ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

সুযোগ পেলেই মাথা তোলে

নিকৃষ্ট গালি হয়ে আছে রাজাকার আলবদর

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১৩ জুলাই ২০২৪

নিকৃষ্ট গালি হয়ে আছে রাজাকার আলবদর

১৯৭১ সালে আলবদর দিবসে কুখ্যাত তিন খুনি

বাঙালি গালাগাল করার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে। আর গালাগাল মানেই নিকৃষ্ট শব্দের ব্যবহার। তবে বাংলা অভিধানের সবচেয়ে নিকৃষ্ট গালি যে ‘রাজাকার’ ‘আলবদর’ এবং ‘আলশামস’, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্য গালি অনেকে হজম করে ফেলেন। কিন্তু ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’ বা ‘আলশামস’ বলে গালি দিলে একদম মানতে চান না কেউ। বরং তেড়ে আসেন। কারণ আর কিছু নয়, শব্দগুলো এমন এক ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয় যেটি কাপুরুষের। ঘাতকের। দালালের।

বর্বর খুনি ধর্ষক বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী বেইমান অর্থে এই গালিগুলো ব্যবহার হয়ে আসছে। বাস্তবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদর আলশামস ছিল পাকিস্তানিদের প্রয়োজনে গড়ে তোলা তিনটি আধাসামরিক বাহিনী। এদের জন্ম বাংলাদেশে হলেও, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করেছে। পাকিস্তান রক্ষার নামে এরা বাঙালিদের নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। নারীদের ধর্ষণ করেছে। অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল এরা।

নপুংশকের দল মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস গু-ামি করলেও স্বাধীনতার পর গর্তে লুকিয়ে যায়। এদের খুঁজে বের করতে এমনকি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর এই এদেরই নব উত্থান ঘটেছিল। এত রাজাকার আলবদর আলশামস এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল! ভেবে অবাক হয়েছিল দেশের মানুষ। আসলে দেশবিরোধী অপশক্তি গর্তে মুখ লুকিয়ে থাকে। সময় সুযোগ মতো বের হয়ে আসতে জুড়ি নেই তাদের। তবে নিজস্ব পরিচয়ে নয়, নানা নামে ছদ্মবেশে সামনে আসে। ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। কলকাঠি নাড়ে। সহজে ধ্বংস হয় না বলে হাল আমলে এদের বলা হয় ‘প্লাস্টিক!’ 
‘রাজাকার’ গালিটি বেশি প্রচলিত। আগে এই বাহিনীটির কথা হোক। ‘রাজাকার’ বা ‘রেজাকার’ শব্দটি ফার্সি। এর অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবী’। যতদূর জানা যায়, ১৯৪০-এর দশকে ভারতের হায়দরাবাদের এই নামে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। একইভাবে ১৯৭১ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। বাহিনীর সদস্যরা ছিল পাকিস্তানিদের পা-চাটা গোলাম। গোলামদের অন্যতম কাজ ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর সংগ্রহ করা, ধরিয়ে দেয়া। মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ছিল এদের নিত্যদিনের কাজ।   
একই রকম আরেকটি বাহিনী ছিল আলবদর। এই বাহিনীর প্রধান ছিল জামায়াতের শীর্ষ ‘মাল’ মতিউর রহমান নিজামী। এই খুনির নিজের লেখায় আলবদরদের একটা ছবি পাওয়া যায়। বদর দিবসের এক সপ্তাহ পর ১৪ নভেম্বর নিজামী দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় লিখেছিল, ‘আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকসেনার সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিনশ’ তেরো।

এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তিনশ’ তেরো জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের কথা বলে মুসলমানদের হত্যার জন্যই এ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। চরম সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিটি আরও লিখেছিলেন, ‘তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উডডীন করবে।’

বাস্তবে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলছেন, এই আলবদর ছিল ডেথ স্কোয়াড। রাজাকার বাহিনীর পর পরই এই বাহিনী গঠিত হয়। আলবদর বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ হানাদার বাহিনীই জুগিয়েছে। ঘাতক রাও ফরমান আলির নোটবুকে আলবদরদের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। 
আবু সাইদের তথ্য মতে, আলবদর বাহিনী গঠনের সূত্রপাত জামালপুর শহরে। পাকিস্তানি বাহিনী ২২ এপ্রিল জামালপুর দখল করে নিলে, জামালপুরের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মুহাম্মদ আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। ‘জামালপুর মহকুমায় আলবদর বাহিনী কর্তৃক ৬ জন মুক্তিবাহিনীকে হত্যার মাধ্যমে তাদের তৎপরতা প্রকাশিত হয়ে পড়লে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে, রাজাকারদের চেয়ে উন্নততর মেধাসম্পন্ন রাজনৈতিক সশস্ত্র ক্যাডার গড়ে তোলার সুযোগ বর্তমান। 
জানা যায়, আগস্ট মাস থেকেই সারাদেশে ইসলামী ছাত্রসংঘকে আলবদরে রূপান্তরিত করা হয়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ও ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা দিয়ে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার জন্য পাঠানো হয়। হ্যাঁ, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতেছিল এই বাহিনীও। ‘আলশামস’ও একই ধরনের কর্মকা-ে যুক্ত ছিল। 
আজ আর বাহিনীগুলো নেই। তবে ভিন্ন নামে বিরাজ করছে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির কুখ্যাত বাহিনীগুলোকে লালন করে চলেছে এখনো। দেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী যে কোনো হল্লা হলে এরা সুযোগ খোঁজে। গর্ত থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। এখনো কি তেমন সময়? ভেবে দেখতে ক্ষতি কী?

×