.
ইলিশ সুস্বাদু ও জনপ্রিয় মাছ। ইলিশ মাছ পছন্দ করে না, দেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর সেই ইলিশ যদি হয় গোয়ালন্দের পদ্মা নদীর তাহলে তো কারও কোনো কথা থাকে না। ব্রিটিশ আমল থেকে গোয়ালন্দের পদ্মা নদীর ইলিশের চাহিদা ছিল। এখনো চাহিদা সকলের কাছে প্রথম স্থানে রয়েছে। গোয়ালন্দ বাজার রেল স্টেশন থেকে একটি সময় প্রতিদিন ভারত বর্ষে ইলিশ রপ্তানি হতো।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পদ্মা ও গোয়ালন্দ তীরবর্তী গ্রামের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় ‘ফ্রম দ্য হুগলি টু দ্য হিমালয়াস’ গ্রন্থে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’র (১৯৩৫) প্রেক্ষাপট ছিল সে সময়কার গোয়ালন্দ। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্যসহ তৎকালীন গোয়ালন্দের রেল-স্টিমার, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জমজমাট শহর জীবনের কিছুটা আভাস পাওয়া যায় উপন্যাসটিতে।
অনুভবে হয়তো এখনো দেখা যায় খানিক দূরে একজোড়া উঁচু-নিচু ও প্রায় অকেজো লাইনের ওপর চার-পাঁচটা ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে। পেট ভর্তি মাছ নিয়ে যথাসময়ে ওয়াগনগুলো কলকাতায় পৌঁছাবে। সকাল-বিকাল বাজারে ইলিশ কিনে কলকাতার মানুষ বাড়ি ফিরছে। কলকাতার বাতাসে পদ্মার ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ।’ কলকাতায় মাছের বাজারের অপর উৎস ছিল লালগোলা ঘাট। তবে লালগোটা ঘাট থেকে আসা মাছের পরিমাণ গোয়ালন্দ থেকে রপ্তানিকৃত মাছের তুলনায় ছিল নিতান্তই নগণ্য। হয়তো অতিপরিচিত গোয়ালন্দের সেই ইলিশের ঘ্রাণ এখনো স্মৃতিতাড়িত করে কলকাতার প্রবীণদের। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর, ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এখানে চলাচল করেছিল। এরপর গোয়ালন্দ ঘাট রেল সংযোগ শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমান সেই পরিমাণ কাক্সিক্ষত ইলিশ পদ্মা নদীতে ধরা পড়ে না। জেলের জালে যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে তা অতি নগণ্য। এই জনপ্রিয় ইলিশ মাছ সাধারণ মানুষের কপালে না জুটলেও উচ্চাভিলাষীদের হাতের নাগালে থাকে। কারণ দাম আকাশছোঁয়া থাকার কারণে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটে না।
গোয়ালন্দের প্রবীণ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, গোয়ালন্দের ঐতিহ্য বহন করে পদ্মা নদীর ইলিশ। ইলিশ মাছ ছাড়া অতিথি আপ্যায়ন অসম্ভব ছিল। অতিথি আপ্যায়নে ইলিশ মাছের একাধিক আইটেম অবশ্যই থাকবে। ইলিশ ভাজা, শরিষা ইলিশ, ইলিশ কারি, লাউ ও কাঁচকলা দিয়ে ইলিশের ঝোল এবং ইলিশ মাছের ঝুড়ি। ইলিশ মাছের ডিম খেতেও খুব মজা ছিল। ইলিশ মাছ দিয়ে হাত চেটে-পুটে খাবারের মজা ছিল আলাদা। আত্মীয়স্বজন বাড়িতে ইলিশ মাছ নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার একটা রেওয়াজও প্রচলিত ছিল।
কালের ¯্রােতে গোয়ালন্দ পদ্মা নদীর সেই গভীরতা নেই। নেই পূর্বের মতো ¯্রােত। পূর্বের তুলনায় এখন ইলিশ নেই। সেই সুযোগে রাজবাড়ী জেলা এবং পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন অসাধু হোটেল ব্যবসায়ী চন্দনী ইলিশ ও চাঁদপুরের ইলিশ মাছ ‘গোয়ালন্দ পদ্মা নদীর ইলিশ মাছ’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ঘাটের দুই পাশের হোটেল ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ কাজে লাগানোর অপচেষ্টা করেন।
গোয়ালন্দের পদ্মা নদীতে যে সব জেলে মাছ ধরতো এবং সেই সময়ের কয়েকজন ইলিশ মাছ ব্যবসায়ীদের (সেই সময় তারা ছোট ছিল) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মা নদীতে এখন আগের মতো বড় ইলিশ ধরা পড়ে না। যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে তা অনেক দামে বিক্রি হয়। আগে জেলেরা এক বার নদীতে জাল ফেললে ২/৩ মণ ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। সেখানে এখন ২/৪ কেজি পাওয়া যায়।
ইলিশ মাছ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বয়স্ক এই ব্যক্তি গুলো আরও বলেন, একটি সময় নদীর পারের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ ইলিশ বিনামূল্যে দেওয়া হতো। এখন সেই পরিমাণ ইলিশ নদীতে পাওয়া যায় না। সুতরাং পদ্মার মাছের চাহিদা আগেও আকাশছোঁয়া ছিল। এখনো আকাশছোঁয়া রয়েছে। তবে ইলিশ মাছের দাম অনেক। বর্তমান গোয়ালন্দ পদ্মা নদীর ইলিশ দেড় কেজি এবং তার বেশি ওজনের মাছ ৪ হাজার টাকা কেজি। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ মাছ ২৫শ’ থেকে ৩হাজার টাকা কেজি। এক কেজির কিছু কম অর্থাৎ ৭/৮শত গ্রামের ইলিশ মাছ ১৫ থেকে ২২শত টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর চেয়ে ছোট মাছগুলো এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বয়স্কদের সঙ্গে একান্ত কথা বলে আরও জানা যায়, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ইলিশ মাছ কমতে শুরু করে। তবে বর্তমানে প্রজননের সময় নির্ধারণ করে প্রতিবছর ২২দিন ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ থাকে। যে কারণে এখন কিছুটা ইলিশ মাছ নদীতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে জেলেদের ভূমিকা বেশি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যায় তখন মৌসুমি জেলেরা অবাধে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ শিকার করে।
একাধিক জেলে বলেন, পদ্মা-যমুনা নদীর মিলনস্থল গোয়ালন্দ। যে কারণে এই নদীতে ইলিশসহ বড় মাছের সমাগম থাকে। এই নদীতে স্থানীয় জেলেরা ছাড়াও পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার জেলেরা মাছ ধরে। গোয়ালন্দের ৫৫টি, মানিকগঞ্জের ১৫টি, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চল থেকে ৩০টির মতো বড় নৌকা এ এলাকায় মাছ ধরতে আসে। সার ধরে প্রতিটি নৌকার জেলেরা মাছ ধরে। মাছ ধরা একটি নৌকায় ১০ থেকে ১৫ জন লোক লাগে।
গোয়ালন্দ পদ্মা নদীর ইলিশ মাছ ও নদীর বিভিন্ন মাছ বিক্রির জন্য দৌলতদিয়া পদ্মা নদীর পারে গড়ে উঠেছে মাছের আড়ত। সেখানে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত ইলিশ মাছসহ নদীর বিভিন্ন ছোট-বড় মাছ আমদানি-রপ্তানি হয়। এই বাজারে কোনো প্রকার পুকুর ও চাষের মাছ আমদানি-রপ্তানি হয় না। এই বাজার থেকে অনেকে মাছ নিয়ে অনলাইনে, ফেসবুক হোয়াসঅ্যাপের মাধ্যমে বিক্রি করে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দৌলতদিয়া বাজারের মাছ ক্রয় করেন। দৌলতদিয়া থেকে হোম ডেলিভারি দেওয়া হয়। দেশের বড় বড় ক্রেতার কাছে অতিপরিচিত ‘শাকিল-সোহান মৎস্য আড়তের’ কর্ণধার স¤্রাট শাজাহান। তার মাছের আড়ত দৌলতদিয়া ৫নং ফেরি ঘাট পদ্মা নদীর পাড়ে অবস্থিত। ‘শাকিল-সোহান মৎস্য আড়ত’ ছাড়াও দৌলতদিয়া ঘাটে পদ্মা নদীর পারে ১০টি ইলিশ, পাঙ্গাশ, কাতল, রুই, বোয়াল মাছসহ বড় বড় মাছের আড়ত গড়ে উঠেছে। এখানে নদীর সকল প্রকার ছোট মাছও পাওয়া যায়।
দৌলতদিয়া ঘাট বাজার ব্যবসায়ী পরিষদের সভাপতি মো. মোহন মন্ডল বলেন, চার দশক যাবত এই বাজারে পদ্মা নদীর ইলিশ মাছসহ বিভিন্ন প্রকার ছোট-বড় মাছ বিক্রি করেন। তিনি বলেন, এই বাজারে শত ভাগ পদ্মা নদীর মাছ পাওয়া যায়। এখানে দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে এসে সহজে মাছ ক্রয় করতে পারেন। এই বাজার থেকে অনেকে অনলাইনেও মাছ ক্রয় করতে পারেন।