ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

নোনাজলে রূপালী শস্য

শংকর লাল দাশ গলাচিপা, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ৯ আগস্ট ২০২৪

নোনাজলে রূপালী শস্য

.

বর্ষা যদি ঋতুর রাণী, তবে ইলিশ নিশ্চিত জলের শস্যইলিশের সঙ্গে বর্ষার রসায়ন অত্যন্ত গাঢ়একে অপরের ঘনিষ্ঠতা যথেষ্ট নিবিড়পূর্ব কিংবা দখিনা হাওয়ায় ভর করে আকাশ থেকে যখন নামে ঝুম বৃষ্টি তখনই সে বর্ষার জল পিঠে বয়ে গভীর সমুদ্র থেকে ঝাঁকেঝাঁকে উঠে আসে ইলিশসমুদ্রের নোনাজলে ডুব সাঁতারে মনের আনন্দে চলে ইলিশের নাচানাচিইলিশ যত এগোয়, ততই তার শরীর থেকে ঝরে লবণ আর আয়োডিনশত মাইল জলের পথ পাড়ি দিয়ে ইলিশ যখন মোহনা কিংবা গাঙে পৌঁছায়, তখন তার মেদ ঝরে নধরকান্তি দেহে অপূর্ব দ্যুতি ছড়ায়জেলের জালের ফেঁসে গেলে বাঙালির পাতে ইলিশ হয় তুলনাহীনতাইতো ইলিশ হয় মাছের রাজা

বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশাল অংশজুড়ে আছে বর্ষার ইলিশদ্বাদশ শতকের বিখ্যাত প-িত জীমূতবাহন সর্বপ্রথম ইলিশ মাছের নাম উল্লেখ করেছেনসেই সময়ের সর্বানন্দের টিকাসর্বস্ব গ্রন্থেও ইল্লিষশব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়পঞ্চদশ শতকের কবি বিজয়গুপ্ত তার মনসামঙ্গল কাব্যের জন্য জগদ্বিবিখ্যাত হয়ে আছেনসেই মনসামঙ্গলে বিজয়গুপ্ত লখিন্দর জন্মাবার আগে সনখার সাধ ভক্ষণে নানাবিধ পদের সঙ্গে দিয়েছেন দক্ষিণ সাগর কলা দিয়ে ইলিশের ঝোল রান্নার বর্ণনা

তিনি লিখেছেন, ‘আনিয়া ইলিশ মতস্য/ করিল ফালাফালা/তাহা দিয়ে রাঁধে ব্যঞ্জন/ দক্ষিণসাগর কলা

ব্রিটিশ গবেষক হ্যামিল্টন বুকানন ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে গবেষণার সময়ে হিলসামাছের নাম উল্লেখ করেনযা পরবর্তীতে হিলসা, ইল্লিশ ও ইলীষা একাকার হয়ে ইলিশে রূপ নেয়ইলিশ হয় জলের অধিপতি বা ঈশ্বরসন্ধিবিচ্ছেদেও তাইঅর্থা জলের অধিপতি বা ঈশ্বরসাহিত্য সংস্কৃতির পাশাপাশি আর এখনতো ইলিশ আমাদের ভৌগোলিক পণ্যের গৌরবের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে

ইলিশের আনাগোনা বছরজুড়ে হলেও মূলত রূপরস বর্ণগন্ধ ও স্বাদে বর্ষার ইলিশ অনন্যবর্ষার ইলিশের জন্যই বাঙালির যত হাপিত্যেশবৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের মধ্যে যুবতী ইলিশের পেটে ডিম আসতে শুরু করেপেট ভরা সে ডিম নিয়ে যুবতী ইলিশ পাড়ি দেয় সাগরমিষ্টি জলে ডিম দেওয়া ইলিশের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসে হিসেবে ইলিশ পরিযায়ী মাছডিম দেওয়ার সময় ছাড়া ইলিশ আদৌ উপকূলে আসতে চায় নাসাগরের গভীরে বিচরণে তার আনন্দসে হিসেবে আবার মৌসুমি শস্যও বটেসাগরের গভীর জলে ইলিশের প্রধান খাদ্য জলজ শ্যাওলাএতেই সে পুষ্ট হয়দেহ ভারি হয়রূপ লাবণ্যে অপরূপ হয়

বর্ষার ইলিশ ধরায় ভিন্ন ধরনের আনন্দ আছেআবেগ আছেবাণিজ্য আছেতাইতো বর্ষা আসার আগেই উপকূলের জেলেদের মাঝে সাড়া পড়েনৌকা তৈরির ধুম পড়েকাঠমেস্তরীদের ব্যস্ততা বাড়েঘাটে ঘাটে নৌকা তৈরির কারখানা গড়ে ওঠেএকটা সময়ে বৈঠার নৌকা তৈরি হতোবাদাম তোলা লম্বা সে নৌকাসুতার জালসময় পাল্টেছেকাল পাল্টেছেমাছ ধরার কৌশলে পরিবর্তন এসেছেপুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছেপ্রথমে ছিল ইঞ্জিনের নৌকাশ্যালো মেশিন বসিয়ে নৌকার গতি আনা হতপরে এসেছে ট্রলারআর এখন ফিশিংবোটআকার আয়তনে বিশালনায়লনের জালবোটের তলায় গুদামশত শত মণ বরফের পাহাড়

আগে উপকূলের গাঁ-গেরামের সম্পন্ন গেরস্তদের ভেতরেও সৌখিন ইলিশ শিকারি ছিলএখন নেইএখন সবটাই বাণিজ্যতবে এতকিছু পাল্টে গেলেও ইলিশ ধরার মৌসুমে আসেনি পরিবর্তনকালের ধারা বেয়ে এখনো সেই বর্ষার ইলিশ

সাগরে যখন বর্ষা নামেতখন চারপাশে আঁধার নামেঘন কুয়াশার আস্তর পড়েচোখ সয়ে যায়আসে জোয়ার-ভাটার ঢেউউত্থালপাতাল জলের দোলাভরা গাঙসমুদ্রে কলার মোচার মতো দোলে ইলিশের নৌকা-ট্রলারএরমধ্যে চলে ইলিশ ধরাপাকা শিকারির চোখ জেলেদেরসমুদ্রের কোথায় ইলিশের ঝাঁক, তার নাড়ি নক্ষত্র জহুরির চোখে জেলেরা পরখ করেনৌকার খোল ভরে ওঠেরূপালি শরীরের ইলিশের ঝিলিক ওঠেমানিক বন্দোপাধ্যায় তার পদ্মা নদীর মাঝিতে ইলিশ ধরার বর্ণনা তাই যথার্থভাবে তুলে ধরেছেনতিনি লিখেছেন, ‘পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মৌসুম চলিতেছেনৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছলণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করেমাছের চোখগুলোকে স্বচ্ছ নীলাভ চোখের মণির মতো দেখায়

ষড়ঋতুর এই দেশে বর্ষার রূপের সঙ্গে সাগর-গাঙে ইলিশ ধরা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছেইলশেগুঁড়ি হোক কিংবা ভারি বর্ষণবর্ষায় যেন ইলিশ টগবগিয়ে ওঠেজেলেদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটেইলিশের স্বাদ বাড়েদাম যাই হোকইলিশের গালে আঙুল ঢুকিয়ে তা নিয়ে বাড়ি ফেরা যেন বাঙালির বর্ষার চিরকালীন অনন্য রূপদাম প্রসঙ্গে তাইতো ময়মনসিংহ গীতিকায় মাছের রাজা ইলিশের চিত্র ফুটে উঠেছে এভাবে, ‘সেই ইলিশের দাম হইল সোনায় একুশ ভড়ি মাছ ইলিশারেআর বর্ষা নিয়ে ইলশেগুঁড়িকবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ‘ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি ইলিশ মাছের ডিম, ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি দিনের বেলায় হিম

 

×