.
অনুবাদ : মাহিয়ান ফারদিন
অনেকদিন আগের কথা। এক ছিল সিপাহী যে তার দেশের জন্য দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সে মারাত্মক আহত হয়। ফলে সে যুদ্ধ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে।
রাজা বললেন, ‘সিপাহী, তুমি দীর্ঘদিন দেশের সেবা করেছ। কিন্তু এখন সেনাবাহিনী থেকে তোমাকে অপসারণ করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ কেবল সুস্থ ব্যক্তিরাই সেনাবাহিনীর জন্য উপযুক্ত।’ এতে সিপাহী মারাত্মক কষ্ট পেল। সে ভাবলÑ আমি দেশের নিরাপত্তার জন্য রক্ত দিয়েছি। তার বিনিময় এভাবে দেওয়া হলো!
সিপাহী কষ্টের সঙ্গে প্রাসাদ থেকে বিদায় নেয়। সে কিভাবে জীবিকা উপার্জন করবে? যুদ্ধ বাদে অন্য কোনো কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না তার। সিপাহী কয়েকদিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।
একদিন কিছুটা দূরে আলো দেখতে পান। সেটা ছিল একটা জাদুকরের বাড়ি। কিন্তু সিপাহী তা জানত না। সে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ছিল। তাই দরজায় কড়া নেড়ে বলল, ‘আপনি কি আমার জন্য কিছু খাবার ও রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে পারবেন?’
জাদুকর জবাব দিল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু তার জন্য তোমাকে কাজ করতে হবে।’
সিপাহী যেকোনো ধরনের কাজ করতে রাজি হলো।
জাদুকর বলল, ‘আমার বাগানের চারদিকে পরিখা খনন কর। সূর্যাস্তের আগেই কাজ শেষ করতে হবে।’
সিপাহী সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করল। কিন্তু কাজ শেষ করতে পারল না। তবু জাদুকর তাকে খাবার ও রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। কিন্তু পরদিন যথেষ্ট পরিমাণ কাঠ কাটতে না পারলে সিপাহীকে বের করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দিল।
সিপাহী সর্বোচ্চ চেষ্টা করার প্রতিজ্ঞা করে। পরদিন সে প্রকা- একটি গাছের গুঁড়ি কাটে। জাদুকর এতে খুশি হলো খুব। সিপাহী আরও এক রাত থাকার অনুমতি পেল।
পরদিন ভোরে জাদুকর তাকে একটি পুরনো কুয়ার কাছে নিয়ে বলল, ‘কুয়ার নিচে একটি নীল বাতি আছে। যেটা একদিন কুয়াতে পড়ে গিয়েছিল। বয়সের জন্য আমি সেটা উঠাতে পারিনি।’
সিপাহী রাজি হলে জাদুকর তাকে দড়িতে বেঁধে কুয়ার নিচে নামায়। সিপাহী নিচে গিয়ে বাতিটি তার পকেটে ভরে নেয়। জাদুকর দড়ি টেনে তাকে উপরে উঠিয়ে আনে। সিপাহী উঁচুতে এলে জাদুকর তার হাতে বাতিটি দিতে বলে। সিপাহী রেগে বলে, ‘আগে আমাকে কুয়া থেকে বের কর। না হলে আমি বাতি দিব না।’
জাদুকর ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘আসলেই! এখনই বাতি না দিলে তোকে কুয়াতে ফেলে দেব। সেখানেই পচে মরবি।’
সিপাহী তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমি এখন পর্যন্ত তোমার কথামতো সব কাজ করেছি।’
জাদুকর দড়ি ছেড়ে দেয়। সিপাহী কুয়ার নিচে পড়ে যায়। সে হতবাক হয়ে বসে থাকে। তার হাতের কাছেই নীল বাতিটি জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে। ধোঁয়া বের হতেই সেখানে বামুন আকৃতির দৈত্য সৃষ্টি হয়। দৈত্যটি সিপাহীকে কুর্নিশ করে বলে, ‘আপনার জন্য কী করতে পারি জনাব?’
সিপাহী হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’
দৈত্য উত্তর দিল, ‘আমি কুপিতে থাকা বামন দৈত্য। আমি আপনার ইচ্ছে পূরণ করতে পারব।’
সিপাহী বলল, ‘তাহলে আমাকে কুয়া থেকে বের হতে সাহায্য কর।’
দৈত্যটি তাকে একটি সুড়ঙ্গের মাঝে নিয়ে গেল। সেখানে প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণের স্তূপ ছিল। সিপাহী পকেট ভর্তি করে স্বর্ণ নিতে লাগল। জঙ্গলে পৌঁছে দৈত্যকে বলল, ‘জাদুকরকে বিচারকের কাছে নিয়ে যাও। তার যেন ফাঁসি হয় সেই ব্যবস্থা কর।’
দৈত্যটি বলল, ‘আপনার জন্য আর কিছু করতে পারি?’
সিপাহী বলল, ‘আপাতত না।’
‘আপনার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে নীল বাতিটি জ্বালাবেন। তাহলেই আমি হাজির হব’, বলল দৈত্য। তারপর সিপাহীকে সালাম জানিয়ে চোখের পলকে দৈত্যটি উধাও হয়ে গেল।
সিপাহী অত্যন্ত খুশি হয়ে শহরের সবচেয়ে ভালো হোটেলে যায়। সেখানে অনেক বড় একটি রুম ভাড়া নিয়ে দামি খাবার খায়। এরপর সে অনেক সুন্দর পোশাক কিনে আনে। মনে মনে বলে, এখন আমি রাজার উপর প্রতিশোধ নিতে পারব। সে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল।
একদিন সে দৈত্যটিকে ডেকে বলে, ‘তুমি আজ রাতে প্রাসাদ থেকে রাজকুমারীকে এখানে নিয়ে আসবে। তবে ভোরের আগেই তাকে ফেরত দিয়ে আসতে হবে।’
দৈত্য ঘুমন্ত রাজকুমারীকে সিপাহীর কক্ষে নিয়ে আসে। সিপাহী রাজকুমারীর ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করার জন্য নির্দেশ দেয়। এরপর বিছানা পরিষ্কার করে জুতা পালিশ করতে বলে।
রাজকুমারী আধো ঘুমের মাঝেই সব কাজ করে। সে আতঙ্কিত ছিল। ভেবেছিল সে স্বপ্ন দেখছে। ভোরের আগেই দৈত্য রাজকুমারীকে প্রাসাদে রেখে আসে। সকালে রাজকুমারীর ঘুম ভাঙলে সে রাজার কাছে বলে, ‘আজ রাতে আমি খুব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি।’ রাজকুমারী রাতে কি কি হয়েছিল সব জানায়। বলে, ‘আমি ভেবেছিলাম সব স্বপ্ন। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে আমার হাত-পা ব্যথা করছে। আমার কাপড়ের ময়লা লেগে আছে।’
রাজা হুংকার দিয়ে বলল, ‘আমার মেয়েকে দিয়ে কে কাজ করিয়েছে- তাকে আমি খুঁজে বের করব।’ তিনি রাজকুমারীর পকেটে ছোট ছিদ্র করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমার পকেটে মটরদানা ভরে রাখবে। এতে করে রাজকুমারীকে কেউ নিয়ে গেলে খুঁজে বের করা সহজ হবে।’ কিন্তু দৈত্য রাজার পরিকল্পনা শুনে ফেলে। সে শহরের প্রতিটি রাস্তায় মটরদানা ছড়িয়ে দেয়।
পরদিন সকালে রাজার লোকেরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। রাজা বুঝতে পারল রাজকুমারীকে অপহরণকারী কোনোভাবে তার কথা শুনে ফেলছে। তাই রাজা একটি চিঠি লিখে মেয়েকে দেন। রাজা বলেন, ‘যে তোমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবে- তার খাটের নিচে তোমার একটি জুতা রেখে আসবে। পরে তোমার জুতা পাওয়া গেলে ঘাতককে আমরা ধরতে পারব।’
সে রাতে রাজকুমারী সিপাহীর খাটের নিচে জুতা রেখে আসে। পরদিন সে আটক হয়। হঠাৎ করে ধরা খাওয়ায় সিপাহী নীল বাতিটি নিতে ভুলে যায়। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন তার ফাঁসি দেওয়া হবে।
সৌভাগ্যবশত, কারাগারের প্রহরী ছিল সিপাহীর পুরনো বন্ধু। সাহায্য করার জন্য সে প্রহরীকে অনুরোধ করে। প্রহরী তাকে বাতিটি এনে দেয়। পরদিন ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার পূর্বে সিপাহীর শেষ ইচ্ছে পূরণ করার অনুমতি দেন রাজা। সিপাহী বলল, ‘আমি নীল বাতিটি জ্বালাতে চাই।’
বাতির ধোঁয়া বের হতেই দৈত্যটি ভয়ানক চেহারা নিয়ে হাজির হয়। তার হাতে একটি বিশালাকৃতির মুগুর ছিল। দৈত্যটি প্রথমে সিপাহীকে খুলে মুগুর ঘোরাতে থাকে। বেশ কয়েকজনের মাথা ফেটে যায়। অনেকে আহত হয়। রাজার সৈন্যরা আতঙ্কে চিৎকার শুরু করে। বাকিরা পালিয়ে যায়।
রাজা ভীত হয়ে সিপাহীর কাছে ক্ষমা চায়। রাজা বলেন, ‘তুমি চাইলে আমার রাজ্যের অর্ধেক তোমাকে দিয়ে দিব। রাজকুমারীর সঙ্গেও তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করব।’
এরপর সিপাহী রাজ্যের পাশাপাশি রাজকুমারীকেও পায়। আর কোনো প্রয়োজন হলেই নীল বাতিটি জ্বালায়।
গ্রিন্সের রূপকথা