ব্যাংক নোট, মুদ্রা, জমির দলিল, ডাকটিকিটসহ দুর্লভ সব সংগ্রহ নিয়ে শুক্রবার মিরপুরের ঋদ্ধি গ্যালারিতে বসেছিল অভিনব ‘শখের বাজার’
বাজার বটে। যে সে বাজার নয়। শখের বাজার। আগে কখনো শুনেছেন এই বাজারের কথা? না শুনে থাকলে বলি, রাজধানী ঢাকায় ২০১৯ সাল থেকে বাজারটি চালু আছে। কী বেচাকেনা হয় বাজারে? না, আপনার প্রতিদিনের ফর্দের সঙ্গে মিলবে না তালিকা। শখের বাজারে শখেরবশে সংগ্রহ করা অমূল্য স্মারক ক্রয়-বিক্রয় করা হয় শুধু। কেউ হয়তো শৈশব থেকেই দেশী-বিদেশী ডাকটিকিট, চিঠি লেখার খাম, মুদ্রা বা ব্যাংকনোট সংগ্রহ করছেন। কিংবা বহু বছরের পুরনো নথি দলিল দস্তাবেজ পত্রিকা ম্যাগাজিন সিনেমার পোস্টার ইত্যাদি আছে কারও সংগ্রহে। তারা চাইলে নিজের সংগ্রহ থেকে কিছু বিক্রি করে দিতে পারেন। পাশাপাশি নিজের পছন্দমতো অন্য কোনো দুর্লভ সামগ্রী কিনতে আগ্রহী হতে পারেন। একসঙ্গে দুটো চাওয়াই পূরণ করার প্ল্যাটফর্ম শখের বাজার। অভিনব বাজার সংগ্রাহকদের পরস্পরের মধ্যে চমৎকার বিনিময়ের সুযোগ করে দেয়। সংগ্রাহকদের মিলনমেলাও বলা চলে এটিকে। আর সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য থাকে প্রদর্শনী উপভোগের সুযোগ। বিপুল কৌতূহল নিয়ে বাজার ঘুরে বেড়ান তারা। যা পছন্দ, কিনতেও পারেন। ‘শখের বাজার’ নামে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করছে ফিলাটেলিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন। সাধারণত শিল্পকলা একাডেমি অথবা শিশু একাডেমিতে এই বাজার বসে। এবার স্থানান্তর করা হয় মিরপুরে।
ছুটির দিন শুক্রবার মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে মিলিত হন সংগ্রাহকরা। এখানে সম্প্রতি ঋদ্ধি নামে দারুণ একটি বুকশপ ক্যাফে এবং গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নতুন এ গ্যালারিতেই সকালে বাজারের সূচনা করা হয়। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
আয়োজনটি মূল শহরের একটু বাইরে হলেও দুপুর নাগাদ সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ব্যাপক জমজমাট অবস্থা! গায়ে গা লাগা ভিড়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে ক্রেতা বিক্রেতারা তো এসেছেনই। সাধারণ দর্শনার্থীর সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো। ভারি কৌতূহল নিয়ে প্রদর্শনী দেখছিলেন তারা। বাজারে স্টল রাখা হয়েছিল ২৯টি। সবকটিতে দুর্লভ সংগ্রহ। ঘুরে, সত্যি বলতে, বাজার মনে হয়নি। জাদুঘর বা প্রদর্শনী কক্ষ বলে মনে হচ্ছিল।
আয়োজনের বড় অংশজুড়ে ছিল ফিলাটেলিক সংগ্রহ। চিঠি লেখার যুগ শেষ হলেও খাম ডাকটিকিট ইত্যাদি দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। দেশের দুর্লভপ্রায় সব ডাকটিকিট খাম ফার্স্ট ডে কাভার প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছিল। বাইরের দেশের ডাকটিকিটও প্রচুর পরিমাণে ছিল। এমনকি যেসব দেশের অস্তিত্ব বর্তমানে বিলীন হয়ে গেছে তেমন কিছু ডেড কান্ট্রির ডাকটিকিটও দেখা গেছে প্রদর্শনীতে।
সানাউল হক নামের এক প্রবীণ সংগ্রাহকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বিশেষত মহাকাশ বিষয়ক ডাকটিকিট সংগ্রহ করে থাকেন। কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এ ধরনের ডাকটিকিট বেশি প্রকাশ করে। উপলক্ষ থাকলে অন্যরাও বের করে। আমি এ ধরনের টিকিটের খোঁজখবর রাখি এবং যেভাবেই হোক সংগ্রহ করতে পছন্দ করি। তিনি বলেন, আমার ডাকটিকিট সংগ্রহ শুরু ছোটবেলায়। এখন বয়স ৭০। সংগ্রহ তবু অব্যাহত আছে। শখের বাজারে এসে কেনা বেচা দুটোই করেছেন বলে জানান তিনি।
মুদ্রার সংগ্রহটিও বেশ বড় ছিল। কত রকমের মুদ্রা! সুলতানী আমল, মুঘল আমলের মুদ্রা প্রদর্শিত হয়েছে একটি স্টলে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান কয়েন, ভারতীয় মুদ্রা, পাকিস্তানি মুদ্রা এবং বাংলাদেশে এ যাবৎকাল ছাপানো সব কাগজী নোট এবং মুদ্রা প্রদর্শিত হয়েছে। নিজের স্টলে বসে নুরুজ্জামান লাবু বলছিলেন, কয়েন সংগ্রহ আমার নেশা। যেসব কয়েন একাধিক আছে সেগুলো এখানে বিক্রি করে দিচ্ছি। যাদের সংগ্রহে এগুলো নেই তারা খুব আগ্রহ নিয়ে কিনছেন। এভাবে উভয়ের সংগ্রহ সমৃদ্ধ হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সাকিল হক নামের এক যুবক আবার সংগ্রহ করেন দেয়াশলাই। পৃথিবীর নানা দেশের দিয়াশলাই তার স্টলে প্রদর্শিত হচ্ছিল। বিক্রেতা বলছিলেন, বাংলাদেশে দিয়াশলাইয়ের মাত্র দুটি ফ্যাক্টরি আছে এখন। তিনি নিজেও দিয়াশলাইয়ের বাক্স ডিজাইন করেন। ৫শ’র মতো ডিজাইন করেছেন। তার নিজের ডিজাইন করা একটি দিয়াশলাই হাতে নিয়ে দেখা গেল, দুই পিঠে মুক্তিযুদ্ধের পোস্টার। অন্য একটিতে বরেন্য ব্যক্তি। যেমন বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী ভ্যানগগের প্রতিকৃতি! শুধু কী তাই? ২০ হাজার দিয়াশলাই নিয়ে একটি জাদুঘর করেছেন তিনি। বাজারে তার দেয়াশলাই ভালো বিক্রি হচ্ছে বলেও জানান তরুণ সংগ্রাহক।
জেনে আরও অবাক হবেন, আকবর নামের এক সংগ্রাহক টিব্যাগ সংগ্রহ করেন! বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা বা লোগোযুক্ত টিস্যু সংগ্রহ করেন মাসুদ আহমেদ। একই ব্যক্তি লটারির টিকিট এবং কোমলপানীয়র বোতল থেকে ছিপি সংগ্রহ করেন। এসবের পাশাপাশি বাজারে বিক্রির জন্য উঠেছিল চাবির রিং, বিদেশী মডেল কার, গহনা, হারিয়ে যাওয়া টেলিফোন কার্ড। সাদী নামের এক সংগ্রাহক স্টলে বিক্রির জন্য রেখেছিলেন আফ্রিকান মহিষের সিং! এন্টিক টেলিফোন দেয়াল ঘড়ি রেডিও টেবিল ল্যাম্প ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছিল শখের বাজারে। সব মিলিয়ে ভালো বেশ কেটেছে একটা দিন।
আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক আকবর হোসেন বলছিলেন, এক সময় নিলামে ক্রয়-বিক্রয় করতেন তারা। কিন্তু কখন কোন স্মারকটি নিলামে উঠবে সেজন্য লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হতো। আরও কিছু জটিলতা দেখা দিত নিলামের সময়। ওইসব ঝামেলা এড়াতেই ‘শখের বাজার’ চালু করেন তারা। এবার ছিল নবম আয়োজন।
কিন্তু বাজারটি সম্পর্কে মানুষ কতটা জানে? জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম ফারুক বলেন, আমাদের বিশাল একটা কমিউনিটি আছে। একটা পরিবার বলতে পারেন। দুর্লভ সংগ্রহের পেছনে ছুটে বেড়ানো যাদের নেশা তারা এই খবর এমনিতেই পেয়ে যান। এর বাইরে ফেসবুকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে আমাদের। ফলে যেখানেই আয়োজনটি নিয়ে যাই না কেন, খুব জমে ওঠে। আগামীতে বাজারটি আগের মতো শিল্পকলা একাডেমি বা শিশু একাডেমিতে আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি।