ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১

অহনার বিড়াল ছানা

কাজী আবুল কাসেম রতন

প্রকাশিত: ২২:২৮, ২৩ আগস্ট ২০২৪

অহনার বিড়াল ছানা

গভীর মনোযোগের সাথে অংক করছে অহনা। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সকাল থেকে। আজ ছুটির দিন। কথা ছিল বিকেল থেকে সবুজ সংঘ আয়োজিত কিশোর ফুটবল টুর্নামেন্টের ন্ডগ্রুপের খেলা শুরু হবে। প্রোগ্রামটাই মাটি। বাসার সবাই দিবা নিদ্রায় মগ্ন; বাসার নতুন কাজের ছেলেটা পর্যন্ত। ছেলেটা বয়সে অহনার চেয়ে বছর দুয়েক বড়। গ্রাম থেকে যখন প্রথম আসে তখন দিনে ঘুমোতে দেখে অবাক হতো। আর এখন নিজেই শহরে আরামে গা ভাসিয়েছে।

অহনার একা একা ভালো লাগছিল না। বাহিরে যাওয়াও বন্ধ। নিরুপায় হয়ে অংক নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসেছে, পায়ে সুঁড়িমুড়ি অনুভূতি অহনার একাগ্রতায় বাধা দেয়। টেবিলের নিচে তাকিয়ে ওর চোখ স্থির হয়ে যায়- ওমা, একি কান্ড! সাদা কালো মেশানো এক ফুটফুটে বিড়াল ছানা। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গায়ের লোমগুলো লেপটে গেছে। থেমে থেমে মিউ মিউ করছে। অংক নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে শব্দটা শুনতে পায়নি।

বিড়াল ছানাটা বোধহয় বুঝতে পেরেছে যে অহনা ওর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। অহনার পায়ের সাথে গা ঘষছে আর মিউ মিউ করছে। যেন বলছেÑ দেখ, আমার সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। জ্বরে কাঁপছি। আমাকে একটু আশ্রয় দাও।

পৃথিবীর সমস্ত মায়া যেন অহনার মনে এসে জমা হলো। নিচ থেকে তুলে বিড়াল ছানাটিকে টেবিলের উপর রাখলো অহনা। তারপর এক দৌড়ে বাথরুম থেকে ওর তোয়ালেটা নিয়ে এলো, ভালো করে গা মুছে দিল, চুলোর উপর গরম দুধ জ্বাল দেওয়া ছিল। অহনা বাটিতে করে খানিকটা দুধ এনে দিল। বিড়াল ছানাটি চুক চুক করে খেতে লাগল। অহনা দেখে দেখে মজা পাচ্ছে। ভাবছে ওর জন্য এতবড় একটা চমক ছিল!

আম্মা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে দেখলেন- অহনা বিড়াল নিয়ে খেলা করছে। তিনি কপাল কুচকে ধমকে উঠলেন- অহনা, ছি-ছি! তুমি বিড়াল ধরেছ! ডিপথেরিয়া হবে যেÑ যাও, শিগগির হাত ধুয়ে এসো। এই বিড়ালটা আবার কোত্থেকে এল? কাদের, কাদের! এই কাদের বিড়ালটাকে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আয়।

অহনা করুণ চোখে আর্তনাদ করে ওঠে- না আম্মু, এটা আমার বিড়াল বান্টি। এটাকে আমি পুষব। অহনা বিড়াল ছানাটিকে বুকে আকড়ে ধরে এমন করুন মুখ করে রাখে যে আম্মু কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

এরপর থেকে অহনার দিন-রাত্রি কাটে বান্টিকে নিয়ে। বিকেল বেলা খেলতে যায় না, বন্ধুরা ডাকতে এসে ফিরে যায়। রাতে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে বসে উসখুস করেÑ স্যার, একবার আমার বান্টিকে দেখে আসি? স্কুলে যাওয়ার আগে বান্টিকে তুলে নিয়ে আদর করে। বান্টিও মিউ মিউ করে আদর নেয়। একদিন হয়তো বাল্টি মিউ মিউ করছে না। ব্যাস! স্কুলে যাওয়া বাদ। কারণ বান্টির মন খারাপ।

স্কুলের হোমটাস্ক করতে বসে অহনা একটু পর পর বলে, বান্টিসোনা ওদিকে যেও না। এটা ধরো না, ওখানে উঠো না। পড়ে যাবে এদিকে এসো। মানুষের বছরে একবার জন্মদিন আসে, কিন্তু বান্টির জন্মদিন মাসে চার বার পালিত হয়। প্রতি শুক্রবার এইবার বান্টি প্রথম অহনার কাছে এসেছিল কিনা। বিশেষ দিনে বিশেষ খাবার। মাছ, মাংস, দুধ, ভাত বান্টির মঙ্গল চিন্তা সারাক্ষণ অহনার মাথায় ঘুরপাক খায়। আম্মু তার একমাত্র ছেলের এহেন অত্যাচারও সহ্য করতেন কিন্তু যেদিন অহনার স্কুলের প্রোগ্রেস রিপোর্টটা হাতে আসে- সেটা নিয়ে অহনার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে মা বললেন, এবার অন্তত খান্ত বাবা!

পরদিন স্কুল থেকে ফিরে অহনা যথারীতি বান্টি বান্টি বলে চেঁচাতে লাগল কিন্তু বান্টির কোন সাড়াশব্দ নেই। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে অহনা ক্লান্ত হয়ে আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, বান্টি কোথায়? আম্মু উত্তর না দিয়ে গম্ভীর মুখে অন্যদিকে চলে গেলেন। অহনা ঠাস করে কাদেরের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। কাদের ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার কী দোষ? আম্মাই তো দূরে ফ্যালাইয়া দিতে কইল। রাগে-দুঃখে অহনার চোখে পানি চলে এল। দৌড়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বালিশ মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল অহনা টের পায় নি। পায়ে গুঁড়গুঁড়ি পেয়ে গুম ভাঙে ওর। তাকিয়ে দেখে বান্টি! তড়াক করে উঠে বসে অহনা। ছোঁ মেরে বান্টিকে কোলে তুলে নেয়। বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। বান্টিও মিউ মিউ করতে থাকে। যেন বলছে আর পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ো না। এবার না হয় রাস্তা চিনে আসতে পেরেছি। এরপর হয়তো আরো দূরে কোথাও রেখে আসবে। কাজেই আমার দিকে তাকিয়ে অন্তত পড়াশোনায় মন দাও।

 

×