.
তখন আকাশে চলছে রোদ আর মেঘের খেলা। কখনো সূর্য উঁকি দিচ্ছে, আবার বিশাল মেঘের ভেলায় সূর্য মুখ লুকাচ্ছে। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল। অপরূপ হয়ে উঠল তেঁতুলিয়া নদী। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় নদীর পানিতে ডেউ তুলছে। এর মধ্যে মিলন গাজী (৪২) ও হাসান (৩৬) গাজী নামের দুই জেলে জাল টেনে নৌকায় তুলছেন। পুরো জাল তুলতে তাদের ১৫-২০ মিনিট সময় লেগে যায়। কিন্তু যে আশায় তারা নদীতে জাল ফেলেছিলেন সেই আশা আর পূরণ হয়নি।
তাদের জালে শিকার হয়নি একটিও ইলিশ মাছ। ইলিশ শিকারের আশায় তারা তেঁতুলিয়া নদীর নিমদি পয়েন্টে জাল ফেলেছিলেন। দিনের প্রথম জোয়ারে তারা জাল ফেলেন আর প্রথম ভাটায় তারা জাল তুলেন। মধ্যে ৬-৭ ঘণ্টা অপেক্ষার পর জাল তুলে ইলিশ মেলেনি। মিলন ও হাসান গাজির বাড়ি তেঁতুলিয়া নদীর তীরবর্তী গ্রামে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বহ করেন তারা। একসময় বর্ষা মৌসুমে তেঁতুলিয়া নদীতে জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পরলেও গত ৫-৬ বছরে আশানুরূপ তাদের জালে ইলিশ ধরা পরছে না।
জেলে হাসান গাজী জানান, তেঁতুলিয়া নদী যৌবন হারানোর কারণে ইলিশের বিচরণ কমে গেছে। নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে চর জাগায় ইলিশের গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। তার ভাষ্যমতে এক সময়ে এ নদীতে ৫ হাজারের অধিক জেলে মাছ শিকার করত। এখন অধিকাংশ জেলে এ পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আর যারা এখন এ পেশায় আছেন তাদের দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। মহাজনদের কাছ থেকে টাকা এনে জাল ও নৌকা ক্রয় করেছেন। মাছ বিক্রি করে সেই টাকা শোধ করতে হয় তাদের। আশানুরূপ ইলিশ শিকার করতে না পারায় তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পরেছে। শ্রাবণের রোদ, আর মেঘের লুকোচুরি মতো তাদের জীবনেও চলে লুকোচুরির খেলা।
ধুলিয়া গ্রামে মাহাবুব সিকাদার নামের এক জেলে জানান, তেঁতুলিয়া নদীতে যে পরিমাণ ইলিশ শিকার করা হয় তার প্রায় সবটাই আড়তদারের মাধ্যমে ঢাকায় চলে যায়। তেঁতুলিয়া নদী মিঠা পানির নদী হওয়ায় ইলিশের স্বাদ অন্য সব নদী বা সাগরে শিকার করার ইলিশের স্বাদের চেয়ে ভিন্ন। তাই এ নদীর ইলিশের ঢাকায় কদর বেশি। যখন প্রচুর পরিমাণ ইলিশ শিকার করা হতো তখন ঢাকার বাইরে বরিশাল, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জে মাছ পাঠানো হতো। এখন আগের মতো ইলিশ মাছ ধরা না পরায় ওইসব এলাকায় মাছ পাঠানো হয় না।
মমিনপুর গ্রামের আবদুল করিম নামের এক জেলে জানান, তেঁতুলিয়া নদী থেকে শিকার করা এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ টাকায় আড়তে বিক্রি হয়। ৫শ’ থেকে ৭শ’ বা ৮শ’ গ্রামের ওজনের মাছ ১২শ’ থেকে ১৪শ’ টাকায় বিক্রি হয়। বাজার থেকে আরও বেশি দামে কিনতে হয়।
বাউফলে পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলনকর্মী ও সেভ দ্য বার্ড অ্যান্ড বির পরিচালক এম এ বশার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অবৈধ বাধা জাল, কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জালে ইলিশের পোনা নিধনসহ তেঁতুলিয়া নদীতে অসংখ্য চর জেগে ওঠায় প্রজননকালীন সময় সাগর থেকে মা ইলিশ তেঁতুলিয়া নদীতে আসতে পারে না। এর ফলে ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে।
তেঁতুলিয়া নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ জানালেন বাউফল উপজেলা সিনিয়ার মৎস্য কর্মকর্তা মাহাবুব আলম তালুকদার। তিনি বলেন, জেলেদের অসচেতনতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও তেঁতুলিয়া নদীর বিভিন্ন মোহনায় চর পরে ভরাট হয়ে যাওয়ায় গতি পরিবর্তনের কারণে ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। আর তেঁতুলিয়া নদীতে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে প্রজননকালীন সময় মা ইলিশ শিকারে অবৈধ জালের ব্যবহার বন্ধ ও ড্রেজারের দিয়ে ভরাটকৃত মোহনা খনন করা হলে অবাদে ইলিশ বিচরণ করবে। আর তাতেই ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।