ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

জাদু

​​​​​​​আবেদীন জনী

প্রকাশিত: ২২:১৮, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জাদু

.

গবেষক গহর আলি। নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক লাইব্রেরি। তাকে তাকে সাজানো ছিল নানা রকমের বই। তিনি বই পড়তেন আর গবেষণা করতেন। গবেষণা থেকে যে আয় হতো, তাই দিয়ে সংসার চালাতেন। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তার কাছে ছুটে আসত অনেক মানুষ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের উপায় বলে দিতেন। তাতে কাজ হতো জাদুর মতো।

গহর আলির ছিল তিন ছেলে। প্রত্যেকেই বোকাসোকা আর আলসে। ওরা সমাজ-সংসারে কীভাবে চলবে- এই নিয়ে খুব চিন্তা করতেন গহর।

হঠাৎ করে কঠিন অসুখে পড়লেন গহর আলি। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেন। স্ত্রী তিন ছেলেকে ডেকে বললেন, তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাদের জন্য তেমন কিছুই রেখে যেতে পারলাম না। রেখে গেলাম শুধু ছোট্ট একটা জাদু। জাদুটা রয়েছে আমার লাইব্রেরিতে। ওখানে যত বই আছে, সব পড়বে। তবেই খুঁজে পাবে জাদুটা। ওটা কোন বইয়ের কোনো পাতায় আছে, এই মুহূর্তে কিছুই মনে পড়ছে না। সেই জাদুবলে অনেক ধনসম্পদ বানাতে পারবে। অনেক সম্মান অর্জন করতে পারবে। তোমাদের কোনোকিছুর অভাব থাকবে না।

সবার চোখেই জল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমরা কিচ্ছু চাই না। সৃষ্টিকর্তা যেন আপনাকে সুস্থ করে তোলেন। এটাই আমাদের চাওয়া। এটাই হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো উপহার। কিন্তু গহর আলি ফিরলেন না। সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন পরপারে। মাস যেতে না যেতেই অভাব এসে জেঁকে বসল সংসারে। গহরের স্ত্রী চিন্তায় শুকিয়ে গেলেন। ছেলেরা চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। একসময় ছেলেদের মনে পড়ল বাবার লাইব্রেরির কথা। জাদুর কথা।

তিন ছেলে মাকে বলল, দোয়া করো মা, আমরা যেন বাবার রেখে যাওয়া জাদুটা খুঁজে পাই। তোমার মুখে যেন হাসি ফোটাতে পারি। ছেলেদের মাথায় হাত বুলিয়ে মা বললেন, তোমরা পারবে বাবা, নিশ্চয় পারবে। তবে শোনো, লাইব্রেরির সব বই পড়তে অনেকদিন লাগবে। জাদু খুঁজে পেতেও দেরি হতে পারে। তাই বলছি কী- পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কাজও করতে হবে। নইলে চলবে কেমন করে? তারপর জাদুটা খুঁজে পেলে তো হয়েই গেল।

বই পড়া শুরু করল তিন ভাই। মাঝেমধ্যে অন্য কাজও  করে প্রতিদিনের খরচ মেটানোর জন্য। কিন্তু আসল কাজ বইপড়া। লাইব্রেরির সব বই পড়ে শেষ করতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে জাদুমন্তর। এত বড় লাইব্রেরির এত এত বই কতদিনে যে পড়া শেষ হবে, কে জানেএই ভেবে গহর আলির স্ত্রীও বসে রইলেন না। তিনিও ছেলেদের সঙ্গে বই নিয়ে বসতে লাগলেন। মনে মনে ভাবলেন, সবাই তো আমরা আমরাই। জাদুটা একজনে পেলেই হলো। যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়, ততই মঙ্গল।

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বই পড়ে। সারাদিন কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলে বই নিয়ে বসে। বিকেলে বই পড়ে। বই পড়ে রাত জেগে জেগে। আগের তুলনায় ঘুমের পরিমাণ কমিয়ে দিল সবাই। কারণ, লাইব্রেরির বইগুলো তাড়াতাড়ি পড়ে শেষ করতে হবে।

পড়তে পড়তে মাস গেল। বছর গেল। এক তাকের বইও শেষ হলো না। জাদুও খুঁজে পেল না কেউ। তবু হতাশ না হয়ে বই পড়তেই থাকল। পড়তে পড়তে সকলের এমন অবস্থা হলো, এখন আর বই ছাড়া ভালো লাগে না। বই না পড়লে কাজে মন বসে না। খেতে মন চায় না। ঘুমও আসে না। বইয়ের ভেতর জাদু খুঁজতে গিয়ে বই- যেন তাদেরকে জাদুজালে বেঁধে ফেলল।

এক বছর, দু-বছর, তিন বছর... এভাবে যেতে যেতে বারো বছর গেল। তেরো বছরের মাথায় লাইব্রেরির শেষ বইটি যখন পড়া শেষ হলো, তখন মা তিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি কেউ কোনো জাদু খুঁজে পেয়েছ?

একে একে তিন ছেলে জবাব দিল, পাইনি মা।

- তাহলে কী পেয়েছ?

বড়ো ছেলে বলল, জ্ঞানের আলো পেয়েছি। এখন আর জাদুর প্রয়োজন নেই। জাদু খুঁজে না পাওয়ায় কোনো আফসোসও নেই।

বড়ো ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে মেজো ছেলে ছোটো ছেলে বলল, আমাদের অন্য কোনো জাদু লাগবে না, মা। আমরা জ্ঞানজাদু পেয়ে গেছি।

মা বললেন, ঠিক বলেছ। জ্ঞানই হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান। যা দিয়ে ধনসম্পদ অর্জন করা যায়। সম্মান অর্জন করা যায়। জ্ঞানের আলো জংধরা হৃদয়কে আলোকিত করে। জ্ঞানের ভেতরেই আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদু। কারণেই জ্ঞান মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিলেও কমে না। আরও বাড়ে। আমরা বুঝতে পারিনি, তোমাদের বাবা হয়তো এই জাদুর কথাই বলেছিলেন।

 

 

 


 

×