ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

ছড়াতে থাক মুগ্ধতা

হাসি হয়ে ফুটুক বুনো অর্কিডের ফুল

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

হাসি হয়ে ফুটুক বুনো অর্কিডের ফুল

শৌখিন ফুলপ্রেমীদের প্রিয় অর্কিড

গত বছর, মানে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে দেখেছিলাম অর্কিড। প্যারিসের রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎই চোখে পড়ল একটি ফুলের দোকান। এর পর আর পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়? ঢুকে পড়লাম দোকানে। নানা জাতের গাছ। ফুল। অভিভূত হয়ে দেখছিলাম শুধু। কিন্তু তখনও জানতাম না যে, অর্কিডের বিশাল এক রাজ্য অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

ছোট্ট একটি গাছ কিনে বের হয়ে আসব, ঠিক তখন পা পড়ল অর্কিড রাজ্যে। কী বলব, চোখ একেবারে ছানাবড়া! একসঙ্গে এত অর্কিড আগে কোনোদিন দেখিনি। বিস্ময়ভরা চোখে কিছু সময় শুধু তাকিয়ে থাকতে হলো। নানা রঙের বড় বড় ফুল নিয়ে একটি গাছ। ফুলভর্তি গাছকে আবার চমৎকার গঠন নির্মিতি দেওয়া হয়েছে। সবগুলো গাছ সুবিন্যস্ত।

এত বিন্যস্ত কী করে হয়? নাকি কৃত্রিম ফুল? এমন প্রশ্ন মন থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় করতে স্পর্শ করতেই হলো পাপড়ি। না, একদম ঠিকঠাক। সবকটি গাছ হৃষ্টপুষ্ট। সবকটি ফুলই সমান তাজা। বৃত্তাকারে ছড়িয়ে থাকা ফুল লম্বা সময় আমাকে ধরে রেখেছিল।  
খুব সম্ভবত ইউরোপ অঞ্চলেই প্রথম দেখা মিলেছিল অর্কিডের। একটি তথ্য বলছে, অর্কিড প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগে প্রথম দেখা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালের দিকে অ্যারিস্টটলের ছাত্র থিওফ্রাস্টাস তরুলতা বিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেটির নাম ছিল ‘ইনকোয়ারি ইন টু প্লান্টস।’ এই গ্রন্থে প্রথমবারের মতো অর্কিডের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

গ্রিক উদ্ভিদবিদ চিকিৎসক (খুব সম্ভবত ভেষজ চিকিৎসক) ডিওসকোরিডস প্রথম শতাব্দীতে এই গাছগুলোকে স্পষ্টভাবে অর্কিড হিসাবে চিহ্নিত করেন। কনফুসিয়াসের বাসায় অর্কিড ছিল। তিনি নাকি অর্কিড নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন! 
অর্কিড পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ। বুনোফুল। পাহাড়েই বেশি হয়। বন-পাহাড়ে কত শত বৃক্ষ! অপেক্ষাকৃত বড় বৃক্ষের ডাল আঁকড়ে থাকে অর্কিড। তাই বলে অন্য গাছের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দেয় এমন নয়। ক্ষুদ্র প্রাণ হলেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। বৃক্ষ শাখায় পেঁচিয়ে থাকা নরম সরু লতায় অনিন্দ্য সুন্দর ফুল হয়। ছোট ছোট ফুল। গাঢ় রং। উন্নত রুচির পাশাপাশি এক ধরনের আভিজাত্যকে তুলে ধরে। তাই দামও একটু বেশি।

পাহাড়ি বুনো ফুল নিয়ে সমতলের সৌন্দর্যপ্রেমীরা দারুণ মেতে থাকেন। বাড়তি যতেœ বাঁচিয়ে রাখেন অর্কিড। বাসার বারান্দায় ঝুলতে থাকা অর্কিডে ফুল ফুটলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন সবাই। ফুলদানিতে অনেক ফুল রাখার পরিবর্তে কয়েকটি অর্কিড রেখে দিলে ঘরের চেহারা বদলে যায়। সব মিলিয়ে অর্কিডের ফুল খুবই স্পেশাল। 
অর্কিডের ফুলের প্রধান আকর্ষণ এর বাহারি রং। কোন্ কোন্ রঙের হয়? উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন হতে পারে, কোন রঙের হয় না? বাস্তবতা হচ্ছে, কালো ছাড়া বাকি প্রায় সব রঙের হয় অর্কিড। উদ্ভিদবিদদের তথ্য মতে, এ জাতীয় ফুলের তিনটি বৃতি। সমপরিমাণ পাপড়ি। একটি বৃতি সাধারণত রূপান্তরিত হয়ে একটি ওষ্ঠ গঠন করে। বৃতিগুলো দেখতে পাপড়ির মতো। ফুলের পুংদ- এবং স্ত্রীদ- একত্রে সংলগ্ন। ফুলের পাপড়ি সাধারণ ফুলের চেয়ে পুরু হয়।

গঠন এত নিখুঁত  যে, হঠাৎ দেখায় মনে হতে পারে কৃত্রিম! 
যতদূর তথ্য, অর্কিড অর্কিডেসি পরিবারের ফুল। একবীজপত্রী। এই পরিবারের সংখ্যা এখন ৯০০। প্রজাতি সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। পৃথিবীতে প্রায় ২৫ হাজার প্রজাতির অর্কিড ফুল আছে। অধিকাংশ দেশে জন্মায়। আর বেশি চোখে পড়ে গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে। বিশেষ করে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকায় এর সরব উপস্থিতি। গ্রীষ্মম-লীয় অর্কিড ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাহামা থেকে ইংল্যান্ডে অতিথি হয়। বসবাস শুরু করে। তখন থেকেই অর্কিড চাষের চেষ্টা শুরু করে ইংরেজরা।

বাংলাদেশে অর্কিড চাষের আনুষ্ঠানিক শুরুটা করেছিলেন হাসিনা দৌলা। অর্কিড চাষের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলা যায় তাকে। জানা যায়, মালয়েশিয়ার এক পুষ্পমেলা থেকে ১৯৯৬ সালে শখ করে অর্কিডের চারা আনেন তিনি। 
উদ্ভিদ প্রজননবিদ ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়ার দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়,  অর্কিড দুই ধরনের হয়ে থাকে। এপিফাইটিক ও টেরেস্ট্রিয়াল।

এপিফাইটিক বড় গাছকে আশ্রয় করে  বেড়ে ওঠে। তবে নিজের খাদ্যের জন্য ওই উদ্ভিদের ওপর এরা নির্ভরশীল নয়। পরাশ্রয়ী অর্কিডের মূল লম্বা, মোটা ও পুরু। বাতাস  থেকে মূলের মাধ্যমে এরা খাদ্য গ্রহণ করে। বাংলাদেশে আম কাঁঠাল বট ইত্যাদি গাছের ডালে এ ধরনের অর্কিড জন্মাতে দেখা যায়। টরেস্ট্রিয়াল অর্কিড আবার মাটিতে জন্মায়। ভূমিজ অর্কিডের গুচ্ছ মূল। দেখতে সরু সুতার মতো হয়। কোনো কোনো অর্কিডে একটি করে লম্বা সরু কা- থাকে। কা-ে পরস্পর বিপরীত দিকে সরু ও লম্বা পাতার বিস্তার ঘটে। কা- থেকে এক প্রকার বায়বীয় মূল বের হয়।

এদের বর্ধনশীল অংশ থেকে পাতা হয়। পত্রাক্ষ থেকে হয় ফুল। একে অবশ্য মনোপডিয়াল অর্কিড বলা হয়। সিমপডিয়াল অর্কিডের বেলায় কা-ের গোড়া হতে শাখা জন্ম নেয়। শাখার অগ্রভাগ থেকে সৃষ্টি হয় অনিন্দ্য সুন্দর ফুল। কবির ভাষায়: নীরবতার আখ্যান শেষ হবে একদিন/ মিশে যাবে সব, তুমিও/থেকে যাবে শুধু এইসব অর্কিড...। হ্যাঁ, অর্কিড থেকে যাক। আমাদের বাগানে, বাসার বারান্দায় হাসি হয়ে ফুটুক অর্কিডের ফুল।

×