ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

চা নির্দেশক বেগুনি রঙা ফুল

নবাব সিরাজউদ্দৌলা বলতেন ‘বেগম বাহার’

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নবাব সিরাজউদ্দৌলা বলতেন ‘বেগম বাহার’

উত্তরাঞ্চলের সমতলে চা নির্দেশক দাঁতরাঙা ফুল

উত্তরাঞ্চলে বর্তমান সময়ে চারপাশে সবুজ পাতার মাঝে হাসিমুখে উঁকি দিয়ে আছে বেগুনি রঙা এক ফুল। পাপড়ির গড়ন অন্য ফুলের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। বেগুনি পাপড়ির ঠিক মাঝ বরাবর আছে হলুদ রঙের কেশর। ফুলের শরীরে শিশির  কণা পড়লে তার সৌন্দর্য যেন বেড়ে যায় কয়েকগুণ। 
প্রায় সারাবছর ফুল ফুটলেও প্রধানত গ্রীষ্ম-বর্ষায় গাছে প্রচুর ফুল ফোটে। ডালের আগায় অল্প কয়েকটি ফুলের গুচ্ছ থাকে। একেকজন একেক নামে চেনে এই গুল্মজাতীয় গাছটিকে। এটি কোনো বাগানে চাষ হয় না।  আগাছা হিসেবে পরিচিত হলেও অসংখ্য গুণে গুণান্বিত। 
কথিত আছে, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার খুব প্রিয় ছিল এই ফুল। তাই তিনি  নাম দেন ‘বেগম বাহার’। এই গাছের আরেকটি চমৎকার গুণ রয়েছে। যে জায়গায়  জন্মে, সেই জায়গাটিকে চা চাষের জন্য উপযুক্ত হিসেবে ধরা হয়। তাই একে চা নির্দেশক বা টি ইন্ডিকেটর শ্রেণির উদ্ভিদ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
 বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও এলাকায় এর বিস্তার অনেক। তাই এই সকল এলাকায় সমতল ভূমিতে ব্যাপকহারে চা চাষ হচ্ছে। নবারের বেগম বাহার আজ অনেক নামে পরিচিতি পেয়েছে। এলাকা ভেদে লুটকি, বন তেজপাতাও বলা হয়। তবে গুল্মজাতীয় ফুলগাছটির জনপ্রিয় নাম হলো দাঁতরাঙা।

বলা হয় এই গাছে ছোট আকৃতির যে ফল জন্মে তা খেলে দাঁত বেগুনি হয়ে যায় বলেই নামকরণ করা হয়েছে ‘দাঁতরাঙা’। আবার, এর পাতা দেখতে তেজপাতার ন্যায় হওয়ায় একে ‘বন তেজপাতা’ বলা হয়। চাকমা ভাষায় ফুলটি মুওপিত্তিংগুলো নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম মালাবার মেলাস্টোম। 
নবাবের বেগম বাহার অর্থাৎ দাঁতরাঙার গাছটি বেশ ঝোপালো হয়। উপযুক্ত জায়গা পেলে উন্মুক্ত জায়গায় এটি সহজেই বেড়ে উঠতে পারে। পাহাড় কিংবা লাল মাটি রয়েছে এমন জায়গায় গাছটি ভালো জন্মে। তাই টিলা/পাহাড়, নদীর ধার, রাস্তার কিনার, জঙ্গল, ঝোঁপঝাড় ইত্যাদি স্থানে এই গাছ বেশি চোখে পড়ে। উত্তরাঞ্চল ছাড়াও গাজীপুর, সিলেট, কাশিমপুর, শ্রীপুরে এই গাছ বেশি দেখা যায়।

বান্দরবান ও টেকনাফে এর আরও কয়েকটি জাতের দেখা মেলে। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভারত, মালয়েশিয়া ও নিউগিনি, ফিলিপিন্স এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় ফুলটির দেখা মেলে। কিন্তু সেই ফুলের কোনো গন্ধ নেই।  যদিও বেরিজাতীয় এই ফল  মূলত পাখি আর প্রজাপতির খাবার। 
বুনোফুল হলেও বেগম বাহার বা  দাঁতরাঙার কিন্তু ঔষধি গুণ রয়েছে। আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয়। গাছটি প্রায় তিন মিটার লম্বা হয়। এর উপর শাখাগুলো চতুষ্কোণী এবং চ্যাপ্টা থেকে প্রশস্ত, সূক্ষ্ম খ-িত এবং তামাটে শঙ্কদ্বারা ঘন আবৃত। গাছের পাতা দেখতে উপবৃত্তাকার। পু®পমঞ্জুরিতে তিনটি থেকে সাতটি ফুল থাকে। মঞ্জুরিপত্র কখনো স্থায়ী, বৃহৎ ও সুদৃশ্য আর ২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা। বহিঃপৃষ্ঠা বিশেষ করে মাঝের দিকে চ্যাপ্টা এবং সাদাটে বা লাল শঙ্কা দ্বারা ঘন আবৃত। এরা চিরহরিৎ অর্থাৎ সারাবছরই সতেজ থাকে।
বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও লেখক ড. গ্রিন মিজানুর রহমান বলেন, চা-পাতা গাছ বা ক্যামেলিয়া সিনেনসিস হল একটি ভেষজ উদ্ভিদ। শরীর চাঙ্গা করার পানীয় হিসেবে চা এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর এই চা পাতা গাছ যেখানে ভালো জন্মে, সেখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো দাঁতরাঙা গাছ দেখা যায়। দাঁতরাঙা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম মেলাস্টোমা মালাবার্থিকাম। এ গাছের অর্থনৈতিক ও ভেষজ গুরুত্ব সীমিত হলেও এটি সূচক বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত।
উদ্ভিদ ও ফসল বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড.  মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, দাঁতরাঙা গাছের পাতার রস আমাশয়, পেটের ব্যথা ও বাতজ্বর কমাতে পারে। লোক চিকিৎসায় এটি দাঁত ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, ডায়রিয়া, চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। থাইল্যান্ডে মেওহিল আদিবাসীরা এর শিকড়ের নির্যাস গরম পানিতে ফুটিয়ে প্রসব পরবর্তী জটিলতায় ব্যবহার করে। ফিলিপিন্সে এর বাকল সর্দিজনিত গলবিল প্রদাহ এবং মুখের পচনে ব্যবহৃত হয়। তবে এই উদ্ভিদের একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য হলো যে জায়গায় এই গাছটি জন্মে সেই জায়গাটাকে চা চাষের উপযুক্ত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। 
তাই একে চা নির্দেশক বা টি ইন্ডিকেটর শ্রেণির উদ্ভিদ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তবে যেখানে সেখানে জন্মে বলে ফুলটির তেমন কদর নেই। উত্তরাঞ্চলেল গ্রামীণ নারীরা এর গাছ কেটে শুকিয়ে রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে।

×