ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের শিশু-কিশোর চরিত্র

নাফিস রাইয়ান

প্রকাশিত: ২২:২৪, ৯ আগস্ট ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের শিশু-কিশোর চরিত্র

.

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরছোটবেলায় এই কবিতার শিরোনাম আর কবিগুরুর নামের শেষের অন্ত্যমিলের কারণে অন্যরকম একটা মজা পেতামতখনকার দিনে আমরা কবিতা পড়তাম মাথা দুলিয়ে, শরীর নাড়িয়ে টেনে টেনে উঁচু আওয়াজেসেসময় এই কবিতাটি পড়তে গিয়ে অদ্ভুত একটা মজা পেতামকবির নাম আর কবিতার নাম যেন আলাদা করতে পারতাম না! মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে তোমাদের আরেকটি কবিতার কথা মনে করিয়ে দিই- ওই যে সেই ছেলেটা, যার কিনা বড় হয়ে মাঝি হওয়ার শখ! মনে পড়েছে? হ্যাঁ, ‘মাঝিকবিতার কথাই বলছিমা, যদি হও রাজি,/ বড় হলে আমি হব/ খেয়াঘাটের মাঝি

ইশ, আমাদের শৈশব রাঙাতে কি সুন্দর সব কবিতাই না লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ; প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরগেল ৭ আগস্ট ছিল তার মৃত্যুবার্ষিকীজন্মেছিলেন ৭ মে ১৮৬১ সালে, বাংলা সনের হিসেবে ২৫ বৈশাখ ১২৬৮

কবি জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন- ‘আমাদের এক চাকর ছিল, তাহার নাম শ্যামশ্যামবর্ণ দোহারা বালক, মাথায় লম্বা চুল, খুলনা জেলায় তাহার বাড়িসে আমাকে ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসাইয়া আমার চারদিকে খড়ি দিয়া গন্ডি কাটিয়া দিতগম্ভীর মুখ করিয়া তর্জনি তুলিয়া বলিয়া যাইত, গন্ডির বাহিরে গেলে বিষম বিপদ

বন্দিশিশুর মন কি শিকল পরে? সে বাহ্য বন্ধন ছিন্ন করে মুক্তি খোঁজেকতভাবেই না কবি এই মুক্তির কথা বলেছেনকয়েকটি গানের চরণ থেকে পরিণত বয়সে ব্যক্ত সে আকুতি ও প্রত্যয় জানা যাক-

কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে?

মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা- মনে মনে

কিংবা, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,

আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে

অথবা, ‘ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি,

যা উড়ে যা উড়ে, যা রে একাকী

ছোটদের জীবনে তো চাই মুক্তির আনন্দ, অসীম স্বাধীনতাকিন্তু সংসারে কেবল বাধা, কেবল বন্ধন, কেবলই নিষেধের নিগড়তাঁর ছোটগল্পে অনেকগুলো শিশুচরিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়তারা প্রায় সব্বাই আমাদের মনের বেদনার তন্ত্রীটিতে ঘা দিয়ে যায়কতভাবেই না তাদের বড় হওয়ার পরিবেশটা মাঠে মারা যায়, তা বড়রা বুঝতেই চায় নাআশুর কথা মনে পড়ে? গিন্নি গল্পের নায়ক আশুতোষএকটু গোবেচারা ভালোমানুষ শিশুটি চালাকি জানে নাসংসারে অনেক গুরুজন চালাকচতুর, স্মার্ট বালকের প্রতি প্রশ্রয়প্রবণ হলেও শান্তশিষ্ট গোবেচারাদের ক্ষেত্রে হন কঠোরশান্তভাবে তাদের চূড়ান্ত অসহায়তার প্রকাশ ঘটে, আর তাতে শিক্ষকের প্রতাপ জাহির হয় বাঁধভাঙা নিষ্ঠুরতায়কখনো কখনো প্রহারের চেয়ে তির্যক মন্তব্য ও বিদ্র-পবাণী দুঃসহ যন্ত্রণা দেয়আশুর ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেছিল শিবনাথ পন্ডিতের হাতে

আশু পরিপাটি হয়ে স্কুলে আসতবাড়ির দাসী দুপুরে রেকাবি সাজিয়ে টিফিন আনতএতে আশু যে বাড়ির যত্নে থাকা গৃহপালিত সুবোধ প্রাণী, তা-ই যেন ফুটে উঠত পন্ডিতমশাই ও অন্য অনেকের ব্যবহারেতাই, এ ছিল তার জন্য বিব্রতকর এক অবস্থাএসব মিলিয়ে পন্ডিতমশাই এই শান্ত বালকটিকে পরিহাসের পাত্র বানিয়ে যথেচ্ছ উত্ত্যক্ত করতেনএক ছুটির দিনে আশু ছোটবোনের সঙ্গে গ্যারেজে পুতুল খেলছিলএমন সময় আকস্মিকভাবে বৃষ্টির উপাতপথচারীদের কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছেন সেখানেসেদিন ছিল ওদের পুতুলের বিয়েমিছেমিছি-খাবারের আয়োজন চলছেএকসময় বিয়ের লগ্ন এল, পুরোহিত পাবে কোথায়? ছোটবোন তো নেহায়ে শিশু, ছুটে গিয়ে বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে ছাতা গুটিয়ে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোককে হাত ধরে ডেকে পুরোহিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানাল

দূর থেকে আশু দেখল এ যে প-িতমশাইদেখেই তো তার আত্মারাম খাঁচাছাড়াছুটে পালালখেলা ভন্ডুল হয়ে গেলতখনকার মতো পরিত্রাণ মিললেও শেষরক্ষা হলো নাপরের দিন স্কুলে যেতেই পন্ডিতমশাই ওকে দেখিয়ে অন্য ছাত্রদের বললেন, গিন্নি এসেছেতারপর রসিয়ে রসিয়ে আগের দিনের ঘটনাটা ভেঙে বললেনপন্ডিত মশাইয়ের প্রশ্রয়ে বাকিরা এই সুবোধ শান্ত বালকের পেছনে লাগল গিন্নি গিন্নি রব তুলে

তখন তার মনের অবস্থাটা কেমন হয়েছিল?- ‘পৃথিবীর সমস্ত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সবলে বালককে নিচের দিকে টানিতে লাগিলকিন্তু ক্ষুদ্র আশু সেই বেঞ্চির উপর হইতে একখানি কোঁচা ও দুইখানি পা ঝুলাইয়া ক্লাসের সকল বালকের লক্ষ্যস্থল হইয়া বসিয়া রহিলএতদিনে আশুর অনেক বয়স হইয়া থাকিবেতাহার জীবনে অনেক গুরুতর দুঃখলজ্জার দিন আসিয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই দিনকার বালক হৃদয়ের ইতিহাসের সহিত কোনোদিনের তুলনা হইতে পারে না

ছুটি গল্পের ফটিক ছিল পিতৃহীনদরিদ্র পরিবারে বিধবা মায়ের পক্ষে ঠিকমতো শৈশবের পরিচর্যা করাও সম্ভব হয়নিসে হয়ে উঠেছিল দস্যিছেলে, গাঁয়ের সমবয়সী ও ছোটদের দুষ্টুমির দলপতিদুষ্টুমির জন্য নালিশ আসত বাড়িতেমায়ের তিরস্কার জুটত কপালেযতেœর অভাবে পড়ালেখাতেও পিছিয়ে পড়ছিল সেওকে কেমন করে বড় করবেন, এ নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়ছিল দিন দিনএমন সময় ওদের বড় মামা এসে হাজিরতিনি বোনের কষ্ট দেখে ফটিককে নিয়ে গেলেন নিজের কাছেউদ্দেশ্য, পড়ালেখা করিয়ে মানুষ করে দেবেনকিন্তু কপালটা বড় মন্দ ফটিকেরমামিমা কিছুতেই ওকে ভালোভাবে নিলেন নাভাবলেন, বাড়িতে একটা আপদ এলোকথাবার্তা আচার-আচরণে সে মনোভাব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন

ফটিক দুষ্টু ছিল বটে, কিন্তু খারাপ ছিল নাসে চেষ্টা করল প্রাণপণ মাসির মন জুগিয়ে চলতেকিন্তু ওঁর মন টলে নানিজের সন্তানের জন্য অগাধ স্নেহ, প্রশ্রয়কিন্তু পরের ছেলের জন্যে হৃদয়টি পাষাণ তাঁরএমন সময়ে জ্বরে পড়ল ফটিকঘোর জ্বরবেঁহুশ প্রায় জ্বরেজ্বরের বিকারে সে মায়ের কাছে যাওয়ার বায়না ধরেছেজাহাজে করে বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখছেজাহাজের খালাসির মতো সুর করে বলতে থাকে-

এক বাঁও মেলে নাদো বাঁও মেলে-এ-এ-না

খবর পেয়ে ওর মা আসতে আসতে ওর শেষ অবস্থাএই আমাদের সমাজবিনা দোষে একটা শিশু তার শৈশবের আনন্দ হারায়, জীবন গড়ার সুযোগ হারায়, এমনকি নিষ্ঠুর বাস্তবতার দৌরাত্ম্যে শেষ পর্যন্ত জীবনও হারায়অতিথি গল্পের তারাপদ আবার অন্যরকম ছেলেভারি সুন্দর, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়খুব গুণী, গাইতে পারে ভালো, চট করে যে কোনো কাজ শিখে ফেলে, এমনকি রান্না পর্যন্তপুঁথি পড়ে চমকারবড়দের মন জয় করতে ওস্তাদমানুষকে মায়ায় বাঁধে অনায়াসে, আর মানুষ ওকে ভালোবাসায় বাঁধে অন্তরের টানেকিন্তু ওর ভেতরে একটা মন আছে বড্ড উদাসিএক জায়গায়, এক পরিবেশে বেশিদিন মন টেকে নানিজের মতো চলে বেড়ায়এমন ছেলে তারাপদকে ভালো না লেগে পারা যায় না

আরও অনেক শিশু চরিত্রের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথতাঁর সাহিত্যকর্মে এবং বিশ্বসাহিত্যের ভান্ডারে এরা অতুলনীয় মানুষওদের সঙ্গে পরিচয়টা ঝালিয়ে নেওয়া শুধু শিশুকিশোর নয়, সবারই দরকার

×