ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

দুই বন্ধুর গল্প

আলী আসকর

প্রকাশিত: ২০:২৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দুই বন্ধুর গল্প

.

সুবলের গায়ের রং কালো হলেও তার চোখ দুটো দেখতে অসম্ভব সুন্দর। যখন চোখ নেড়ে কথা বলে তখন মনে হয় চোখের মণি দুটো মণি নয়, যেন সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ। তার চোখ দেখে আমি ঈর্ষায় মরি, কেন যে ওর চোখের মতো আমার চোখ হলো না!

আমাদের স্কুুলের সুনামের কথা জানে না রকম লোক জেলায় একজনও নেই। অন্য জেলার ছেলেরাও এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য তুমুল চেষ্টা করে। যার কাছে মেধা বেশি, যে ছেলেটি স্যারের প্রশ্নের আগে ঠাস ঠাস শব্দে উত্তর বের করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারে, কেবল তারাই এই স্কুুলে পড়ার সুযোগ পায়।

আমি ক্লাসের ফার্স্টবয়। ক্লাসের ক্যাপটেনও আমি। ছাত্ররা যেমন সবসময় আমার কাছে কাছে থাকতে চায়, শিক্ষকদের কাছেও আমি মহা রতেœ মতো থাকি। আমি প্রতিদিন যে সিটে বসি, ওখানে শুধু আমিই বসি। এই স্কুলে প্রথম দিন থেকে প্রথম সিটটা আমার জন্য বরাদ্দ হয়ে আছে, আজতক কেউ তার অঘটন ঘটাতে পারেনি।

সুবল রোজকার মতো আজও আমার পাশে এসে বসে। আমার পাশে বসার জন্য সে সকাল সকাল স্কুলে চলে আসে। যখন স্কুলে একটি কাকপক্ষীয়ও আসে না তখন সুবল এসে ইশকুলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং পঙ্খীরাজের মতো আমার সিটের পাশে এসে বসে যায়।

সুবল আমার গা ঘেঁষে নরম করে বলল, ‘আজ বিষ্যুদবার। চার বিষয় পরে ছুটি হয়ে যাবে। তোমার কথা মাকে অনেকবার বলেছি। মা বলল তোমাকে নিয়ে যেতে। তুমি কি আমার মায়ের ইচ্ছে পূরণ করবে?’

আমি হেসে বললাম, ‘এটা কি কোনো কথা হলো? আমিও কিছুদিন থেকে ভাবছি তোমাদের বাড়িটা একবার দেখে আসি। যাক, আজ তার একটা কূল হলো। কিন্তু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরতে হবে। আবার সময় ক্ষেপণে বেশি জোরাজুরি করো না।

না, করব না।

সুবলের বাড়ি যেতে একটা বিল পার হতে হয়। বিলের মাঝখানে ইট বিছানো একটি সরু রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে একটি রিকশা চলাচল করতে পারে। বিলে সবুজ ধান উঁকি মেরে মাথা নাড়ছে। হালকা মৃদুমন্দ বাতাস বইছে চারপাশে। ঝাঁক ঝাঁক নানান পাখি উড়ছে আকাশে। মনের আনন্দে হেঁটে চলেছে সুবল। সে যেন সাত রাজ্য জয় করে বাড়ি ফিরছে।

মনে মনে ওদের বাড়িটা যে-রকম মনে করেছিলাম আসলে আমার আন্দাজটা তার উল্টোটি হলো। ঝুপড়ির মতো সারি সারি ঘর। সবগুলো ঘরেই জং ধরা পুরনো টিনের চাল। চারদিকে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। উত্তর পাশে একটি দেয়ালে লাল রং দিয়ে লেখা, গনি কলোনি।

সুবল বলল, ‘এসো এসো, আমরা আটাশ নম্বর ঘরে থাকি। গনি কলোনির ঘরের সংখ্যা একশ তিন। এখানে থাকার একটিই মজা-রাতদিন হইচই আর মহিলাদের তুমুল ঝগড়া। ঝগড়ার ক্যাচালে মাঝেমধ্যে বই বন্ধ করে বসে থাকি। তখন মাথা নিচু করে কত কিছু ভাবি তার হিসাব নেই।

আমি আটাশ নম্বর ঘরের সামনে দাঁড়াই। সুবল ভিতরে গিয়ে আবার ফিরে আসে। একটু পর আধ পুরনো শাড়ি গায়ে একজন মহিলা এসে হাস্যমুখে বলে, ‘এসো। আমি সুবলের মা। সুবল থেকে তোমার ব্যাপারে রাজ্যির কথা শুনেছি।

ছোট ছোট দুটো লাগোয়া ঘর। পেছনে একটি রান্নাঘর। পেছনের দরজা দিয়ে একটি টিউবওয়েল দেখা যাচ্ছে। প্রথম ঘরের এক কোনায় একটি ছোট্ট টেবিল। টেবিলের উপরে সুন্দর করে গুছানো বইয়ের স্তূপ। সুবলের আরও ভাই-বোন আছে নাকি? সুবলকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি।

এক গ্লাস লেবুর সরবত, একটি প্লেটে চারটে বিস্কিট হাতে মহিলা বললেন, ‘খাও বাবা। সুবল একটু পরে ভাত খাবে।

আমি ঢকঢক করে পুরো গ্লাস সরবত খেয়ে বলি, ‘যাই মাসি। মা আবার চিন্তা করবে।

সুবল ভিতর থেকে একটা পোটলা নিয়ে এসে বলে, ‘চলো। বাবার দুপুরের খাবারটা আমাকেই পৌঁছে দিতে হয়। ফকিরগলির মোড়ে বাবার কাজ। তিন-চার মিনিটের পথ। তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?’

তিন-চার মিনিটের পথ কী আর পথ। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, ‘চলো।

ফকিরগলির মোড়ে এসে সুবল এক মুচির কাছে এসে দাঁড়ায়। মুচি নিবিড় মনে জুতা সেলাইয়ে ব্যস্ত। সুবল এখানে এসে কেন দাঁড়াল আমি বুঝতে পারলাম না।

সুবল গদগদ স্বরে বলল, ‘বাবা তোমার খাবার। দেখো আমাদের বাড়িতে কে এসেছে। ওর নাম জাকির। আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয়।

আমার ভিতরে মেঘের গুড়ুগুড়ু শব্দ। সুবল মুচি-বাবাকে পরিচয় করিয়ে দিতে একটুও দ্বিধাবোধ করল না। লোকটা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে  বললাম, ‘নমস্কার কাকা।

আবার এসো।

জি কাকা, আসবো।

সুবল নিঃশব্দে খানেক পথ আমার পেছনে পেছনে আসে। একসময় আমার কাঁধের কাছে এসে বলল, ‘বাবা মুচি কাজ করে বলে আমার একটুও দুঃখ নেই। এখন থেকে নিশ্চয় তুমি আমাকে দূর-দূর করতে শুরু করেছো। হয়তো কাল থেকে আমার পাশে বসতেও নাক সিটকাবে। সত্যটা বলে আমার এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে। আমাকে বিদায় দাও। খিদেটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাচ্ছে। বিদায় বন্ধু।

আমি মুচকি হাসলাম। তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘আমার বাবা কর্ণফুলী নদীতে নৌকা বায়। নিজের নৌকা না, পরের নৌকা। গত বছর ঘূর্ণির চক্করে পড়ে বাবার নৌকাটা কোথায় হারিয়ে যায়। আর পাওয়া যায়নি। এখনো সেই নৌকার জরিমানার কিস্তি বাবাকে শোধ করতে হয়। আমরা দুই-বন্ধুই গরিব। একদিন আমাদের সুদিন আসবে। সেই সুদিনে একদিন আমরা বাবাদের পাশে দাঁড়াব। বাবারা হাসলে আমরাও হাসব। কী, ঠিক বলছি না সুবল?’

সুবলের চোখেমুখে স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠল। গলার স্বর মোটা করে বলল, ‘কত্তো গভীরভাবে কথা বলে আমাদের ফার্স্টবয়!’

আমি ব্যাগটা ডান থেকে বাম হাতে নিলাম। এবং দ্রুতপায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

 

 

×