্র তুলে ধরে এর শেষ কোথায় জানতে চাওয়া হয়। গানের ভাষায় ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে/যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশ/মাথার ভিতরে বোমারু বিমান/ এই কালো রাত কবে হবে শেষ।’ 
আলাদা করে তুলে ধরা হয় অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটানো শিশুদের কথা। তাদের যন্ত্রণার বর্ণনাটি এ রকম : ‘রিফুইজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু/পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে/ এইটুকু শিশু এতবড় চোখ/ দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে।’
আসলেই খোদ আমেরিকাই যখন এ বর্বরতার পক্ষে তখন সত্যিই নালিশ করার জায়গা পাওয়াও কঠিন ছিল বাঙালির জন্য। এ প্রসঙ্গে গীনসবার্গের বক্তব্যকে অনুবাদ করে গানের আরেক অংশে বলা হয়, ‘কার কাছে বলি ভাত রুটি কথা/কাকে বলি কর কর ত্রাণ/ কাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাও/ মরে যাওয়া বুকে এনে দাও পাণ।’
এ পর্যায়ে বলা জরুরি, মৌসুমী ভৌমিক প্রচ- দরদ দিয়ে গানটি করেছিলেন। শুনলে তাই গা শিউরে ওঠে। কণ্ঠ বুজে আসে কান্নায়। তবে অনেকেই জানেন না, প্রিয় বন্ধু মৌসুমী ভৌমিককে দিয়ে গানটি করিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সদ্য প্রয়াত তারেক মাসুদ। ‘মুক্তির কথা’ চলচ্চিত্রে এ গান ব্যবহার করেন তিনি। তারেক মাসুদের এক লেখা থেকে জানা যায়, তিনি ও সহধর্মিণী ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে গিয়ে দেখাও করেছিলেন গীনসবার্গের সঙ্গে। এ যুগল গীনসবার্গের নিজের কণ্ঠে গাওয়া ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’র একটি সিডি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন।
তবে এ্যালেন গীনসবার্গের শক্ত ভক্ত বলতে যা বোঝায় তা আসলে নির্মলেন্দু গুণ। নিজ দেশে তার অগণিত ভক্ত। আর তিনি অনুরক্ত গীনসবার্গের।  পেঙ্গুইন  থেকে প্রকাশিত আমেরিকান কবির বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। বাংলাদেশের জন্য এত মায়া বুকে জমা রাখা মানুষটিকে নিউইয়র্কে গিয়ে খুঁজে বের করেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। লম্বা সময় আন্তরিক পরিবেশে মিশেছিলেন গীনসবার্গের সঙ্গে।

সেই দেখা করার স্মৃতি নিয়ে কবি  লেখেন ‘গীনসবার্গের সঙ্গে’ বইটি। প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। তবে এখানেই শেষ নয়, বাংলার ভক্ত কবি পরে দক্ষ শিল্পীর মতো গীনসবার্গ ও তাঁর ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নিয়ে ছবি আঁকেন। এ্যাক্রিলিকে আঁকা ক্যানভাসটি কালো। এর ওপর হলুদ, খয়েরি, সবুজ, লালের সন্নিবেশ ঘটিয়ে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর প্রিয় গীনসবার্গকে।
প্রিয় কবির প্রতি ভালোবাসার কথা জানিয়ে নির্মলেন্দু গুণ জনকণ্ঠকে বলেন, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো, বিচিত্র জীবন-অভিজ্ঞতার কবি এ্যালেন গীনসবার্গ। অকপটে জীবনের সত্য তিনি প্রকাশ করতে জানতেন। একই কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি। প্রিয় এ মানুষটির সঙ্গে দেখা করার অনুভূতির কথা জানিয়ে গুণ বলেন, এ্যালেন আমার চেয়ে প্রায় ২০ বছরের বড়। কবিখ্যাতি বিশ্বজোড়া।

তাঁর সম্পর্কে নানা উন্নাসিকতার কথাও আগে শুনেছি। সব মিলিয়ে তাই ভয় ছিল আমার মতো সাধারণ একজনের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন কিনা। কিন্তু দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভয় কেটে যায়। তিনি প্রাণখোলা হাসি এবং করমর্দনের উষ্ণতার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বহু বছর আগে যে দেশের ভাগ্যাহত মানুষকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন, সে দেশের কবি সম্পর্কে সত্যিকারের কৌতূহল তাঁর আছে।

তবে আমেরিকায় অবস্থানের কারণে ক্যামেরার কবি নাসির আলী মামুন এরও অনেক আগে থেকে গীনসবার্গকে জানতেন। দুজনের মধ্যে চমৎকার একটি সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। ৩০ বারের বেশি সময় প্রিয় কবির সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গী হয়েও গীনসবার্গের বাসায় গিয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই স্বনামধন্য এ আলোকচিত্রী গীনসবার্গকে নিজের মনের মতো করে ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন।

জনকণ্ঠকে তিনি জানান, বহু দূরে থাকলেও বাংলাদেশকে মোটেও ভুলে থাকেননি গীনসবার্গ। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন, আমি ১৯৯২ সালের শেষদিকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটান ভিল কলেজে গীনসবার্গের অতিথি হয়ে তাঁর সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে পনেরোশ’ শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে গীনসবার্গ হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। ফাঁকে ফাঁকে মন্দিরাও বাজান তিনি। এ ছাড়াও লালন ফকিরকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন তিনি।

তবে লজ্জার কথা হচ্ছে, অকৃত্রিম এ বন্ধুকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কোনোদিন স্মরণ করেনি। বাংলাদেশের কনসাল জেনারেলের অফিস বা জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধির অফিসের কাছেই ম্যানহাটানে গীনসবার্গ বসবাস করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, এর পরও জাতীয় কোনো দিবসে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সন্দেহ নেই, এটি বাঙালির অকৃতজ্ঞতার চরম নিদর্শন।

অবশ্য গীনসবার্গের মতো মানুষের এ নিয়ে ভাববার সময় ছিল না। আর তাই নির্মলেন্দু গুণের ‘গীনসবার্গের সঙ্গে’ বইটি হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মে বি হি ইজ গিভিং মি টু-মাচ ইমপরটেন্স’। এমন কথায় বড় মানুষটি যেন আরও ঊর্র্ধ্বে তুলে ধরেন নিজেকে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এখন চাইলেও আর গীনসবার্গকে বলা যাবে না-বন্ধু, তোমার প্রতি আমরা ভীষণ কৃতজ্ঞ। কারণ সেপ্টেম্বর আসবে যাবে। তবে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ এর কবি আর ফিরে আসবেন না।  ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৭ সালে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি ! তোমাকে তবু লাল সালাম হে মানবতার কবি।

×