ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১

আগুনমুখা পাড়ের মাছের বাজার

প্রকাশিত: ২০:২৫, ২৩ আগস্ট ২০২৪

আগুনমুখা পাড়ের মাছের বাজার

তাজা মাছের জন্য খ্যাত পানপট্টি ঘাট

নদীর নাম আগুনমুখা। এটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম উত্তাল নদী। এর অবস্থান পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে কমবেশি মাত্র দশ কিলোমিটার দক্ষিণে। আগুনমুখা নদীকে অনেকে মোহনাও বলে থাকে। কারণ এর উৎসমুখ বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। আবার অনেকের মতে সাতটি নদী আগুনমুখায় মিলেছে। কারণেও এটি মোহনা। একটা সময়ে আগুনমুখা অনেক বড় ছিল। বিশেষত দৈর্ঘ্য-প্র্রস্থ দুটোতেই বিশাল। এপার-ওপার কিছুই দেখা যেত না। একটা সময়ে আগুনমুখা সারাবছর উত্তাল থাকত। আগুনের মতো লেলিহানগ্রাসী ছিল। সবকিছুই সে গ্রাস করে নিত। তাই এর নাম আগুনমুখা। সে সময়ে আগুনমুখা পাড়ি দিতে দক্ষ মাঝিদেরও বুকে কাঁপন ধরতো। দিনের পরদিন ঘাটে মাঝিরা নাও নিয়ে বসে থাকত, কখন আগুনমুখা একটু শান্ত হয়, সে আশায়।

আগুনমুখার দিনকাল এখন অনেক পাল্টে গেছে। নদীর মাঝে বিশাল চর জেগেছে। বর্ষা ব্যতীত বছরের অন্যান্য সময়ে আগুনমুখা বেশ শান্ত। তবে ভরা বর্ষায় এর যৌবন টের পাওয়া যায়। তখন সেই আগের মতোই সর্বগ্রাসী।

আগুনের মতো স্রোতস্বিনী উত্তালতার কারণেই নয়। আগুনমুখা আরও বিবিধ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে বিখ্যাত এবং স্মরণীয়। এর চারপাশে রাবনাবাদ, বুড়াগৌরাঙ্গ, কাজল, দ্বারভাঙ্গাসহ কয়েকটি নদীর মিলনস্থল হওয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ব্যাপকতা অনেক। রাঙ্গাবালীসহ দক্ষিণের শতাধিক চর-দ্বীপে যাতায়াতে আগুনমুখা নদী পারাপার অপিরহার্য। বিশেষ করে মৎস্য খাতে আগুনমুখা যুগ যুগ ধরে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। আগুনমুখাসহ আশপাশের নদীতে শত শত জেলে নৌকা সর্বত্র ভেসে আছে। যোগাযোগ মৎস্য বেচাকেনায় তাই আগুনমুখা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে অতি পরিচিত নাম।

পানপট্টি ঘাট। দেখতে আর দশটি নদী পাড়ের সাধারণ ঘাটের মতোই। ঘাট সংলগ্ন নদীতে ছড়ানো ছিটানো নৌকার ছুটে চলা। জেলেদের ব্যস্ততা। পাড়ে দোকানের সারি। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সবুজ বৃক্ষ। এর একপাশে যাত্রী ওঠানামার টার্মিনাল পন্টুন। যেখানে মাঝেমধ্যে ভিড়ছে ছোট-বড় লঞ্চ ট্রলার কিংবা ফিশিং বোট। সাম্প্রতিকালে যুক্ত হয়েছে স্পিডবোট। যাত্রীরা আসছে-যাচ্ছে। ছুটছে গন্তব্যে। সাদামাটা দৃশ্যের পাশে আগুনমুখা নদী তীরের পানপট্টি ঘাটের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এর মাছের বাজার।

আগুনমুখার সুবাদে পানপট্টি ঘাটের মাছের বাজার বহু মানুষের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।

পানপট্টি ঘাটের মাছের বাজারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এটি মানুষের পদচারণায় জমজমাট হয় আকাশে সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই। আবার ভেঙে যায় সকালের  রোদের তেজ বাড়ার আগেই। মাত্র ঘণ্টা তিন-চারেকের বাজার। আর এতেই বেচাকেনা হয় লাখ লাখ টাকার তাজা মাছ। যে মাছ কেনায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতা মহাজন থেকে শুরু করে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা লোকজনও। আগুনমুখায় রাতভর চলে জেলেদের মাছ ধরা।

দৃশ্য প্রায় সারাবছরের। ভোররাতে জেলেরা একের পর এক নৌকা নিয়ে ছুটে আসে ঘাটে। দীর্ঘ সে নৌকার সারি। সাজি বা টুকরি ভর্তি তাজা মাছ নিয়ে জেলেরা আসে ঘাটে। সেখানে আগে থেকেই চৌকি পেতে বসে থাকে মহাজনরা। এদের মধ্যে আছে মহজনদের পাশাপাশি দাদনদাররাও। খোলা আকাশের নিচের সে মাছের বাজার কয়েক মুহূর্তেই জমে ওঠে। চলে জেলে-মহাজনদের হাকডাক। ক্রেতা বিক্রেতাদের দরদাম। বড় পাইকাররা সেখান থেকে মাছ কিনে ছুট লাগায় গলাচিপাসহ বিভিন্ন শহরের দিকে। ছোট পাইকাররা সেখান থেকে মাছ কিনে স্থানীয় বাজারে বসে। একদিকে টাটকা তাজা মাছ। আরেকদিকে দাম তুলনামূলক কম।

কারণে পানপট্টি ঘাটের মাছের বাজারে দূর-দূরান্ত থেকেও আসে লোকজন। সেখানে সকালে লোকজনের ভিড়ে রীতিমতো যানজট লেগে যায়।

গত কয়েকবছরে পানপট্টি মাছের বাজার জমজমাট হয়ে ওঠায় রাঙ্গাবালী, দশমিনা, কলাপাড়াসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার জেলেরাও সেখানে মাছ বেচতে আসে।

স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, পানপট্টি ঘাটের মাছের বাজারে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় জেলে নৌকা মাছ নিয়ে আসে। মৌসুমভেদে সংখ্যা ওঠানামা করে। বর্ষায় কিছুটা বেশি হয়। শীতে মাছ কম ধরা পরে।

তাই জেলের সংখ্যাও কমে যায়। প্রতিদিন সেখানে কী পরিমাণ মাছ বেচাকেনা হয়, তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। তবে অনেকেই ধারণা করেন, প্রতিদিন গড়ে সেখানে দশ লাখ টাকার মাছ বেচাকেনা হয়।  পানপট্টি ঘাটের মাছের বাজার কখনো কখনো বিকেলেও বসে। তবে তা একেবারেই মৌসুমভিত্তিক। বিশেষত ইলিশ, পোয়া, পাঙাস মাছের মৌসুমে প্রধানত বাজার বসে। তবে সে বাজারের পরিধি ততটা বিস্তৃত হয় না।

যতটা হয় ভোর রাতের বাজারে।  পানপট্টি ঘাটের মাছের বাজার কেন্দ্র করে সেখানে স্থায়ী বিভিন্ন ধরনের মাছের আড়ত পণ্যের বেশ বড়সড় বাজারও গড়ে উঠেছে। আড়তগুলো বেশিরভাগই দাদন মহাজনদের।

যারা জেলেদের আগাম অর্থ দিয়ে বুকিং করে রাখে। এর বিনিময়ে জেলেরা নদী থেকে ধরে আনা মাছ নির্দিষ্ট আড়তে দেয়। আড়তদাররা সে মাছ দেশের বিভিন্ন মোকামে পাঠায়। খাবারের হোটেল-রেস্তরাঁও গড়ে উঠেছে অনেক। এমনকি সেখানে পোশাকের দোকানও রয়েছে।

পানপট্টি ঘাটের মাছের বাজারটি এরইমধ্যে এক ধরনের ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। দিনে দিনে বেড়েছে এর জনপ্রিয়তা। বেড়েছে পরিচিতি। বাজার কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক লেনদেনের পরিধিও বেড়েছে। পানপট্টি ঘাটের মাছের বাজারের কিছু সমস্যাও রয়েছে।

আগুনমুখার উত্তাল ঢেউয়ে প্রতিবছরই বাজারের কিছু অংশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙন প্রতিরোধে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। তাই বাজার ক্রমে উত্তরে সরছে। যদি ভাঙন প্রতিরোধ করা যেত, তবে বাজারটি আরও গতিশীল হতো, বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

শংকর লাল দাশ, গলাচিপা, পটুয়াখালী

×