ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২৫ জুলাই ২০২৪

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

সুনসান নীরব ঢাবি ক্যাম্পাসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য

কী বড় ঝড় বয়ে গেল শহর ঢাকার ওপর দিয়ে ! না, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। আন্দোলনের নামে শহরজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। নৈরাজ্য নাশকতায় ল-ভ- হয়ে গেছে সব। যতদিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন। নিজের দেশকে, নিজের শহরকে কেউ এভাবে পুড়ে ছাই করে দিতে পারে। জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করে, ধ্বংস করে কার কী লাভ হলো? এত ক্ষোভ, এত হিংসা যে আন্দোলনে থাকে সেটি আসলে কতটা আন্দোলন ?

তার চেয়ে বড় কথা কোটাবিরোধী এই আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থ হয়ে ওঠেছিল। প্ল্যাটফর্মটি থেকে বারবারই টার্গেট করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার এবং শহীদ পরিবারগুলোর আবেগ অনুভূতিকে এতটুকু মূল্য দেননি আন্দোলনকারীরা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ছেলে-মেয়েদের ‘অমেধাবী’ প্রমাণ করতে প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না তাদের। কেন ?

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবার চোখের সামনেই তো বীর মুক্তিযোদ্ধা-পরিবারগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। শিক্ষিত এলিট আরবান তরুণদের কজন দেশের জন্য জীবন দিতে গিয়েছিলেন? অথচ আজ সেই তারাই সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতা করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে তুড়ি মেরে ওড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। জিপিএ ফাইভ প্রজন্ম নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে মরিয়া।

তারা আমলা হওয়াকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন জ্ঞান করছেন হয়ত। করলইবা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করতে হবে কেন? ফেসবুকে টিকটকে হাজার হাজার কনটেন্ট বানিয়ে কারা বীর সন্তানদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন? আন্দোলনে থাকা নেতারা একবারও কি এই ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন? বরং তারা মৌন সমর্থন দিয়ে গেছেন। তাদের ভেতর থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে অবজ্ঞা আর স্বাধীনতা বিরোধীদের কোলে তুলে নেওয়া হয়েছে। এরই চূড়ান্ত রূপ দেখা গেছে নজিরবিহীন ‘রাজাকার’ স্লোগানে।

‘তুমি কে আমি কে/রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কলঙ্কিত করেছেন শিক্ষার্থীরা। অথচ বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যায়ে উন্নীত করতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল এই ক্যাম্পাস। নিজেদেরকে রাজাকার ঘোষণা করে যারা আনন্দে ফেটে পড়েছিল তারা কি একবারও চিন্তা করে দেখেছেন, এই স্লোগানের অর্থ কী দাঁড়ায়? কোথায় আঘাত করছেন তারা? এরপরও যদি তারা ভুল স্বীকার করতেন, যদি অন্তত একটা ব্যাখ্যা দিতেন তাহলেও মানা যেত।

তারা সেটি করেননি। ফলে ‘রাজাকার’ স্লোগান আন্দোলনের মেরিট একেবারে নষ্ট করে দিয়েছিল। দ্বন্দ্ব সংঘাতের শুরুও এখান থেকে। কত  যে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে ক্যাম্পাসে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ‘রাজাকার’ তাড়াতে গিয়ে স্পষ্টতই অন্যায় অপরাধে জড়িয়েছে। তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বর্বরতা দেখিয়েছেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। সব মিলিয়ে ভয়াবহ ছিল গত কটা দিন। তবে এখন সেখানে কেউ নেই। শুধু আছে ক্ষতচিহ্ন। অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে ক্যাম্পাসজুড়ে।

একলা হেঁটে যাওয়ার সময় যে কারও বুক ধুক্পুক করে ওঠবে। অবশ্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র পাদদেশে গেলে ভেতরের সব দুর্বলতা মুহূর্তেই ঘুচে যায়। এখানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাথা উঁচু করা ভাস্কর্য। নির্বাক ভাস্কর্য সব সময়ের মতোই বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে। লুঙ্গি পরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সবার ওপরে স্থান দিয়েছিল শিক্ষিতদের এই বিশ্ববিদ্যালয়। আজ ভেবে কিছুটা অবাক হতে হয় বৈকি।   
কাটেনি শোকের আবহ ॥ গত কদিনের গোলযোগে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে গেল। কোটাবিরোধী আন্দোলনে থাকা কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থীও নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের যে ছাত্রটি বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেল, যদি তার কথাই বলি, কী দোষ ছিল এইটুকুন ছেলের? কেন এই কচিকাঁচা প্রাণটিকে বাঁচানো গেল না। রাষ্ট্রেরও দায় আছে। দায় স্বীকার করতে হবে। সন্তানহারা বাবা মায়েদের কষ্ট যতটা সম্ভব দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।

দায় নিতে হবে আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও, যারা স্কুল কলেজ পড়ুয়াদের রাস্তায় নামাতে দ্বিধা করেননি। সর্বোপরি যারা ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেছিল তাদের চিহ্নিত করা সময়ের দাবি। শাস্তির আওতায় আনতে হবে তাদের। তা না হলে বারবারই নাগরিকের ন্যায্য আন্দোলন সংগ্রাম বেহাত হয়ে যাবে। হুমকির মুখে পড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব।

×