.
মনোহরা গ্রামের পাশেই সুন্দর একটা বন। কতো যে গাছপালা, কতো কতো ফুল-পাখি, প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সে বনেই বসত বিড়াল, ইঁদুর এবং আরও অনেক প্রাণীর। তাদের মধ্যে সামাজিকতা আছে, উৎসব আছে, আছে দলনেতাও। তাদের নেতা নির্বাচিত হয় একটি সুষ্ঠু ভোটের মধ্য দিয়ে। সামনে আবার নির্বাচন। বিড়ালটা ভাবে, আমিও নির্বাচনে দাঁড়াবো- কিন্তু আমাকে এতো ভোট দেবে কে! ভাবতেই হুট করে মাথায় আসে যদি ইঁদুরগুলোকে আমার দলে আনা যায়, তাহলে আর পায় কে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? বিড়ালের সঙ্গে ইঁদুরের সম্পর্ক বরাবরই সাপে-নেউলে। বিড়ালটা ভাবে, এভাবে আর কতো দিন। কিভাবে ইঁদুরের বন্ধু হওয়া যায়- তাই নিয়ে রাত-দিন চিন্তা করতে থাকে।
সেদিন ভোলা ময়রার দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে বিড়ালটা ইঁদুরের বাসায় যায়, কিন্তু বিড়ালটাকে দেখেই ইঁদুরগুলো ভয়ে পালিয়ে যায়। বিড়াল বলে, আমি তোমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছি তোমরা যেওনা। ওরা বিড়ালের কথায় পাত্তা দেয় না, পালিয়ে যায়। বিড়ালটা বিষণœ মনে বাসায় ফিরে আসে।
আবার ভাবতে বসে, কী করা যায়। বেশ ক’দিন কেটে গেছে। বিকেলে বিড়ালটা মহল্লার দোকানে চা খাচ্ছিল, সেসময় দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ইঁদুর কমিউনিটির সভাপতি। বিড়াল তাকে ডেকে চা খাওয়ার অনুরোধ করলে সে তাড়া দেখিয়ে চলে যেতে লাগলো। বিড়ালটা তাকে ডেকে বলল ইঁদুর-বিড়াল কমিউনিটি মিলে কি আমরা বন্ধু হতে পারি না? ইঁদুর পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো। বিড়ালটা আরও গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। কিভাবে কী করা যায়। তারপর সে ভাবে, ইঁদুরগুলোর পড়াশোনার হাল বেহাল। হিসাব-নিকাশে বেশ দুর্বল। বিড়ালটা ভাবে, ওদের জন্য গণশিক্ষা চালু করলে কেমন হয়। গণইঁদুর শিক্ষা! হা হা করে হেসে ওঠে, আর মনে মনে ভাবে- এবার তো ইঁদুরগুলো রাজি হবে। অনেক ভেবে যা একটা বুদ্ধি বের করেছি না!
মধ্যরাত। সময় আর কাটছে না। সকাল হলেই ইঁদুরদের কাছে প্রস্তাবখানা দেবে। উত্তেজনায় চোখে ঘুম নেই। ইঁদুরগুলো সকালে কাজে যাবার আগেই ওদের কাছে আমাকে পৌঁছাতে হবে।
সকাল হতেই বিড়ালটা না খেয়ে ছুটে চলল। বরাবরের মতোই এবারও তার কথায় কেউ পাত্তা দেয় না। বলে দিল, শিক্ষা দিয়ে অতো কাজ নেই, এমনিতেই ভালো আছি। বিড়ালের হাসিমুখ চুপসে গেলো। খুব মন খারাপ নিয়ে বিড়াল রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা দিল। নির্বাচন সামনে, কিছুতেই ওদের দলে আনতে পারছে না, আর বুঝি নেতা হওয়া হলো না! যেতে যেতে ভাবলো- সে আর কখনো ইঁদুরদের কাছে যাবে না। ভেতর ভেতর সে খুব রেগে গিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে- আমি হলাম বাঘের মাসি, আমার বন্ধু হবে সিংহ-ভালুক। ইঁদুর কোনোভাবেই আমার সমকক্ষ নয়। বেটারা সব ছোটলোক। সারাটা রাত না ঘুমানো, তারপরে আবার এতটা পথ হেঁটে যাওয়া-আসায় বিড়ালটা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বাসায় ঢুকে হাত-মুখ না ধুয়ে, না খেয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে গভীর ঘুম। সেকি নাক ডাকা তার। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে হেসে কুটিকুটি হতে থাকে সে। হাসতে হাসতে ঘুম ভেঙে যায়। বলতে থাকে এবার কোথায় যাবিÑ এখন তো আমার কাছে আসতেই হবে। অনেক জ্বালিয়েছিস, মজা এবার দেখাবো আমি। বিছানা থেকে উঠে পানের বাটা নিয়ে বসে বিড়াল। খর-জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে খায়। খুব ভাব নিয়ে পিক ফেলে আর চিবিয়ে চিবিয়ে ছড়া কাটে।
‘ইঁদুর-বিড়াল ভাই ভাই
আর তো কোনো চিন্তা নাই।’
তারপর কপাল কুচকিয়ে কি জানি কি ভাবতে থাকে। সকাল হলে তড়িঘড়ি করে রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। বহু দূরের পথ, তার ওপর লোকাল ট্রেন, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা। ট্রেন এসে পৌঁছায় ঢাকা স্টেশন। ট্রেন থেকে নেমে সোজা চিড়িয়াখানার পথ ধরে বিড়াল। চিড়িয়াখানার সামনে একটা দোকানে পাওয়া যায় বাঘের মুখোশ। একটা দোকানে ঢুকে বাঘের মুখোশ আর জামা নিয়ে খুব ভালালোভাবে মুড়িয়ে নিয়ে আবার রওনা হল ট্রেনের উদ্দেশে। ভাবসাব এমন- বিষয়টি খুব গোপন। যাতে কেউ বুঝতে না পারে ভেতরে কি আছে।
ট্রেন চলে এলো, একটু পরেই ছেড়ে যাবে। পায়ের উপর পা তুলে জানালার পাশে বসে সেই একটা ভাব নিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে আর ভাবছেÑ এবার যা একটা চাল খাটিয়েছি। ইঁদুরগুলো জব্দ হবেই। যেমন বুদ্ধি তেমন কাজ। বাঘের জামা আর মুখোশ লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে দেখেই অবাক। এতো পুরোটাই বাঘের মতো। তারপর ইঁদুরের বাড়ির পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে বাঘের মতো গর্জন করতে থাকে। খাবারের সন্ধানে আসা ইঁদুরগুলো নিজেদের মধ্য আলোচনা করতে থাকে। তারা হঠাৎ একটা গর্জন শুনে থমকে যায়, এটা কি বাঘের গর্জন? বার বার শুনে তারা নিশ্চত হলোÑ হ্যাঁ, এটা সত্যি বাঘের গর্জন। সবাই খুব খুশি হয়ে যায়।
কি দারুণ ব্যাপার, বাঘ এলো আমাদের বনে! একজন বলতে থাকে- বাঘ যেহেতু এতো কাছে এসেছে তাকে দেখতে যেতেই হবে। আর একজন বলে- হ্যাঁ, সত্যি তো! অনেকবার ভেবেছি সুন্দরবন গিয়ে বাঘ দেখে আসব। তা আর হলো কই, অনেক খরচার প্রয়োজন। চল চল, এখনই সবাইকে খবর দিয়ে আসি। একসঙ্গে দলবেঁধে বাঘ দেখতে যাব। একজন বলে, আমি কিন্তু একটা সেলফি তুলব।
লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ালটা ওদের সব পরিকল্পনা শোনে এবং হাসে, আর জোরে জোরে শব্দ করে।
কথামতো ইঁদুরগুলো সবাইকে খবর দেয়। খবর শুনে বাকিরাও তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে রওনা হয়।
বাঘ এসেছে বাড়ির কাছে
সুযোগ কি আর বার বার আসে?
চল চল জলদি যাই। দলবেঁধে সবাইকে আসতে দেখে বিড়ালটা হাসে আর আরও জোরে জোরে শব্দ করে। শব্দ শুনে ইঁদুরগুলো কি খুশি! তাদের হাঁটার গতি আরও বেড়ে যায়। লতাপাতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে বাঘের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সকলে আত্মহারা একে একে সবাই বাঘকে সালাম করে হাত মেলায়। কেউ কেউ আবেগে আপ্লুত হয়ে কোলাকুলি করে। বিড়ালটা মনে মনে হাসতে থাকে আর ভাবতে থাকে কেমন জব্দ করলাম, হা হা...।
একটা ইঁদুর বলে আপনি আমাদের বনে এসেছেনÑ আমরা খুব খুশি হয়েছি। তখনই বাঘের মুখোশ পরে থাকা বিড়ালটা বলে, ‘হ্যাঁ, আমি এসেছি- ওই যে বনের দক্ষিণে আমার মাসির বাড়ি, ওইখানে। ওই বিড়ালটা আমার মাসি। ক’দিন পরে তোমাদের বনে নির্বাচন, সে নির্বাচনে আমার মাসি বাঘ মার্কায় দাঁড়াবে। মাসির জন্যই আমার এখানে আসা। তোমরা আমার মাসির সঙ্গে মিলে একটা বড় কমিউনিটি গড়ে তোলো। নির্বাচনে আমার মাসিকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করো।’ ইঁদুরেরা কথা শুনে রাজি হয়ে যায়। তারা বলে, আচ্ছা বাঘ মামা- আমরা ইঁদুরেরা এখন থেকে বিড়ালের সঙ্গেই মিলে থাকব। ইঁদুরের কথা শুনে বিড়ালটা আবেগে আপ্লুত হয়ে ভুলবশত ‘মিউ-মিউ’ করে হেসে ফেলে।
ইঁদুরগুলোর আর বুঝতে বাকি থাকে না এতো ওই বিড়ালটা। সবাই হু-হু করে হাসতে থাকে। তাদের হাসির শব্দে সারা বন ছেয়ে যায়। বিড়ালটা ভীষণ লজ্জায় প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচে।