ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

ছদ্মবেশীদের চিনতে পারছে কি প্রজন্ম

জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন...

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২৩ জুলাই ২০২৪

জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন...

রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর নয় শুধু, আঘাত এসে লেগেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ওপরও

জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন...। একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরও এদের টার্গেট মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন চিবিয়ে খেতে চায় এরা। বাঙালির যুদ্ধজয়ের গৌরব, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ভুলিয়ে দিতে চায়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় অবদান অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখায়। 
গত কদিনের কোটাবিরোধী আন্দোলনে ভয়ংকর এই সব প্রবণতা দেখা গেছে। হ্যাঁ, সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই ছিল আন্দোলনটি। তবে বেহাত হতেও সময় লাগেনি। ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে মানুষের ভিড়ে মুখোশে ঢাকা অনেক মুখ। মুখগুলো আন্দোলনকে দিনশেষে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে। তাদের তা-ব, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনাও মনে করিয়ে দিয়েছে রাজাকার আলবদর আলশামসদের কথা। একাত্তরে বর্বর পাকিস্তানিদের ঔরশজাত বাহিনীগুলো অনেকটা এভাবেই বাঙালির ওপর হামলে পড়েছিল।    
ইতিহাসটি কারও অজানা নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়েছিল রাজাকার আলবদর আলশামস বাহিনী। এ দেশের হয়েও  পাকিস্তান রক্ষার নামে বাঙালিদের নির্মম নিষ্ঠুরভাবে এরা হত্যা করেছে। নারীদের ধর্ষণ করেছে। অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল এদের বর্বরতা। নপুংশকের দল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস গু-ামি করলেও, স্বাধীনতার পর গর্তে লুকিয়ে যায়। এদের খুঁজে বের করতে এমনকি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর নব উত্থান ঘটেছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত শিবির পুনর্বাসিত হয়। খালেদা জিয়া মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে দেন শহীদের রক্ত ভেজা পতাকাও। পরবর্তীতে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার হলেও, দল হিসেবে অভিযুক্ত জামাত শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। বরং নিজেদের তারা প্রতিনিয়ত সংগঠিত করেছে। আর সময় সুযোগ পেলেই হামলে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পরিচালিত করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করেছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের বেলায়ও অভিন্ন লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতা বিরোধী আরও যেসব দল এবং জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে আছে সবগুলোই তৎপর হয়েছিল গত কদিন। কিন্তু এই ছদ্মবেশীদের চিনতে পারছে কি প্রজন্ম? এটি আজকের দিনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলছেন, কোটাবিরোধিতার নামে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য যত অন্যায় অপকর্ম ষড়যন্ত্র হয়েছে সবগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝেছি যে, এরা সেই পুরনো শকুন। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম একটি প্রজাতন্ত্র করতে। আর স্বাধীনতা বিরোধীরা চেয়েছিল রাষ্ট্র একটি ধর্মের হয়ে থেকে যাবে। ১৯৭১ সালে তাদের চাওয়া পূরণ হয়নি। তাই দেশটাকে তারা মেনে নেয়নি। যুগ যুগ ধরে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। আর গত এক সপ্তাহে আমরা আরও ভালোভাবে বুঝেছি যে, ওরা কতটা ভয়ংকর হওয়ার ক্ষমতা এখনো রাখে। কতটা দেশবিরোধী হতে পারে ওরা! 
জরুরি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আন্দোলনে যোগ দেওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা এদের চিনতে পেরেছে কি? তারা কি জানে, এই এরাই একাত্তরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে? আগুন দিয়েছে? মা বোনদের ধর্ষণ করেছে? জানে ওরা? শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, স্বাধীনতা বিরোধীদের চেনার এটাই শেষ সময়। না চিনলে বাংলাদেশ একটি প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে।                 
রণাঙ্গনের সাহসী যোদ্ধা বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধারা সব সময়ই সম্মানিত হবেন। তাদের অবদানকে অবনত মস্তকে স্বীকার করতে হবে। অন্যদিকে, চির ঘৃণার পাত্র হবে রাজাকাররা। এই সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে সব ব্যর্থ হয়ে যাবে। 
একই প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটির শীর্ষ নেতা শাহরিয়ার কবির বলছিলেন, পঁচাত্তরের পর চরম উপেক্ষার শিকার হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এমনকি অনেকে রিক্সা চালিয়ে জীবন ধারণ করেছেন। অথচ আজ যখন কিছুটা সম্মান ফিরে পেয়েছেন তারা তখনই চিহ্নিত শকুনেরা ঠোকর বসাতে উড়ে এসেছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে তিনি বলেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। কিংবা অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের সুযোগ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ‘রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের চরম অবমাননা করেছেন। এটা ক্ষমার অযোগ্য। 
কোটাবিরোধীদের কোনো কোনো সমন্বয়কের কথাবার্তা শুনে তাদের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি। বলেন, এদের পারিবারিক পরিচয় কী, বাবারা দাদারা কী করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়Ñ এই সব তথ্যও এখন নিতে হবে। একেক সময় একেক কথা বলা নেতাদের তদন্তের আওতায় আনারও দাবি জানান তিনি।   
শাহরিয়ার কবির বলেন, একাত্তরের শীর্ষ যোদ্ধাপরাধীদের কয়েকজনের বিচার হয়েছে। কিন্তু দল হিসেবে জামায়াতে ইসলাম যে অপরাধ করেছিল সেটির বিচার আজও হয়নি। আমরা বছরের পর বছর ধরে জামাতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছি সরকারের কাছে। কিন্তু সে দাবি নিযে কাজ করা হয়নি। আজকের পরিস্থিতিতে জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই বলে মত দেন তিনি। 
এ বিষয়ে কথা হয় প্রগতিশীল আবৃত্তি শিল্পী রফিকুল ইসলামের সঙ্গেও। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা কালজয়ী কবিতাটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপশক্তিকেই কবি ‘শকুন’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, এই শকুনেরা ঘুরে ফিরেই জাতীয় পতাকাকে খামচে ধরতে আসবে। কিন্তু আমরা সতর্ক হইনি। এবার তাই আরও ব্যাপকভাবে এসেছে ওরা। এর পর আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব নয়, মুক্তিযুদ্ধের শক্তি নিয়ে এদের প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান তিনি।

×