মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে গুরিন্দা মসজিদ
চারদিকে অযত্ন অবহেলার প্রকট ছাপ। দেয়ালে রঙের প্রলেপ নেই। পলেস্তারা খসে পড়ছে। দরজা নেই। জানালা নেই। বেরিয়ে পড়েছে দেওয়ালের ইট আর তার ভাঁজে ভাঁজে গজিয়ে উঠেছে ঘাস। মেঝেতে নেই প্লাস্টার। নেই সীমানাপ্রাচীর। নেই দেখভাল করার লোক। এমন সীমাহীন অযতœ-অবহেলার পরেও পটুয়াখালীর গলাচিপায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচশ’ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক স্মৃতিবাহী গুরিন্দা মসজিদ।
যথাযথ পরিবেশের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এ মসজিদে এখনো নিয়মিত ধ্বনিত হয় পবিত্র আজান। শ্রদ্ধাভরে নামাজ আদায় করেন স্থানীয় অনেক মুসল্লি। তাদের কাছে এ মসজিদের রয়েছে অলৌকিক নানান গুণ। মাঝে মধ্যে আসেন পর্যটকরাও।
খালের নাম গুরিন্দা। দু’টি খালের মিলনস্থল। এ খালের পাড়েই দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদ। খালের নামানুসারে তাই স্থানীয়দের কাছে মসজিদটির নাম গুরিন্দা মসজিদ।
গলাচিপা উপজেলা শহর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে রতনদী-তালতলী ইউনিয়নের কাছারিকন্দা গ্রামে এর অবস্থান। এক গম্বুজবিশিষ্ট মূল মসজিদের আয়তন ৩৬১ বর্গফুট। উচ্চতা ৩২ ফুট। উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে রয়েছে একই মাপের তিনটি খিলান দরজা। মসজিদের অভ্যন্তরে দেওয়ালের গায়ে রয়েছে ছোট কুলুঙ্গি। যা এক সময়ে প্রদীপ এবং বই-পুস্তক রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হচ্ছে। মূল মসজিদের কয়েক ফুট দক্ষিণে আরও একটি ছোট ভবন রয়েছে।
ভবনটির বহিরাঙ্গে এখনো বিভিন্ন ধরনের কারুকাজের চিহ্ন চোখে পড়ে। বাইরের চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট অনেক কুঠুরি। এগুলোতে এক সময়ে প্রদীপ জ্বালানো হতো বলে নির্মাণ দৃষ্টে মনে হয়। এ ছোট ভবনটি নিয়ে দু’টি ভিন্নমত রয়েছে। কারও কারও মতে এটি কোনো পীর আউলিয়ার মাজার। আবার অনেকের মতে এটি মসজিদের ইমামের বসতঘর। মসজিদসহ এ ছোট্ট ভবনটি নির্মিত হয়েছে কেবলমাত্র ইট এবং চুন, সুরকি দ্বারা। দু’টি ভবনেরই দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় দেড় ফুট।
যে কারণে যথেষ্ট প্রাচীনত্ব সত্ত্বেও মূল ভবন দু’টি আজও অক্ষত রয়েছে। কোথাও সামান্য ফাটলেরও দেখা মেলেনি। মসজিদসহ ভবনটির গায়ে কোন ধরনের শিলালিপি নেই। পাওয়া যায়নি কোন ধরনের প্রমাণ্য দলিল। তাই এর সঠিক নির্মাণ কাল নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। তবে এর প্রাচীনত্ব নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই।
প্রায় শত বছর ধরে মসজিদে স্বেচ্ছায় ইমামতির কাজ করেছেন রুস্তুম আলী হাওলাদার নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। কয়েক বছর আগে তিনি ১১৬ বছর বয়সে মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে রুস্তুম আলী হাওলাদার তার নিকটজনদের কাছে মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়ে গেছেন, তা অনেকটা এ রকমের। মুকুট রাজার আমলে মামুনতক্তি হাওলাদার নামের স্থানীয় এক ধনাঢ্য ব্যক্তি এ মসজিদ ও মাজার নির্মাণ করেন। রুস্তুম আলী হাওলাদার মসজিদ নির্মাতা মামুনতক্তি হাওলাদারের অধস্তন সপ্তম পুরুষ।
রুস্তুম আলী হাওলাদারের বক্তব্য সঠিক হলে মসজিদের বয়স তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ বছর হতে পারে। যদিও রুস্তুম আলী হাওলাদারের এ বক্তব্যের স্বপক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ মেলেনি। নেই কোনো দলিল কিংবা রেকর্ড। বরং মসজিদের নির্মাণ শৈলী ও গঠন কৌশল দেখে এবং ঐতিহাসিক তথ্য ঘেঁটে ধারণা করা হচ্ছে এ মসজিদ আরও পুরোনো। এর নির্মাণ কাল পঞ্চদশ দশকের। সুলতান বরবক শাহের আমলে এ মসজিদ নির্মিত হয়েছে। সুলতান বরবক শাহের আমলে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে এ ধরনের এক গম্বুজবিশিষ্ট মোট ১৩টি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।
যার প্রায় সবগুলোই হয় নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। না হয় অন্য কোনো কারণে ধ্বংস হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যে বলা হয়েছে, সুলতানী আমলে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে হযরত খানজাহান আলী ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে সুন্দরবন অঞ্চলে আগমন করেন। তার সফর সঙ্গী হয়ে আসা ৩৬০ জন আউলিয়া সুন্দরবন অঞ্চলের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন এবং তারা বিভিন্ন স্থানে মসজিদ নির্মাণ করেন।
এদেরই একজন ওয়াজিল খান এ মসজিদ নির্মাণ করেন এবং মসজিদের পাশের ভবনে মৃত্যুর পরে তাকে সমাহিত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওয়াজিল খান প্রথমে আরবীয় বণিক হিসেবে এ দেশে আসেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হযরত খানজাহান আলীর সঙ্গীয় আউলিয়া হিসেবে পরিগণিত হন। ঐতিহাসিক এ তথ্য সঠিক হলে গুরিন্দা মসজিদ অন্তত পাঁচশ’ বছরের পুরোনো। বর্তমানে রুস্তুম আলী হাওলাদারের নাতি ইব্রাহিম হাওলাদার মসজিদে ইমামতির কাজ করছেন।
ঐতিহাসিক তথ্যে আরও বলা হয়েছে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভয়াল সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য অর্থাৎ বর্তমান বরিশাল-পটুয়াখালী অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চন্দ্রদ্বীপ রাজা কন্দর্প নারায়ণ বাধ্য হয়ে তার রাজ্যের রাজধানী বাকলা থেকে ক্ষুদ্রকাঠিতে স্থানান্তর করেন। প্রাকৃতিক এ ধ্বংসযজ্ঞের পর পরই এ অঞ্চলে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের হামলা-লুন্ঠন শুরু হয়। জলদস্যুরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে। নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করে।
এতে এক পর্যায়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অর্ধেকেরও বেশি সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বাড়িঘর ছেড়ে অন্য এলাকায় পাড়ি জমায়। এক সময়ে প্রাণচঞ্চল জনপদগুলো বিরানভূমিতে পরিণত হয়। এ অবস্থা পরবর্তী প্রায় দীর্ঘ প্রায় দু’শ’ বছর ধরে বিরাজ করে। এতে গোটা দক্ষিণাঞ্চল বিশাল সুন্দরবনে রূপ নেয়। অন্যান্য জনপদের ন্যায় গুরিন্দা মসজিদও সুন্দরবনের অরণ্যে ঢাকা পড়ে। পরবর্তীতে রাখাইনরা এসে এ অঞ্চলকে আবার আবাদি জমি এবং জনপদে রূপ দেয়। ওই সময়ে অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসে গুরিন্দা মসজিদ। এ মসজিদ নিয়ে এক সময়ে এ অঞ্চলে নানা কিংবদন্তির প্রচলন ছিল। বলা হতো-এ মসজিদে রাতে আজানের ধ্বনি শোনা যেত। বাঘের পাহারায় ছিল মসজিদ।