.
নওগাঁর সাপাহারে যাচ্ছি শুনে অনেকের ভ্রু-কুঁচকে গেল। কি আছে ওখানে? সাপাহারকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন আমের রাজধানী। এখানকার বরেন্দ্র ভূমি আমের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। আমের ভরা মৌসুমে এখানকার আমবাগানগুলো ঘুরে দেখা হবে দারুণ অভিজ্ঞতা। দুই দিনের এই সাপাহার ট্রিপের প্রথমদিন আমরা থাকব একটা এনজিওর রেস্টহাউজে। এই রেস্ট হাউজটার বিশেষত্ব হচ্ছে- এটা মাটির তৈরি। পরেরদিন থাকব প্রত্যন্ত একটা গ্রামে, আরেকটা মাটির তৈরি মেহমানখানায়। এছাড়া ঘুরে দেখব ঐতিহাসিক দিবর দীঘি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় সারা ফেলে দেওয়া ঘুঘুডাঙা তালের সা¤্রাজ্য।
শেষমেষ ৪ জন মিলে ঢাকা থেকে রাতের বাসে রওনা হয়ে পড়লাম। বাস যখন আমাদের সাপাহারে নামিয়ে দিল তখন সকাল ৭টা। এরপর একটা ভ্যানে চেপে আমরা আমাদের বুকিং করা রেস্টহাউজে গেলাম। আলোহা সোশ্যাল সার্ভিসেস- নামক একটা এনজিও গড়ে তুলেছে নান্দনিক একটা রেস্টহাউজ। যার নাম- তিলোত্তমা রিসোর্ট। তাদের এই ক্যাম্পাসের চারপাশটা আম বাগানে ঘেরা। আর তার মধ্যেখানে নিরিবিলি মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সুন্দর এই থাকার ব্যবস্থা। এই রেস্ট হাউজটার মূল বিশেষত্ব হচ্ছে- এটা মাটির তৈরি। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য মাটির বাড়ি মানুষের কাছে গরিবের এসি হিসেবে খ্যাতি রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখেই মাটির এই রিসোর্ট তৈরি করা হয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিকতা। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে তাই এটা রূপ নিয়েছে নান্দনিকতায়। এ রকম প্রত্যন্ত একটা অঞ্চলে এমন একটা থাকার জায়গা আপনাকে নিশ্চিতভাবেই মুগ্ধ করবে। আমরা ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে বের হলাম আম বাগান ঘুরতে। আমার এক পরিচিত ছোট ভাই হৃদয় তার বেশ কয়েকটা আম বাগান ঘুরিয়ে দেখালো। কত জাতের যে আম- আ¤্রপালি, ক্ষিরসাপাতি, ল্যাংড়া, সুরমা ফজলি, আশ্বিনা, গোপালভোগ- আরও অনেক নাম বলেছিল, ভুলে গেছি। বাগানের গাছ থেকে পেড়ে পাকা আম খাওয়ালো। আম গাছের ছায়ায় বসে অনেকক্ষণ গল্প-আড্ডা হলো।
উত্তরবঙ্গের পুড়ে ছারখার হওয়া গরমের কথা শুনেছি। এবার সাপাহারে এসে সেটা ভালোই টের পেয়েছি। তবে গরম ছাপিয়ে এখানকার চারপাশের গ্রামীণ প্রকৃতি আর সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করছে। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। রোদ পড়ে গেলে বিকেলে আমরা গেলাম দিবর দীঘিতে। এই দীঘিটা যেমন সুন্দর, তেমনি এর আলাদা একটা ঐতিহাসিক মর্যাদাও আছে। দীঘির মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিজয় স্তম্ভ, যেটা দীঘিটার শোভা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আকাশে উঠেছে ঝলমলে বিশাল এক পূর্ণিমার চাঁদ। সেই চাঁদের উথাল-পাথাল আলোয় বোটে করে আমরা দীঘিতে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। দীঘিতে ঘুরতে ঘুরতেই হৃদয় আর তার বন্ধুরা মিলে হঠাৎ প্ল্যান করে ফেললো- আজ রাতে পিকনিক হবে। দীঘি থেকে এসে একটা দোকানে মালাই চা খাচ্ছি আর আড্ডা দিচ্ছি। ওদিকে পিকনিকের আয়োজন চলছে মহাসমারোহে। রাত বারোটার দিকে রান্না-বান্না শেষ হলো। আমরা সবাই লাইন ধরে আমের আড়তের খড়ের ওপর বসে দেশী ঝাল মুরগি কষা, ডিম ভুনা আর সাদা ভাত দিয়ে বনভোজন পর্ব সারলাম। ওরা রাত ১টার দিকে বাইকে করে আমাদের রেস্টহাউজে নামিয়ে দিয়ে গেল।
বেশ সকাল সকাল আমরা ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। আগের দিনই একটা অটো ঠিক করে রেখেছিলাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে তিলোত্তমা রিসোর্টকে বিদায় জানিয়ে অটোতে রওনা করলাম পোরশার এক প্রত্যন্ত গ্রাম নোনাহারের পথে। যাওয়ার পথে রাস্তার দুধারে কেবলই আমবাগান। গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে আম। এখানকার মানুষের ঘরগুলো বেশিরভাগই মাটির তৈরি। সবমিলিয়ে, সাত-সকালে দুপাশের গ্রামীণ প্রকৃতি আর আমবাগান দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে বেশ রিফ্রেশিং লাগছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেকের অটো রাইড শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের আবাসস্থল- কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্টে। বরেন্দ্রভূমির হলুদাভ মাটি দিয়ে তৈরি বলেই হয়তো এর সৌন্দর্য যেন বেড়েছে কয়েকগুণ। এর আগেও মাটির তৈরি রেস্টহাউজে ছিলাম। তবে সেখানে আধুনিকতার একটা মিশেল ছিল। কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। এরা সচেতনভাবেই আধুনিকতা পরিহার করে গ্রাম্য একটা আবহ তৈরি করেছে। মাটির তৈরি কটেজগুলোর ছাদটা ছন আর বাঁশ দিয়ে বানানো। শহুরে দূষিত জীবনে চলতে চলতে মাঝে মধ্যে থামতে হয়। সেই বিরতিতে কোলাহলমুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে এমন কুঁড়েঘরে থাকা নিশ্চিতভাবেই একটা আদর্শ জায়গা। এখানকার এরা একে রিসোর্ট নাম দিলেও ভালোবেসে তারা কুঁড়েঘরকে বলে মেহমানখানা।
পাশেই রয়েছে তাদের বিশাল জায়গাজুড়ে এগ্রো প্রজেক্ট। খিচুড়ি, ডিম ভাজা, আলু ভর্তা আর ডাল ভর্তা দিয়ে আরেকদফা সকালের নাস্তা সেরে আমরা একটা ভ্যান নিয়ে পুরো প্রজেক্ট ঘুরে দেখলাম। এই প্রজেক্টের একটা সুন্দর নাম দিয়েছে তারা- প্রজেক্ট গ্রীনিফাই। যেখানে আছে বেশ কয়েকটা আমবাগান, আখক্ষেত, ড্রাগন ফলের আবাদ, নানারকম সবজির চাষাবাদ, এমনকি কফি চাষও করা হচ্ছে। এরপর গেলাম তাদের গরুর খামারে।
পর্যাপ্ত আলো বাতাস আর মুক্ত পরিবেশে গরুগুলো লালন-পালন করা হচ্ছে। খামারের প্রজেক্টটার নামটাও সুন্দর- প্রজেক্ট বর্গা। আমরা প্রজেক্ট ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে গেল। কটেজে ফিরে এসে আলুভর্তা, সবজি, দেশী মুরগি আর আম ডাল দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। বিকেলে রোদ পড়ে গেলে আমরা কুঁড়েঘরকে বিদায় জানিয়ে অটোতে করে রওনা হলাম নিয়ামতপুরের ঘুঘুডাঙায় অবস্থিত তালের স¤্রাজ্যের উদ্দেশ্যে। ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগলো পৌঁছাতে। প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে দুপাশে সারি সারি তালগাছ, মাঝখানে পিচঢালা রাস্তা, আশপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত- সবমিলিয়ে পুরো জায়গাটা অসাধারণ। শ্যামল বাংলার যে রূপের কথা বইয়ে পড়েছি, সেটাই যেন এখানে চোখের সামনে ধরা দেয়। পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলোয় আরও বেশি সুন্দর লাগছিল চারপাশটা। দুদিনের দারুণ ট্রিপটার যবনিকাটাও তাই চমৎকার হলো। সব মিলিয়ে, কাগজে-কলমে যখন এই অফবিট ট্রিপটার প্ল্যান করেছিলাম, তখন যা ভেবেছিলাম, বাস্তবে তার চেয়েও সুন্দর ছিল ট্রিপটা।