ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

​​​​​​​দেওয়ালে ঐক্য ও সমতার বার্তা

দেওয়ালজুড়ে বাংলার হৃদয়

প্রকাশিত: ২০:২৮, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দেওয়ালজুড়ে বাংলার হৃদয়

.

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রথম শহীদ আবু সাঈদের পুলিশের গুলির মুখে দ্বিধাহীনচিত্তে নিজের বুক পেতে দেওয়ার গ্রাফিতিতে উজ্জ্বল রাজশাহীর সড়কের বিভিন্ন দেওয়াল। আর শহীদ হওয়ার কিছুক্ষণ আগেও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি সরবরাহ করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। সময় তারপানি লাগবে? পানি উক্তি সম্বলিত গ্রাফিতিতেও ভরেছে রাজশাহী নগরের বিভিন্ন দেওয়াল।

শুধু তাই নয়, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর দেশ গড়া থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির আহ্বানও ফুটে উঠেছে ছাত্রদের অপরিপক্ব হাতের শৈল্পিক ছোঁয়ায়। রংতুলির আঁচড়ে শিক্ষার্থীরা মেলে ধরেছেন নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়, যেখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য। তাই দেয়ালে ফোটানো চিত্রে বার্তা ছড়ানো হয়েছে ঐক্য, সমতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির।

রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন সড়কে মোড়ে যেমন নর্দান মোড়, তালাইমারী, কাজলা গেট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) গেট, আনসার ক্যাম্প, রাজশাহী কলেজ, মহিলা কলেজ, সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে সার্কিট হাউস সড়ক প্রভৃতি স্থানে গ্রাফিতিতে তরুণরা দেশ নিয়ে তাদের ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। নব প্রভাতের অরুণ আলোর মতো এই গ্রাফিতিগুলো যেন হয়ে উঠেছে শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

মঙ্গলবার সরেজমিনে শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের পাশে অনেক পুরনো ভাঙা দেয়াল শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতি আঁকার প্রয়োজনে পরিষ্কার মেরামত করেছে। এতে করে নগরীর সড়কগুলোর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

মূলত গত জুলাইয়ের দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন দেওয়ালে দেওয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কনের মাধ্যমে ভাস্বর করে রেখেছে রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।তাদের এসব স্লোগানে অংশ পেয়েছে- শোনো মহাজন-আমি নয়তো একজন’, ‘কারার লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘রুখে দাও ষড়যন্ত্রএমন নানা স্লোগান সম্বলিত গ্রাফিতিতে সেজেছে রাজশাহীর বিভিন্ন সড়কের দেয়াল। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতিগুলো অঙ্কন করেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সীমানা প্রাচীরে অঙ্কিত একটি গ্রাফিতিতে দেখা গেছে, একটি শিশু তার বাবাকে উচ্ছ্বসিত হয়ে আকাশে উড়ন্ত হেলিকপ্টার দেখাচ্ছে অথচ সেই একই হেলিকপ্টার থেকেই তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। এর পাশেই আঁকা হয়েছেস্বাধীনতার সূর্যোদয় আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো চিত্র গ্রাফিতির ভাষায় তুলে ধরা হয়েছেন রাজশাহীর দেওয়ালে দেওয়ালে নানা রঙের প্রলেপ দিয়ে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখে দাও

রাজশাহী নগরীর জাদুঘর মোড়ের একটি দেওয়ালে চোখ আটকে গেল। সেখানে দেখা গেল উদিত সূর্যের ওপর লাল রঙে লেখাসাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখে দাও তার পেছনে দেওয়ালের ক্যানভাসে কালো রঙের আঁচড়ে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোড়ার চিত্র। বোঝানো হয়েছে একটি নতুন দেশ। এখানে সব ধর্মের, সব গোত্রের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। যে যার ধর্ম কিংবা উৎসব পালন করবে। যেখানে কোনো হানাহানি থাকবে না, দাঙ্গা চলবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে এখানকার গ্রাফিতিতে।

গ্রাফিতি শুধু প্রতিবাদের ভাষা নয়, গ্রাফিতির মাধ্যমে সুনিপুনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বিয়য়টি। একটা গ্রাফিতির ভাষা যত বৃহৎ অবস্থার বর্ণনা করতে পারে, তা মুখে বলে কখনো বোঝানো সম্ভব নয়। তাই রাজশাহীর দেয়ালে তুলে ধরা হয়েছে হাজারো গ্রাফিতি। আর এর মাধ্যমে জানান দেওয়া হয়েছে সম্প্রীতির বাংলাদেশের কথা।

যেখানে সহজ ভাষায় কেবল রং তুলিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ঠিক তার পাশেই আরেকটি স্লোগান আঁকা হয়েছে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামেরহিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোনো জন হে, কান্ডরি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা

প্রকৃতপক্ষে আবহমানকাল থেকেই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন সৌন্দর্যময় তেমনি এর অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসও বৈচিত্র্যময়। আমাদের দেশের জনগণ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী। দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ প্রীতিময় করেছে হাজারো সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির কারণে এদেশে খ্রিস্টানদের বড়দিন, বৌদ্ধদের পূর্ণিমা উদযাপন, হিন্দুদের পূজা পালন এবং মুসলমানদের ঈদ উদযাপনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

দেশে রোজা-পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান এক সঙ্গে  উদযাপনের অনেক উদাহরণ আছে। তেমনই উদাহরণের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছাত্রদের আঁকা এই গ্রাফিতিতে। রাজশাহী কলেজের এক ছাত্র বলেনজুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যে জাগরণ তৈরি হয়েছিল, সেটাকে আমরা গ্রাফিতির ভাষায় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালিয়েছি। ক্যাম্পাস ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন দেওয়ালে-দেওয়ালে বিপ্লবের ছোঁয়া লেগে থাকুক এটা প্রত্যাশা ছিল। তাই ছোট-ছোট বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

পুলিশের টার্গেট যখন ছাত্র

রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যান চিড়িয়াখানার সড়কের একটি দেয়ালের গ্রাফিতিতে আঁকা হয়েছে একটি লোমহর্ষক চিত্র। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের চিত্র।

চারদিকে বন্দুকের নল তাক করা ছাত্রদের ওপর। সে সব আগ্নেয়াস্ত্রের নল দিয়ে বের হচ্ছে গুলি। বিঁধছে নিরস্ত্র ছাত্রদের বুকে-পিঠে। রক্ত ঝরছে অনবরত। পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বন্দুক তাক করা একদল ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ। পাশেই পড়ে রয়েছে কোটা প্রথা আন্দোলনে ব্যবহৃত স্লোগানসমৃদ্ধ প্ল্যাকার্ড।

গ্রাফিতিতে বিভিন্ন রঙে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিরস্ত্র ছাত্রদের ধরে রাখা হয়েছে। তাদের চোখ বাঁধা, মুখ বাঁধা। চিত্রের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তা- ছাত্রদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতনের চিত্র। দেয়ালে গ্রাফিতির মাধ্যমে আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর নির্মম নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে শিক্ষার্থীরা।  

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী হাবিব বলেন, সারা দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে রাজশাহীতেও গ্রাফিতি দেওয়াল লিখনের কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের ওপর যে নির্যাতন করা হচ্ছে সেই বিষয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মানুষ যাতে খুব সহজে গ্রাফিতির দিকে চোখ ফেলেই বুঝতে পারে আন্দোলনকালে ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র।

আমরা করব জয়

রাজশাহী শহরের পর্যটন মোটেল সড়কের একটি গ্রাফিতিতে আঁকা হয়েছে বিজয়ের পতাকা উড়ানো টগবগে যুবককে স্বাধীন নতুন বাংলাদেশের নতুন সূর্যকে অবগাহনের দৃশ্য।

সুউচ্চ কোনো শক্ত বস্তুর ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা নিয়ে নতুন সূর্যকে আহ্বান জানানোর দৃশ্য। সেখানে লিখা হয়েছেআমরা করব জয়

এটি মূলত গেল আগস্ট স্বৈরাচার সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর আন্দোলনরত ছাত্রদের বিজয় গাথার উন্মুক্ত উল্লাস আর নতুন বাংলাদেশ গড়ার হাতছানির প্রতিফলন ফুটিয়ে তোলা হয়। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। বিজয় উদ্নে দেশজুড়ে গ্রাফিতি আঁকেন শিক্ষার্থীরা। রং, তুলির আঁচড়ে দেন নানা বার্তা। রক্তাক্ত জুলাইতেও চলে গ্রাফিতি আঁকা। আর ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর নতুন বার্তা দিয়ে গ্রাফিতি আঁকা হয় দেওয়ালে দেওয়ালে।

এতে ফুটিয়ে তোলা হয় আন্দোলনের আদ্যোপান্ত। বিজয়গাথা লালসবুজের পকাকা হাতে ছুটে চলা দামাল ছেলের গ্রাফিতিও বাদ পড়েনি। রাজশাহীর এই দেওয়ালচিত্রটি তারই একটি উদাহরণ। বিপ্লবের আত্মপ্রকাশের ভাষা হিসেবে যুগে যুগে নানান মাধ্যম অবলম্বন করে এসেছে।

কখনো কবিতা রূপে, কখনো বা গান নাটক গল্প উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্র অবলম্বনে। চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে এবারো বিপ্লবের এক নব্য স্বরের উত্থান ঘটে দেওয়ালে দেওয়ালে ঐক্য সমতার বার্তায়।

মামুন-অর-রশিদ

রাজশাহী

রং তুলির আঁচড়ে সংগ্রাম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত আগস্ট চূড়ান্ত বিজয়ের পর নানা রঙে সেজেছে মাদারীপুর। শোভা পাচ্ছে প্রতিবাদী স্লোগান, ছবি, কালজয়ী গান, কবিতার পঙ্ক্তিমালা আর শহীদদের প্রতিকৃতি। এমন পাল্টে যাওয়া শহর দেখে উচ্ছ্বসিত সবাই। তাদের প্রত্যাশা প্রিয় বাংলাদেশটাও একদিন এভাবেই পাল্টে যাবে। থাকবে না কোনো বৈষম্য, ঘুষ-দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নসহ সব ধরনের অনিয়ম-অনাচার। ঢেলে সাজানো হবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। শহরের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে দেওয়ালে এখন শোভা পাচ্ছে গ্রাফিতি। 

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মাদারীপুর শহরের কেন্দ্রস্থল শকুনি লেকের চারপাশ, বিভিন্ন সড়ক, কলেজ ক্যাম্পাস, সরকারি স্থাপনার বিভিন্ন দেওয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কন করা হয়। কখনো রং-তুলি আবার কখনো কালার স্প্রে দিয়ে লিখেছে প্রতিবাদ আর আন্দোলনের নানা কথা।

রঙ তুলির ছোঁয়ায় ফুটে তুলেছে কোটা আন্দোলনের স্লোগানসহ দেশের বিভিন্ন চিত্র আর সমাজ সংস্কারমূলক উক্তি। যেন দেওয়ালে দেওয়ালে ফুটে উঠেছে নতুন এক বাংলাদেশের চিত্র। এমন চিত্র দেখে থমকে দাঁড়াচ্ছেন পথচারীরা। নজর কাড়ছে সবার। আর ছাত্রদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এসব গ্রাফিতিতে বৈষম্য-স্বৈরাচারবিরোধী, গঠনতন্ত্র পুনর্গঠন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের চাওয়া জানা অজানা লাখো বীরদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ফুটে ওঠে। কোটা সংস্কার আন্দোলন সর্বশেষ সরকার পতন আন্দোলনে শহীদ হওয়া বীর যোদ্ধাদের ছবি তাদের স্মরণে বিভিন্ন গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে গাওয়া হয়েছে নানা মুক্তির জয়গান। দেওয়ালে লেখনীতে স্মরণ করা হয়েছে শহীদ মুগ্ধরপানি লাগবে পানিশহীদ আবু সাঈদের ছবি দিয়েও লেখা হয়েছেতুমি বীর চির উন্নত মম শির’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘আমার নতুন বাংলাদেশ’ ‘তারুণ্য শক্তি, তারুণ্যেই জয়সহ নানা জয়গান।

আরও ফুটে উঠেছেস্বাধীনতা এনেছি সংস্কারও আনব’, ‘স্বাধীন বাংলায় চাঁদাবাজের ঠাঁই নাই’, রাজনীতি করবি তো দুর্নীতি ছাড়, দুর্নীতি করবি তো রাজনীতি ছাড়’, ‘দাম কমাও জান বাঁচাও’, ‘জীবে দয়া করে যে জন সে জন সেবিছে ঈশ্বরসহ বিভিন্ন সংস্কারমূলক উক্তি। গ্রাফিতি আঁকা শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা৭১ দেখিনি, তবে ২৪ স্বাধীনতা দেখছি। আমরা আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তুলব। আমাদের বীর শহীদ ভাই-বোনদের স্মরণে গ্রাফিতি আঁকছি। প্রজন্মের যোদ্ধাদের আগামী দিনে সকল যুদ্ধে প্রেরণা হিসেবে নেবে।

কোথাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নতুন সম্ভাবনা, আবার কোথাও দেখা মিলবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের দৃশ্য। এমন চিত্র ফুটে উঠেছে দেয়ালে দেয়ালে। মাদারীপুর সরকারি কলেজ ভেতর তরুণ প্রজন্মের একদল শিক্ষার্থী রং তুলি হাতে ব্যস্ত। তাদের হাতের রং-তুলির আঁচড়ে অসম্প্রাদায়িক বাংলাদেশে জেগে উঠেছে। নতুন সূর্যোদয়ের আভায় হিন্দু-মুসলিমের নেই ভেদাভেদ, ফুটিয়ে তোলা হয় এমনও দৃশ্য।

শিক্ষার্থীদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেওয়াল অলিগলির দেওয়াল নোংরা হলেও চোখে পড়েনি কারও। নিজেদের উদ্যোগে পরিষ্কার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এতে আল্পনা দিতে যোগ দেয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। প্রতিটি দেওয়ালেই ফুটে উঠেছে স্বাধীনতা, সেই সঙ্গে কোটা সংস্কারে শহীদ শিক্ষার্থীদের নাম ছবি। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, তরুণরাই হবে দিন বদলের রূপকার। দেশকে এগিয়ে নিবে অনেক দূর। গড়ে উঠবে দুর্নীতিমুক্ত, মাদক সন্ত্রাসমুক্ত এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ।

এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এক একটি দেওয়াল যেন এখন ডানামেলা রঙিন প্রজাপতি। বিজ্ঞাপন আর পোস্টারের দখলে থাকা প্রাচীরগুলো রূপান্তর হয়েছে নতুন ক্যানভাসে। অন্যায় রুখে দিতে ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সবার মনে। শিক্ষার্থীদের নিপুণ হাতে পাল্টে যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালের চিত্র। এর থেকে তৈরি হবে নতুন এক বাংলাদেশ সেই প্রত্যাশা সকলের। গ্রাফিতির পাশাপাশি অঙ্কন করা হয়েছে নানা রঙের আল্পনা। এমন বদলে যাওয়া দৃশ্য আগে দেখেনি মানুষ। যেন পুরাতনকে মুছে ফেলে নতুনের আহ্বান। শহরের আলহাজ আমিনউদ্দিন হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাফসান জানি বলেন, ‘শহরের বড় বড় নেতা-কর্মীরা থাকলেও শহরের দেওয়ালগুলোর চিত্র পাল্টায়নি।

এসব নেতাদের কখনই মনে হয়নি, দেওয়ালগুলো রঙিন করে তোলা উচিত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে দেওয়ালচিত্র আলপনা করা হচ্ছে, শহরকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য এই কার্যক্রম চলতেই থাকবে।সামিয়া ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনে নতুন এক বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। তাই এই দেশ সংস্কারের দায়িত্বও আমাদের। তারই অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেওয়ালে সতর্কতামূলক আল্পনা আঁকা হচ্ছে। যা দেখে অনেক কিছুই শেখার আছে।মাদারীপুর সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী পাভেল হাসান বলেন, ‘আমরা চাই সকল মানুষের অধিকার তারা সমানভাবে পেয়ে জীবনযাপন করবে। স্বাধীন দেশে সকলে মিলেমিলে থাকব, সেই লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তাই স্বাধীন দেশের প্রথম সংস্কার রং-তুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।

মাদারীপুর সরকারি কলেজের আরেক শিক্ষার্থীর তানজিম মিম বলেন, ‘কলেজটির চারপাশ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আমরা শিক্ষার্থীরা একযোগে আল্পনা দিচ্ছি। নোংরা দেওয়ালগুলো পরিষ্কার করে, রং-তুলির মাধ্যমে মনের কথাগুলো ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।

শহীদ আবু সাঈদ

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। শিক্ষার্থীদের মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্কের মোড়ে এলে তিনি ছিলেন সবার আগে। একপর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করলেও আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। বুক পেতে দেন গুলি করার জন্য। শহীদ হন বীর যোদ্ধা আবু সাঈদ। সেই আবু সাঈদের বুকে রক্তঝরার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মাদারীপুর সরকারি কলেজের দেওয়ালের গ্রাফিতিতে। এই আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে।

মাদারীপুরে প্রথম শহীদ দীপ্ত দে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সফল করতে মাদারীপুরের সকল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে রাজপথে নেমে পড়ে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে সামাল দিতে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ যোগ হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। ১৮ জুলাই প্রথম শহীদ হয় মাদারীপুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র দীপ্ত দে। এতে আন্দোলন আরও বেগবান হতে থাকে।

দীপ্ত সহযোদ্ধা তুহিন বলেন, ‘মাদারীপুরের প্রথম শহীদ দীপ্ত। দীপ্তসহ অনেক ছাত্র শহীদ হয়েছেন। মাদারীপুর শকুনী লেকে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের ধাওয়ায় ছাত্ররা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচার আশায়। মৃত্যুর কাছে হার মেনে যায় দীপ্ত।

ফায়ার সার্ভিস অফিসে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল, তবে তাদের দেরিতে উদ্ধার কাজ শুরু করার ফলে পানিতে ডুবে যায়। পানি থেকেই উদ্ধার করা হয় দীপ্তকে। দীপ্তসহ মাদারীপুরের সকল শহীদদের হত্যার বিচার চাইতে এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।গ্রাফিতি আঁকা এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘জগৎকে জানার আগে কেন ফুলেরা ঝরে পড়ল? ফুলের মতো শিশুদের কি অপরাধ ছিল? নতুন বাংলাদেশ দেখার আগেই কেন ঝরে পড়ল ফুটফুটতে তরতাজা প্রাণ? মুক্ত আকাশের নিচে বাসার ছাদে খেলায় কি ছিল তাদের অপরাধ? এইসব প্রশ্ন আমাদের বাকরুদ্ধ করেছে। সেই চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে আমাদের আঁকা গ্রাফিতিতে।

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর

বিবর্ণ দেয়ালে প্রতিবাদের ভাষা

গ্রাফিতিশব্দটির উদ্ভব ইতালিয়ান শব্দগ্রাফিটিয়েটোথেকে। এর বাংলা অর্থখচিত গ্রাফিতি সাধারণত দেওয়ালে বিনা অনুমতিতে আঁকা হয়। এর বিষয় এবং অঙ্কনমান খুব সাধারণ, কিন্তু পিছনের বোধটা থাকে অতি সূক্ষ্ম গভীর। এজন্য গ্রাফিতিকে বলা হয়কাউন্টার কালচারবাগতানুগতিক সংস্কৃতির বিপরীত।অর্থাৎ যে শিল্পকর্মটি প্রচলিত রীতি-নীতি সিদ্ধান্তের বিপরীতে এক ধরনের শিল্পবিপ্লব গড়ে তোলে, তাকেই গ্রাফিতি বলা হয়। সমাজের অবক্ষয়, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, রাজনৈতিক অরাজকতা, স্বেচ্ছাতন্ত্রতা- প্রভৃতিই হয়ে ওঠে গ্রাফিতির বিষয়। বীরেন দাশ শর্মা রচিতগ্রাফিতি: এক অবৈধ শিল্পগ্রন্থে গ্রাফিতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- ‘এক অর্থে গ্রাফিতি সাহিত্য না হয়েও লেখার শিল্প, চিত্রকলা না হয়েও অঙ্কনশিল্প

পশুর হাড় দিয়ে আঁকা প্রাচীন গুহাচিত্রকেই প্রথম দিককার গ্রাফিতি হিসেবে মনে করা হয়। প্রাচীন গ্রিক রোমানদের সময়কাল থেকে মূলত এই গ্রাফিতির প্রচলন ভালো করে শুরু হয়। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সারা পৃথিবীতেই গ্রাফিতি নির্যাতিত অধিকারবঞ্চিত মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছে। গ্রাফিতি আঁকতে দেওয়াল মালিকের কোনো অনুমতি নেওয়া হয় না। এজন্য গ্রাফিতি কিছুটা বিতর্কিতও বটে। 

বাংলাদেশে গ্রাফিতি আঁকার প্রচলন শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে।কষ্টে আছি- আইজুদ্দিনলেখা সেই গ্রাফিতির কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। এর দীর্ঘদিন পরে ২০১৭ সালে ঢাকার বিভিন্ন দেওয়ালে আঁকা হয়সুবোধসিরিজের কিছু গ্রাফিতি- যা সবার নজর কাড়ে এবং ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। তবে গত আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের হাত ধরে গ্রাফিতিশিল্প যেন রীতিমতো উৎসব হয়ে ওঠে। মাত্র কয়েকদিনে দেশজুড়ে আঁকা হয় হাজার হাজার গ্রাফিতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জেলা নেত্রকোনায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আগস্টের পরদিন থেকেই গ্রাফিতি আঁকতে রাস্তায় নেমে আসে একঝাঁক তরুণ-তরুণী।

নেত্রকোনা সরকারি কলেজ কলেজমাঠের দেওয়াল, আঞ্জমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মোক্তারপাড়া সেতু, নেত্রকোনা রেল স্টেশন, দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের গেট, শহীদ মিনারের আর্ট গ্যালারি কৃষিফার্মের বাউন্ডারিসহ বিভিন্ন স্থাপনার দেওয়ালে দেওয়ালে তারা ন্ডখন্ড দলে ভাগ হয়ে এঁকেছেন অগণিত গ্রাফিতি। তাদের আঁকা গ্রাফিতিতে বিবর্ণ দেওয়ালগুলো যেন ফিরে পেয়েছে শৈল্পিক সৌন্দর্য, যা দৃষ্টি কাড়ছে পথচারীদের।

গ্রাফিতি আঁকার একটি দলের সঙ্গে কথা হয় জনকণ্ঠের। ১০ সদস্যবিশিষ্ট দলটিতে আছেন : ঈষিকা অরুণিমা, নিশাত তাসনিম, স্পন্দন বিশ্বা তীর্থ, গাজী, মাহি, মোবারক, প্রিয়ন্তী দাশ, অমেয় পত্রনবীশ, পূর্ণতা নন্দী, মাকসুদুল বাহার, সর্বজিৎ দাশ সিফাত জাহান। প্রত্যেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ স্কুলের শিক্ষার্থী। নেত্রকোনা সরকারি কলেজ, নেত্রকোনা রেলস্টেশন আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দেওয়ালে তারা মোট ১১টি গ্রাফিতি এঁকেছেন। শাবির স্থাপত্য বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ঈষিকা অরুণিমা বলেন, ‘আমাদের আঁকা তিনটি উল্লেখযোগ্য গ্রাফিতির শিরোনাম : . ‘পানি লাগবে? পানি?’, . ‘আকাশ দেখাও বারণ . ‘গণমাধ্যম হোক গণমানুষের ঈষিকা যোগ করেন, ‘ঢাকার রাজপথে কোটা আন্দোলনকারীদের মাঝে পানি বিতরণ করতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন মীর মুগ্ধ। মারা যাওয়ার একটু আগেও তিনি আন্দোলনকারীদের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন- ‘পানি লাগবে? পানি?’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিও ফুটেজটি জাতিকে কাঁদিয়েছে।

তাই আমরা একটি গ্রাফিতির শিরোনাম করেছি- ‘পানি লাগবে? পানি?ঈষিকা বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ঢাকার আকাশে একটি হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়ার অভিযোগ ওঠে। সেই দৃশ্যটি অবলম্বন করেই আমরা এঁকেছি- ‘আকাশ দেখাও বারণ।বুয়েটের এমএমই দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী স্পন্দন বিশ্ব তীর্থ বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে কিছু কিছু গণমাধ্যম নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি। কারও কারও ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন উঠেছে। আমরা চাই গণমাধ্যম হোক সম্পূর্ণভাবে প্রভাবমুক্ত। তাই আমরা একটি গ্রাফিতির শিরোনাম করেছি- ‘গণমাধ্যম হোক গণমানুষের।

সঞ্জয় সরকার

নেত্রকোনা

 

 

 

 

×