ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

নূরলদীনের আদি ভিটা ফুলচৌকি গ্রাম

জাগো বাহে কোনঠে সবায়...’

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২২:৫০, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জাগো বাহে কোনঠে সবায়...’

মসজিদের প্রধান ফটকের সামনে নূরলদীনের কবর

বাহের দ্যাশের মাটি এখন ফসল বৈচিত্র্যে ভরপুর। কৃষি সাফল্যে পাল্টে গেছে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি। কানে বাজছে কাব্যনাট্যের সেই পঙক্তি নূরলদীনের সারাজীবন। প্রয়াত কবি সৈয়দ শামসুল হকের সাড়া জাগানো কবিতা। যার শুরুটা ছিলÑ ‘নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত-আর নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয়, আছে ঊনসত্তর হাজার।’ কবিতার শেষ লাইনটি ছিল ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’।

তেভাগা আন্দোলনের প্রায় দুইশ বছর আগে এই অঞ্চলেই সংঘটিত হয় কৃষক আন্দোলন, যে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন নূরলদীন। বাস্তবতা এই যে, বাহের দ্যাশের উত্তরাঞ্চলের রংপুরের কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া স্বাধীনতাকামী একজন কৃষক, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ নূরুউদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং। 
কৃষি দিয়ে পাল্টে গেছে উত্তরাঞ্চল। নতুন এক কৃষি বিপ্লব সূচিত করেছে বৃহত্তর রংপুরের কৃষক। এক জমিতে এখন তিন ফসল হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চার ফসলও। কোনো জমি পতিত পড়ে থাকে না। ক্রমেই ফলে-ফসলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে উত্তরাঞ্চল। 
১৯৪৬-৪৭ সালে এপার বাংলা, ওপার বাংলা মিলিয়ে মোট ১৯টি জেলায় তেভাগা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। দিনাজপুর জেলার তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল তেভাগা আন্দোলনের মূল সূতিকাগার। তৎকালীন দিনাজপুরের ৩০টি থানার ২২টিতেই ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনের প্রভাব। দিনাজপুরে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন হাজি মোহাম্মদ দানেশ।

ব্রিটিশবিরোধী সিপাহী আন্দোলনে বেশিরভাগ সুবিধাভোগী জমিদারই ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়েছিলেন। সুবিধাভোগীরা সংগ্রাম করে না, সংগ্রাম করে বঞ্চিতরা। স্বাধীনতার স্বপ্নসাধও রচিত হয়েছে কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, উপেক্ষার পটভূমি সামনে নিয়ে। 
রংপুর বিভাগীয় শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে মিঠাপুকুর উপজেলা। ময়েনপুর ইউনিয়নের শুকুরেরহাট হয়ে আরও ২ কিলোমিটার পশ্চিমে নূরলদীনের আদিভিটা ফুলচৌকি গ্রাম। স্থানীয়রা জানান, মসজিদের প্রবেশদ্বারের পূর্বপাশ ঘেঁষে একটি পরিকল্পিত ফুল বাগান ছিল। এতে সৌন্দর্যময় স্থাপত্য রাখা হয়েছিল। বর্তমানে সেই জায়গাটি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করছেন গ্রামবাসী। মসজিদের পাশে ইমামের থাকার জন্য মিনার বিশিষ্ট একটি কক্ষ রয়েছে।

এই মসজিদ প্রাঙ্গণেই শায়িত আছেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রাণপুরুষ শহীদ নবাব নুরুউদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং। তিনি দিল্লির স¤্র্রাট শাহ আলমের (দ্বিতীয়) আপন চাচাতো ভাই ও ভগ্নিপতি। ইংরেজ শাসন উৎখাতে ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্যবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
জমিদারির লোভে দিবা ও নিশি নামে দুই বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে নুরুউদ্দিন লালমনিরহাটের আদিতমারীর মোগলহাটে ব্রিটিশ সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণে আহত হন। এ অবস্থায় তাকে তার নির্মাণাধীন রাজধানী ফুলচৌকিতে নেওয়া হয়। আহত অবস্থায় ১৭৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ফুলচৌকির নিজ বাসভবনে মারা যান তিনি।
জানা গেছে, ফুলচৌকি মসজিদ চত্বরের কবরস্থানে আরও ঘুমিয়ে আছেন নুরুউদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জংয়ের বংশধর হায়দার আলি চৌধুরী। তার বিখ্যাত ইতিহাসখ্যাত অতিমূল্যবান বই পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ।
জানা যায়, বাংলা অঞ্চল তখন পার করছিল হাহাকারময় সময়। তারপরও অত্যাচার, নিপীড়ন আর লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত টাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবস্থা তখন রমরমা। রাজস্ব ক্ষমতা হাতে পেয়ে ইংরেজরা তখন চালু করেছিল ইজারাদারি প্রথা। আর এই ইজারাদারি ব্যবস্থায় রংপুর, দিনাজপুরের ইজারাদারি লাভ করেন অত্যাচারী জমিদার দেবী সিংহ। নূরলদীন ও তার বাহিনীর লড়াই ছিল কৃষক স্বার্থবিরোধী এই ইজারা প্রথার বিরুদ্ধে। সে সময় একাধিক সম্মুখযুদ্ধ হয়। তেমনই একটি লড়াই হয়েছিল ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে। 
রংপুর-দিনাজপুর, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির বিদ্রোহী প্রজারা লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে অবস্থান করছিলেন। ইংরেজ-সমর্থিত জমিদাররা তখন প্রাণভয়ে আত্মগোপনে। নূরলদীনের নেতৃত্বে একটি দল পাটগ্রামের মোগলহাটে পৌঁছায়। নূরলদীনের সঙ্গে কতজন সৈন্য আছেন, সেটা আন্দাজ করতে না পেরে ইংরেজ বাহিনী তাদের দুজন সৈন্যকে কৃষকদের পোশাক পরিয়ে নূরলদীন বাহিনীর পেছনে পাঠিয়ে দেয়।

উদ্দেশ্য ছিল, গোয়েন্দাগিরি করে নূরলদীন বাহিনীর তথ্য জানা। একপর্যায়ে নূরলদীন, প্রধান দুই সহযোগী লালমনি, দয়াশীলসহ তার বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। একজন ইংরেজ সৈন্য পেছন থেকে এসে নূরলদীনকে অতর্কিত আক্রমণ করে বসে। নূরলদীন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। লালমনিসহ অন্যরা তৎক্ষণাৎ তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। সেই যুদ্ধে দয়াশীল নিহত হন।

আহত নূরলদীনকে তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকায় নিয়ে সেবা করতে থাকেন লালমনি। এদিকে, ইংরেজ বাহিনী হন্যে হয়ে নূরলদীনকে খুঁজতে থাকে। উপায় না দেখে গভীররাতে তিস্তা নদী পার হয়ে রংপুরের মিঠাপুকুরের কাছে ফুলচৌকি গ্রামে নূরলদীনকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেটি তার নিজের গ্রাম। আহত অবস্থায় ১৭৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নূরলদীন ফুলচৌকির নিজ বাড়িতে মারা যান। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। 
ফুলচৌকি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঝোঁপ জঙ্গলের ভেতর একটি বিধ্বস্ত ইটের দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে। এটিই নূরলদীনের বসতভিটার শেষ চিহ্ন বলে জানান স্থানীয়রা। তার মৃত্যুর অনেক পরে ১৮২২ সালে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। গ্রামের নামে এর নামকরণ করা ফুলচৌকি মসজিদ। ওই মসজিদের প্রবেশপথে শায়িত শহীদ নূরুউদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং। কবরের পাশে টাঙানো আছে একটি সাইনবোর্ডও।
গ্রামবাসীর মতে, নূরলদীনের মৃত্যুর পর স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে ১৮২২ সালে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদটি বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত। গ্রামের কৃষক সুলতান মিয়া বলেন, ফুলচৌকি মসজিদটি ২০০ বছরের পুরোনো হলেও দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংস্কার হচ্ছিল না। অযতœ, অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে চাকচিক্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ধুলো-বালিতে বদলে গিয়েছিল রঙ।

দূর থেকে মিনার না দেখে বোঝার উপায় ছিল না এটি মসজিদ। অথচ বাংলার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বাক্ষী এই মসজিদের কোলঘেঁষে সমাহিত জাগো বাহে কোনঠে সবায়খ্যাত নুরুলদীনের কবরটাও ছিল দৃষ্টির আড়ালে। 
২০২২ সালে মসজিদটির সংস্কার কাজ করেছিল উপজেলা পরিষদ। প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে এখানে সরকারিভাবে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে।

×