শাহী মসজিদ ও মির্জাপুর ইমামবাড়া
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যাকে বলা হয় অতীতের স্থাপত্য। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশে বেশ সমৃদ্ধ। এই বাংলার উত্তরাঞ্চলে রয়েছে অতীতের অসংখ্য স্থাপত্য। এর মধ্যে সর্বউত্তরের পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারি উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মাত্র দুইশ’ গজের মধ্যে রয়েছে মির্জাপুর শাহী মসজিদ ও মির্জাপুর ইমামবাড়া।
জনশ্রুতি রয়েছে, দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে শাহী মসজিদ ও ইমামবাড়া। শাহী মসজিদে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ খচিত মার্বেল পাথরের শৈল্পিক। আর ইমামবাড়াটি লাল পোড়ামাটির ইটের তৈরি। স্থানীয়রা জানায়, দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া এলে হিমালয় পর্বত, সমতলের চা বাগান, বাংলাবান্ধা পোর্টের পাশাপাশি শাহী মসজিদ ও ইমামবাড়া স্থাপনা এক নজর দেখতে ভুলে যান না। সড়কপথ, রেলপথ বা আকাশপথ এখন উত্তরাঞ্চলের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিকমানের যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নীত করা হয়েছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে পর্যটকরা অনায়াশে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনে ছুটে আসছেন।
শাহী মসজিদ ॥ ঐতিহাসিকদের অভিমত, মোগল আমলে নির্মিত ১৬৭৯ সালে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নির্মিত মসজিদের সঙ্গে পঞ্চগড়ের আটোয়ারির মির্জাপুর শাহী মসজিদের অনেকাংশে মিল খুঁজ পাওয়া যায়। তবে পঞ্চগড়ের কারও কারও ধারণা, মির্জাপুর গ্রামের মালিক উদ্দিন এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। কেউ কেউ মনে করেন, দোস্ত মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তবে মসজিদের শিলালিপি ঘেঁটে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন, ১৬৭৯ সালে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নির্মিত মসজিদটি নির্মাণের ২৩ বছর পূর্বে ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসক শাহ সুজার শাসনামলে মির্জাপুর শাহী মসজিদ গড়ে তোলা হয়।
তিন গম্বুজবিশিষ্ট মির্জাপুর শাহী মসজিদের দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট, প্রস্থ ২৫ ফুট। দেওয়ালে টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার বিভিন্ন খোদাই করা নকশা আছে, যা মূলত লাল ও সাদা রঙের কালি দিয়ে করা হয়েছে। মসজিদটির মূল আকর্ষণ গম্বুজের চার কোণের চারটি মিনার। সামনের দেওয়ালের দরজার দুই পাশে গম্বুজের সঙ্গে মিল রেখে দুটি মিনার দৃশ্যমান। মসজিদের দেওয়ালে কারুকাজ ও বিভিন্ন আকৃতির নকশা চোখে পড়ার মতো। দেওয়ালের চারপাশ ইসলামি টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার নকশায় অলঙ্কৃত। সামনের অংশের টেরাকোটাগুলো ভিন্ন ভিন্ন। ভেতরের দেওয়ালে বিভিন্ন রঙের খোদাই করা কারুকাজ ও বিভিন্ন ফুল, লতাপাতাসহ পবিত্র কুরআনের ক্যালিওগ্রাফি তুলির ছোঁয়ায় সজ্জিত। এগুলো দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে মুগ্ধ করে থাকে। স¤পূর্ণ মসজিদ তিন ফুট উঁচু দেওয়ালে ঘেরা। এতে প্রবেশের তিনটি বড় দরজা আছে। প্রধান দরজার ঠিক সামনেই একটি তোরণ। সেটি অতিক্রম করে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। প্রধান দরজার ঠিক উপরেই ফরাসি ভাষায় লিখিত কালো বর্ণের একটি ফলক ও ফলকের লিপি। ভাষা থেকে অনুমান করা যায়, মসজিদটি মোগল সম্রাট শাহ আলমের শাসনমালে নির্মিত। যা ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নির্মিত মসজিদের সঙ্গে এর অনেকাংশে মিল পাওয়া যায়। সেটিও মোগল আমলে নির্মিত। শাহী মসজিদের সামনের অংশে নামাজ পড়ার জন্য কিছু জায়গা রাখা হয়েছে। প্রায় ৩৬৩ বছরের পুরনো এই মসজিদে এখনো নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হয়।
ইমামবাড়া ॥ মসজিদের দুইশ’ গজের দক্ষিণ-পূর্বে মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মির্জাপুর গ্রামে অবস্থিত একটি প্রতাত্ত্বিক স্থাপনা। অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর এই ইমামবাড়াটি মির্জাপুর ইমামবাড়া এবং স্থানীয়ভাবে হোসেনী দালান নামেও পরিচিত। ঐতিহাসিক আটোয়ারি ইমামবাড়ার বয়স ৫০০ বছর অতিক্রম করেছে বলে স্থানীয়রা মনে করেন। ইমামবাড়া শব্দের আক্ষরিক অর্থ ইমামের বাড়ি। কিন্তু ইসলামিক স্থাপত্যকলায় ইমামবাড়া হলো শিয়া মিলনায়তন বা শিয়া মুসলিম সম্মেলন ভবন। মির্জাপুর গ্রামের স্থানীয়রা জানান, আটোয়ারি ইমামবাড়ায় এক সময় নামাজ আদায়, মিলাদ মাহফিল করা হতো।
লাল পোড়ামাটির ইটের তৈরি আটোয়ারি ইমামবাড়া এক গম্বুজবিশিষ্ট। আয়তাকার দক্ষিণমুখী ইমামবাড়ার মূল কক্ষের ভেতরে রয়েছে আরও একটি বর্গাকার ছোট কক্ষ, যার দরজা পূর্বমুখী। এই কক্ষের চারদিকে রয়েছে ১.৩৫ মি. প্রশস্থ বারান্দা। বারান্দার প্রতিটি দেওয়ালে অর্ধবৃত্তাকার খিলানযুক্ত ৩টি করে প্রবেশদ্বার এবং মূল কক্ষের বহির্দেওয়ালে ৪টি করে মোট ১৬টি কুলঙ্গি রয়েছে। ইমামবাড়ার প্রবেশপথে পূর্বদিকে একটি তোরণ এবং তোরণের ডানদিকে ৫টি বাঁধানো কবর রয়েছে। কবরগুলো সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য না থাকার কারণে কিছুটা রহস্যেরও জন্ম দেয়। ইমামবাড়াটির চারপাশে বেশ প্রশস্থ ও সমগ্র ইমামবাড়াটি ইটের নিচু প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত।