যেদিকে চোখ যায় কাশবন। শরতের অমল মহিমা ধরা দিয়েছে গোটা দেশেই।
অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া-/দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া...। রবীন্দ্রনাথের এই অমল ধবল পাল যেন শরতের কাশবন। নদীর ধারে ছড়িয়ে থাকা কাশবনে এখন মন্দ মধুর হাওয়া এসে লাগছে। অপরূপ দৃশ্য দেখছেন তো মন ভরে?
ভাদ্র ও আশ্বিন দুই মাস শরতকাল। এখন দ্বিতীয় মাস আশ্বিন চলছে। মানে, বয়সের দিক থেকে মাঝামাঝি। এ সময়ের মধ্যে প্রকৃতি শরতের বৈশিষ্ট্যগুলোকে বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছে। প্রিয় ঋতুকে বিশেষভাবে চেনা যায় নীল আকাশ দেখে। এখন বৃষ্টিহীন রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আকাশ গাঢ় নীল হয়ে ধরা দিচ্ছে।
গাঢ় নীলে আবার ছুটে চলছে সাদা মেঘের রথ। ওপরে তাকালে মন আপনি গেয়ে উঠছে, ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা-/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা।’
তবে শরতের প্রকৃতিকে সবচেয়ে বেশি জাগিয়ে রাখে কাশফুল। কাশফুলের বৈজ্ঞানিক নাম সাকারাম স্পনটেনিয়াম। দীর্ঘকাল ধরে এটি বাংলাদেশে আছে। ঘাসজাতীয় জলজ উদ্ভিদ অনেকটা ছনের মতো। গাছ ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। চিরল পাতার দুইপাশ বেশ ধারাল। কাশফুলের অন্য একটি প্রজাতির নাম আবার কুশ। পুরাণে কুশের কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দুটি দেখতে প্রায় একইরকম। তাই সহজে আলাদা করা যায় না। আলাদা করার দরকারও নেই। সৌন্দর্য উপভোগের সময় এখন।
ভাদ্র বা আশ্বিনের চনমনে আকাশ সব জায়গা থেকে সমানভাবে দেখা গেলেও, কাশবন কিছুটা বিরল হয়ে গেছে। নদী কমছে। গতি পেয়েছে নগরায়ণ। এসবের প্রভাবে উজাড় হয়েছে বহু কাশবন। এক সময় নদীর ধারে জলাভূমিতে ঘন হয়ে ফুটে থাকে কত যে কাশফুল! এখন গ্রামের নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতেই মূলত হয়। নৌকা করে যাওয়ার সময় দুই ধারে কাশবন দেখার আহা কী আনন্দ! দুরন্ত ছেলে-মেয়েরা তো ছোট্ট নৌকা নিয়ে বনের একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল সংগ্রহ করে তবেই ফিরে আসে তারা। হয়তো তাই কবিগুরু শরতের মাঝে শিশুর স্বভাবও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সে কথা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘শরতের মধ্যে শিশুর ভাব। তার, এই-হাসি, এই-কান্না। সেই হাসিকান্নার মধ্যে কার্যকারণের গভীরতা নাই, তাহা এমনি হাল্কাভাবে আসে এবং যায় যে, কোথাও তার পায়ের দাগটুকু পড়ে না, জলের ঢেউয়ের উপরটাতে আলোছায়া ভাইবোনের মতো যেমন কেবলই দুরন্তপনা করে অথচ কোন চিহ্ন রাখে না।’
শরতের কালে শহরতলীতেও কম-বেশি কাশফুল ফোটে। ঢাকার আশপাশের এলাকায় এখন যেমন ফুটে আছে। এখন তো মেট্রোরেল সুবিধা আছে। চাইলে যে কোনোদিন দিয়াবাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারেন। আশপাশের খোলা জায়গায়, এমনকি বাড়ি করার জন্য প্রস্তুতকৃত প্লটে দুলছে কাশের গুচ্ছ! দেখে মনে পড়ে যায় সেই ছড়াখানি, ‘একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।’
আরেকটু দূরে যাওয়ার সুযোগ থাকলে বেছে নিতে পারেন কেরানীগঞ্জকে। সেখানে সারিঘাট এলাকায় গেলে, বিশ্বাস করুন, হারিয়ে যাবেন! সত্যজিৎ রায়ের অপু দুর্গা যে কাশবনের মধ্য দিয়ে ছুটে গিয়েছিল অনেকটা সেরকমটি পেয়ে যাবেন এখানে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সফেদ বন। লম্বা সাদা কাশের গুচ্ছ মৃদু বাতাসে চমৎকার দুলছে। কখনো পুরো বন ডানে হেলে পড়ছে। কখনো বা বামে।
কাশফুল আলতো করে জড়িয়ে ধরছেন তন্বী তরুণীরা। ছবি তুলছেন। সেই ছবিতে ভরে উঠছে ফেসবুক। ঘন কাশবনে দিব্যি চলছে লুকোচুরি খেলা। তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি শিশুরা বুড়োরাও আনন্দ করছেন। প্রকৃতির সঙ্গে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছেন তারা। সিরাজদিখানেও আছে কাশফুলের বিপুল রাজ্য। সেখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন।
মনে করিয়ে দিই, শরতের এই দান আশ্বিন এবং তার কিছুদিন পর পর্যন্ত অটুট থাকবে। শেষ হয়ে যাবে শরতও। কবিগুরু প্রিয় ঋতুর বিদায় বেলাটি সম্পর্কেও চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যাটি এরকম: ‘আমাদের শরতে বিচ্ছেদ-বেদনার ভিতরেও একটা কথা লাগিয়া আছে যে, বারে বারে নূতন করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে বলিয়াই চলিয়া যায়-তাই ধরার আঙিনায় আগমনী-গানের আর অন্ত নাই।
যে লইয়া যায় সেই আবার ফিরাইয়া আনে। তাই সকল উৎসবের মধ্যে বড়ো উৎসব এই হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়ার উৎসব।’ হারিয়ে ফিরে পাওয়ার ঘটনা সবার জীবনেই ঘটুকÑ আমাদের তাই প্রত্যাশা।