ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

 ছেলেবেলা রাঙানো রুশ সাহিত্য

মোস্তফা মাহাথির

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২৬ জুলাই ২০২৪

 ছেলেবেলা রাঙানো রুশ সাহিত্য

.

অনুবাদের কথা এলে প্রথমেই যার নাম মনে পড়ে তিনি ননী ভৌমিক। তার অনুবাদে প্রথম যে বইটি পড়ি তা হলোউভচর মানুষ রুশ সাহিত্যিক আলেকজান্দার বেলায়েভ রচিত বইটি পড়তে পড়তে লেখকের কল্পনার শক্তি সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়েছিলাম। বইটি পড়ার সময় নিজের ভেতরও নানারকম চিন্তা ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। সেসব বিষয় অনেকের সঙ্গে শেয়ারও করেছি। অনেককে বলেছি, মেরী শেলীর ফ্রাঙ্কস্টাইনের পর পৃথিবীতে যতগুলো কালজয়ী বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে তার মধ্যে বেলায়েভের এই বইটিও থাকবে।

অনুবাদকে বলা হয়- ‘দ্বিতীয় সৃষ্টি ভিনভাষার ভালো বইটি পড়ে মজা পাওয়া যাবে তখনই- যখন এর অনুবাদটাও ভালো হবে। ননী ভৌমিক ঠিক এই কাজটিই করেছেন; অর্থাৎ ভালো অনুবাদ করেছেন পাঠকদের জন্য। বাঙালি শিশু কিশোরদের ছেলেবেলা রাঙানো অনেক রুশ সাহিত্যের অনুবাদ এসেছে তার হাত থেকে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত আরেক কথাসাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির ঢাউশ সব উপন্যাসেরও অনুবাদক তিনি। মৌলিক লেখার সংখ্যার খুব বেশি না হলেও শুধু অনুবাদের জন্যই তিনি সমাদৃত হয়ে থাকবেন বাঙালি পাঠকের কাছে।

মনে পড়ে, ‘উভচর মানুষপড়ার পর বহু খোঁজাখুঁজি করেও প্রিয় অনুবাদক ননী ভৌমিকের কোনো ছবি পাইনি, তবে তার আরও সাহিত্যকর্মের খোঁজ পেয়েছিলাম। কল্পনার এক বিচিত্র দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে যেতে টের পেয়েছিলাম পাঠের এক আতীব্র তৃষ্ণা আমাকে পেয়ে বসেছে।

একটা বুনো হাতি ধরে এনে তার মাথায় ঢোকানো হয় মানুষের মস্তিষ্ক! যে সে মানুষ নয়Ñ সেই মস্তিষ্ক ছিল একজন বুদ্ধিমান জ্ঞানী মানুষের, যিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। বেঁচে তো থাকলেন, কিন্তু কী ভয়ানক আর বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হলো সেই কাহিনীই বিস্তৃত হয়েছে ননী ভৌমিকে আরেক অনুবাদ বইতে। বইটির নামহৈটি টৈটি এও আলেকজান্দার বেলায়েভেরই। একটি-দুটি নয়; এরকম করে বাংলা অনুবাদে রাশিয়ার ধ্রুপদি শিশুসাহিত্যের বিশাল এক ভান্ডা গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। বাজারে বইগুলো হয়তো একটু দুর্লভ হতে পারে, কিন্তু তোমরা যারা পিডিএফ পড়তে অভ্যস্ত- তারা গুগল থেকে বিভিন্ন সাইট ব্রাউজ করেও পড়ে ফেলতে পারো অনেক বই। এছাড়া এখন রকমারিতে খোঁজ করেও আমাদের দেশীয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত বেশকিছু রাশিয়ান শিশু-কিশোর বইয়ের সন্ধান পেয়ে যাবে। অধিকাংশ রুশ সাহিত্যের বাংলা অনুবাদের আদি বা প্রথম প্রকাশক ছিল মস্কোরপ্রগতিরাদুগা

এখন তো সবকিছুই অনলাইনে সহজলভ্য। কিন্তু আমার মতো অনেকেরই কিশোরবেলায়- এখন থেকে অন্তত দেড় দশক আগে তো এমনটা ছিল না। তখন যারা গল্প-কবিতার বই পড়তাম- তাদের কাছে একটা ঘোরলাগা গল্পের বইয়ের পাতা ওল্টানোর স্মৃতি অসম্ভব ভালো লাগার। ফেসবুক-ইউটিউব অনলাইন গেমে অপরিকল্পিতভাবে দীর্ঘ সময় ব্যয় করার সুযোগ তো আমাদের ছিল না। ফলে সুকুমার রায়, সুনির্মল বসু, অবন ঠাকুর কিংবা ধরো লীলা মজুমদার- যার অনুবাদে আমরা ক্রিশ্চিয়ান হ্যান্স আন্দারসেনের গল্প পড়েছিÑ এসবের স্মৃতি তো সহজে ভোলার নয়! হাতের নাগালে পাওয়া বাঙালি লেখকদের সেরা সব কিশোর সাহিত্য গুলে খাওয়া প্রজন্মের সামনে রুশ সাহিত্য খুলে দিয়েছে এক আলো ঝলমলে দুনিয়ার দরোজা। দরোজার পর দরোজা।...

কী না আছে সেখানে! চুক আর গেকের কথা মনে পড়ে। সেইসঙ্গে আলিওনুস্কা, ধলা কুকুর শামলা কান, মিশকা ভালুক আর আনাড়ির মজাদার কান্ডকারখানার কথাও মনে পড়ে। অনুবাদে বইগুলো প্রথম যে প্রজন্মের সামনে আসে তারা সবাই আমাদের অগ্রজ; আজ থেকে অন্তত তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের কথা। তবে এখনো আমরা যারা বইগুলো পড়ছি কিংবা এই লেখাটি পড়ার পর তোমরা যারা খোঁজখবর নেবে এবং বই সংগ্রহ করে পড়তে বসে যাবেÑ তাদের সঙ্গেই আজকের আলাপ। তোমরা যারা ইতোমধ্যেই রুশ সাহিত্যের এই সমৃদ্ধ ভান্ডারে ঢুঁ মেরেছো, তাদের কাছে ছোট্ট চড়ুইপাখি পুদিকসোনার গল্প, সিভকা-বুরকার জাদু ঘোড়া, নীলচে ফড়িং, বাবায়াগার অদ্ভুতুড়ে কালাজাদু-মন্তর কেমন অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দিয়েছে একটু ভাবো দেখি।

তোমাদের অনেকেরই হয়তো জন্মদিনে বই উপহার পাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। কেমন হয়, যদি এমন একটা বই হাতে পেয়ে যাও- যেটি পড়তে পড়তে দুর্বিনীত ঢেউয়ের ফেনিল সমুদ্র, দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমির বিভীষিকা আর অন্তহীন বনাঞ্চলে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার মতো শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাওয়া যায়! হ্যাঁ, এরকমই একটি বই লিখেছেন বিখ্যাত রুশ কথাসাহিত্যিক ইভান ইয়েফ্রেমভ। লেখক একইসঙ্গে একজন বিজ্ঞানীও। তার ব্যাপারে বলা হয়, বিশ্বে এমন কোনো লেখক নেই, বিজ্ঞানে যার তার সমান অবদান আছে- আর এমন কোনো বিজ্ঞানী নেই সাহিত্যে যার ইয়েফ্রেমভের সমান অবদান আছে। বইটির অনুবাদ করেছেন শুভময় ঘোষ। নামফেনার রাজ্য বইটি পড়তে পড়তে আমার একবার ভাস্কর হওয়ার স্বাদ জেগেছিল। একজন তরুণ ভাস্কর তার শিল্পের জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, জীবন থেকে কতকিছু হারাতে পারেন এবং জীবনজুড়ে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন- তা পড়তে পড়তে গল্পের নায়কের প্রতি ঈর্ষা জেগেছিল আমার।

সাহিত্য আমাদের জীবনের পথে আলোকবর্তিকার কাজ করে। একটি ভালো গল্প পড়তে পড়তে কল্পনায় আমরা লেখকের সঙ্গেই যেতে থাকি নানা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, বই পড়ার সময় লেখকের চিন্তার চেয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এবং অদ্ভুত সব চিন্তাও আমার মাথায় কাজ করে। কিন্তু সবসময় তা টুকে রাখতে পারি না। হারিয়ে যাওয়া চিন্তাগুলোর জন্য পরে অবশ্য আফসোস হয়। তোমরা যারা বড় হয়ে লেখক হতে চাও তাদের জন্য এখানে একটা পরামর্শ দিয়ে রাখিÑ তোমরা বই পড়তে পড়তে লেখকের বর্ণনার শিল্প-সৌন্দর্যের প্রতি খেয়াল তো রাখবেই, সেইসঙ্গে নিজের ভেতর কোন নতুন চিন্তাটি উঁকি দিল তাও একটা নোটে লিখে রাখতে পার। এবার আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কথা বলি: তিনি তার এক ভক্তকে চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘তুই পড়া ছাড়িস না। পড়া ছাড়লে লেখাও তোকে ছেড়ে যাবে।কি বোঝা গেল- পড়ার সঙ্গে লেখার যোগটা কোথায়? এছাড়া বই না পড়লে ইশকুল-কলেজের পাঠ্যের বাইরেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে বিশাল একটি জগৎ পড়ে আছে তার সন্ধান তুমি কেমন করে পাবে!

টলস্টয়, পুশকিন, গোর্কি, চেখভ, দস্তয়েভস্কি, গোগোল, তুর্গেনেভ-এর মতো লেখকদের ধ্রুপদি রচনার সঙ্গে তোমাদের অনেকেরই হয়তো পরিচয় ঘটে গেছে এরই মধ্যে। রুশ সাহিত্যের মধ্যে আরও আছে মনীষীদের জীবনকথা, বিজ্ঞানের বিচিত্র খবরে বিশ্ব পরিচয়ের হাতছানি। রুশ সাহিত্যের এই সব অমূল্য সম্পদ অল্প দামে বাঙালি পাঠকের হাতে পৌঁছে যেতপ্রগতিবারাদুগা মতো প্রকাশনার হাত ধরে।

এসব বইয়ের অনুবাদক হিসেবে অনুবাদক হিসেবে ননী ভৌমিক শুভময় ঘোষের কথা তো আগেই বলেছি। এছাড়া রয়েছেন অরুণ সোম, নীরেন্দ্রনাথ রায়, সমর সেন, বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। বাঙালির কাছে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আদরের ছিল ছোটদের বই। ১৯৮২ সালে প্রগতি প্রকাশনার একটি শিশু বিভাগ গড়ে ওঠে, নামরাদুগা রুশ ভাষায় যার অর্থ রামধনু।দাদুর দস্তানা’, ‘নাম ছিল তার ইভান’, ‘রুপোলী খুর’, ‘পীত দানবের পুরী’, ‘মোরগছানা’, ‘বাহাদুর পিঁপড়ে’, ‘আলতাজবা’Ñ নামে আর বিষয়বস্তুতে বাঙালিয়ানা মাখা রঙিন বইগুলো ঘুরেছে শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে।

বাঙালি লেখকদের বই পড়ে অভ্যস্ত শিশু-কিশোরদের কাছে রুশ শিশুসাহিত্যের চরিত্রদের কা-কারখানাও পরিচিত মনে হতে থাকে, দূরের মনে হয় না। কেউ দুষ্টু, কেউ ভালোমানুষ গোছের, কেউ ঝগড়াটে, হিংসুটে, কেউ বা ভিতু। চুক আর গেকের মতো রেলগাড়ি চড়ে বরফের দেশে বাবাকে খুঁজতে যাওয়া, ছোট্ট মেয়ে দারিয়াঙ্কার মতো পোষা বেড়াল লাভালাইকাকে আদর দিয়েমানুষকরা, গরিব চাষির ছেলের হাতে খারাপ জমিদারের শাস্তি, এই সবের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠত কৈশোরের ভালোমন্দের বোধ।সাগরতীরেবইটির কথা না বললেই নয়। সেখানে দেখা যায় একজন আলসে ছেলেকে, যে একদিন দায়িত্ব নিতে শেখায় আর এফিমকাকার বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় স্বস্তির শ্বাস ফেলে সবাই।

বিশ্ববিখ্যাত ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কিরমাউপন্যাসের কথা তো তোমরা জানোই। পুষ্পময়ী বসুর অনুবাদে এটি আমাদের দেশেও জনপ্রিয়তা পায়।

এছাড়া বিখ্যাত অনুবাদক অরুণ সোমের অনুবাদেকারামাজভ ভাইয়েরাইডিয়টসহ অনেক অনুবাদ এখন বাংলাদেশে পাওয়া যায়। রাদুগা এবং প্রগতি প্রকাশনের প্রিন্ট পুরনো বইয়ের দোকানে কখনোসখনো দেখা যায় যদিও, কিন্তু তোমরা খোঁজ নিলেই অনেক বইয়ের বাংলাদেশী প্রিন্ট পেয়ে যাবে রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে। এছাড়া আগেই বলেছি, যাদের পিডিএফ পড়ার অভ্যাস আছে

তারা গুগল করেও পেতে পার রুশ সাহিত্যের অমূল্য এই রত্ন ভান্ডারের খোঁজ।

 

 

×