ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

ছোট এক বনভূমি

রুনা তাসমিনা

প্রকাশিত: ২২:০৫, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ছোট এক বনভূমি

চার স্তর বিশিষ্ট এই ছাদ বাগান

চার স্তর বিশিষ্ট এই ছাদ বাগানের ধরন একেবারে আলাদা। এটিকে শুধু ছাদ বাগান বললে কম হবে। দেখতে ছোটখাটো এক বনভূমি। ২ হাজার ৭০০ বর্গফুটের বাগানে ফলদ, বনজ, ঔষধি গাছের পাশাপাশি আছে বারোমাসি ফলের সমাহার। শোনা যায় পাখির কলতান। যেখানে এক কোনায় কিচিরমিচির করে মাতিয়ে রাখে মুনিয়া, কবুতর, বাজরিগর, তিলা ঘুঘু। এদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসে প্রতিবেশী চড়ুই, টিয়া, বুলবুলিসহ অনেকে।

ছাদের পাকা ফল পাখিদের দখলে চলে গেলেও আফসোস নেই। উল্টো তাদের আপ্যায়নের জন্য পোড়ামাটির ট্রেতে রাখা থাকে খাবার। পাখা ঝাপটে পাখিরা গোসলও সেরে নেয় ছোট্ট সুইমিংপুলে! নির্ভয়ে বাগানের গাছে গাছে ওড়ে। বৈদ্যুতিক বাতির চোখ ধাঁধানো আলো নেই এখানে। এই বাগানে দিনের বেলা দিন আর রাতের বেলা সত্যিকার অর্থেই রাত। হাসনাহেনার সুঘ্রাণ নিতে নিতে এখানে রাত দৌড়ায় ভোরের দিকে। নানা রং মেখে সকালে হেসে ওঠে রেইন লিলি। বলছি ঢাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম কবির খানের ছাদ বাগানের কথা। 
বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আমাদের দেশের জলবায়ু। ছয় ঋতুর দেশে এখন আমরা তিনটি ঋতুকেও নিয়মিত পাই না। যখন একদল মানুষ গাছ কেটে বন উজাড় করে প্রকৃতিকে নিঃস্ব করে তুলছে, তখন আবার প্রকৃতির পাশে দাঁড়িয়েছে কিছু সবুজ রক্ষাকারী মানুষ।

পরিবেশ নিয়ে তাদের প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন। পরিবেশ সচেতন এসব প্রকৃতিবান্ধব মানুষ নিজের ঘরের ছাদ, বাড়ির আশপাশে গড়ে তুলছেন সবুজের সমাহার। ফুলে-ফলে সুশোভিত, সুসমৃদ্ধ তাদের এই অরণ্য। তাদের একজন শফিকুল ইসলাম কবির। 
কোথায় কতটুকু জায়গা রেখে কোন গাছ লাগাতে হবে, ঘুঘুর বাসা কোথায় হলে পাখিগুলো স্বতঃস্ফূর্ত থাকবে, কোন গাছে রোদ দরকার, কোন গাছে ছায়া সব দিকেই তার নজর। এখানে গাছের গায়ে কুঠার বসানো দূরের কথা, শুকনা পাতাটিও সারের কাজে ব্যবহার করেন তিনি।   
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ সুন্দরের পূজারী। ফুল সৌন্দর্যের অন্যতম উৎস। শফিকুল ইসলাম তার বাগানে বছরজুড়েই ফুলের উপস্থিতি থাকবে, এমনভাবে সংগ্রহ করেছেন সব ফুলের চারা। এক ঋতুর ফুল বিদায় নিলে বাগান আলো করে হাজির হয় আরেক ঋতুর ফুল। ফুলের পাশাপাশি বারান্দায় আছে বিভিন্ন অর্কিড। ‘নাহার ডেল’ ভবনের এই ছাদে আরও আছে কদম, ছাতিম, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুল, হিজলের মতো বড় বৃক্ষজাতীয় ফুলগাছ।  
রকমারি জাতের আমের রাজত্ব এই বাগানে। কোনো গাছে মুকুল তো কোনো গাছে মার্বেল আকৃতির আম। বারোমাসি আম বলে কিছু গাছে ঝুলতে দেখা যায় থোকা থোকা ঢাউস আকৃতির আম। আছে কাস্তে আকৃতির মহাচানক, রঙিন আমেরিকান পালমার, বারোমাসি থাই কাটিমন, থাই নাম ডক মাই, থাই ব্যানানা আম, বারোমাসি মালয়েশিয়ান লুবনা, হাঁড়িভাঙা, কিউজাই, পুনাই, চেন্নাইসহ অনেক জাতের আম। ফলে সারা বছরই কোনো না কোনো গাছে থোকা থোকা আম থাকে।

ছাদে ড্রামের মাটিতেই দিব্যি ফল নিয়ে হাজির ভিয়েতনামি বারোমাসি আঠাহীন কাঁঠাল। আছে ডালিম, আমলকী, আমড়া, সফেদা, থাই কদবেল, লেবু, থাই বাতাবিলেবু। দেশ-বিদেশের কয়েক জাতের মাল্টা, কমলা, জাবুটিকাবা, আপেল, আঙুর, পেয়ারা, জামরুল, লঙ্গান, রাম্বুটান, ড্রাগন ফল। ঋতু অনুযায়ী সবরকমের শাক-সবজির পাশাপাশি এখানে দেখা মেলে কাঁটাময় ক্যাকটাস।

স্নো কুইন, মার্বেল কুইনের মতো পোথোস, অ্যাগ্লোনিমা, অ্যান্থুরিয়াম, বার্ড নেস্ট, ক্রোটন, পেপেরোমিয়া, সিঙ্গোনিয়াম, ফিলোডেন্ড্রন, সিলভারস্টাইন, স্পাইডার প্লান্ট, স্নেক প্লান্ট, জিজি প্লান্ট, সাকুলেন্টসহ অনেক প্রজাতির পাতাবাহার গাছ আছে ছাদ, বারান্দা এমনকি ঘরের ভেতরেও।
শফিকুল ইসলাম কবির আর কামরুন নাহারের এই বাগান তাদের সন্তানই বলা যায়। অসাবধানতায় যদি গাছের একটি পাতাও ছিঁড়ে মনে হয় ব্যথা তারাই পেয়েছেন। বিভিন্ন রকমের ফুল, ফল, পাতা বাহারের বাহারি আভরণে সাজিয়ে নিজের বাগান থেকে প্রতিদিন সকালের শুভেচ্ছা জানান কবির। যে শুভেচ্ছায় পরিবেশ নিয়ে জনসচেতনতামূলক চমৎকার বার্তা থাকে। যেন এক একদিন ঘুম ভাঙিয়ে বলেÑ ‘চলো, এই দেশ আবার সবুজ করে তুলি। 
প্রত্যেকে এভাবে বাগান করো।’ নিজের বাগানের পরিচর্যার পাশাপাশি শফিকুল ইসলাম কবির অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে উৎসাহিত করেন। তার এই কাজে পাশে থাকেন স্ত্রী কামরুন নাহারও। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি এই ভালোবাসা কবির দম্পতি চায় পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে। দেশের বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে কবির নিয়ে আসেন নানা প্রজাতির গাছ। চার স্তরে সাজিয়ে রেখেছেন ছাদের এই ছোট্ট বনভূমি।

বাসার প্রবেশ ফটকেই স্বাগত জানাবে বাগানবিলাস, চন্দ্রপ্রভা, সাইকাস ও এক সারি বকুল ফুলের গাছ। তেমনি ওঠার সিঁড়িগুলোতেও সবুজের উপস্থিতি ভুলিয়ে দেবে আপনার ক্লান্তি। ছাদে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে অনেকগুলো লাভ বার্ড। যেন গুনগুন করে দর্শনার্থীদের বলছে, প্রকৃতিকে তোমরা ধ্বংস কর না।

×