.
খোকন নামের এক ছোট্ট ছেলে আটকা পড়ে গেল স্কুলের ওয়াশরুমে। এক-দুই দিন না, পাক্কা এগোরো দিন! ভাবা যায়! তারপর? তারপর কী হলো? জানতে ঝটপট দেখে ফেলতে হবে আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘ছুটির ঘণ্টা’ নামের চমৎকার ছবিটা। জানো তো, ‘ছবি’ মানে কিন্তু সিনেমা বা চলচ্চিত্র। আজ আমরা আলাপ করব তোমাদের জন্য নির্মিত আরও কিছু দুর্দান্ত সিনেমা নিয়ে।
সিনেমা বা চলচ্চিত্র আমাদের দেখার দুয়ার খুলে দেয়। সত্যজিৎ রায়কে তো চেনো। ফেলুদা’র গল্পগুলো পড়লে কে ওই অমৃতের স্বাদ ভুলতে পারে বলো? হ্যাঁ! তোমাদের যাদের মনের ভেতর সিনেমা বানানোর পোঁকা ঘুরঘুর করছে তারা অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘পথের পাঁচালী’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘পরশ পাথর’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’Ñ এই সবক’টি ছবি ঝটপট দেখে ফেলতে পার। উহু! এক বসাতেই না, রুটিন করে দেখলে সুবিধা। আমার প্রিয় চলচ্চিত্রকার অমিতাভ রেজা কী বলেছেন জানো? বলেছেন, ‘সিনেমা দেখতে হয় সিলেবাস করে, যেমন ক্লাসের পড়া সিলেবাস ধরে পড়ি।’
তোমরা যারা গল্প-উপন্যাস পড় তারা নিশ্চয়ই এতোদিনে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই পড়েছো। উনার গল্প অবলম্বনে তৈরি ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ও ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’- ছবিগুলো রাখতে পার তোমার রুটিনে। যারা বইপত্তর পড় তারা নিশ্চয়ই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরও অনেক গল্পও পড়ে ফেলেছ? শীর্ষেন্দু’র গল্প থেকে ‘হীরের আংটি’ নামের চমৎকার এক ছবি বানিয়েছেন ঋতুপর্ণা সেন। আর সুনীলের ‘কাকাবাবু’ সিরিজ থেকে ছবি হয়েছে পাঁচটি। ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’, ‘এক টুকরো চাঁদ’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘মিসর রহস্য’ এবং ‘ইয়েতি অভিযান’। কাকাবাবু পড়ার পাশাপাশি ছবিগুলো দেখে ফেলতে পার।
তারেক মাসুদ নামের একজন গুণী শিল্পী ছিলেন আমাদের দেশে। এই যে তোমরা ২০১৮ সালে ‘কিশোর বিদ্রোহ’ করলে নিরাপদে পথ চলার জন্য, সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য- সেই সড়ক দুর্ঘটনা এ মানুষটিকেও আমাদের কাছ থেকে বহুদূরে নিয়ে গেছে। তারেক মাসুদের একটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে ‘মাটির ময়না’। মুক্তিযুদ্ধ আর ভাই-বোনের ভালোবাসা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে এই ছবিত। ‘মাটির প্রজার দেশে’ নামের আরেকটি ছবি আছে। ছবিটিতে গ্রামের শৈশব-কৈশোর দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটাও রাখতে পার তোমার দেখবার তালিকায়। বিদেশী কাহিনী অবলম্বনেও আমাদের দেশে দারুণ ছবি হয়েছে। জার্মানির এরিখ কাস্টনারের গল্প থেকে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নামের অসম্ভব সুন্দর এক ছবি বানিয়েছেন বাদল রহমান, বাংলাদেশে এটিই প্রথম ছোটদের ছবি।
নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের গল্প অবলম্বনে ‘দূরত্ব’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। ছবিতে দেখা যায় এগারো বছরের এক ছোট্ট ছেলে পুতুল। তার মা-বাবা খুব ব্যস্ত। তাকে সারাদিন কম্পিউটার গেম খেলতে হয়, মানে আমাদের মতো আর কি। একদিন পুতুল এই বন্দিজীবন থেকে বের হয়ে যায়। পুতুল হারিয়ে যায়। কোথায় হারায় তা জানতে হলে ছবিটি দেখে ফেল। আচ্ছা, তোমরাও কি পথশিশুদের সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হও? হা হা, তাদের আবার সৌভাগ্য! তারা না পারে পড়তে, না পারে খেলতে। তাদের নিয়ে একটি ছবি আছে ‘পাঠশালা’ নামে। এটাও রাখো রুটিনে।
ওহো! তোমাদেরকে তো একটা চমৎকার ছবির নামই বললাম না। ‘কাবুলিওয়ালা’। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কাবুলিওয়ালা। ওই যে ঝুনঝুন করা আফগান ফল বিক্রেতা আর সেই ছোট্ট মেয়েটি। না না, গল্পটা তোমাদের বলে দিলে হবে? তোমরা তো জানোইÑ গল্প বলে ফেললে ছবি দেখার মজা পানসে হয়ে যায়। তাহলে ঝটপট দেখে ফেলো। ছবিটি বানিছেন তপন সিংহ। তপন সিংহ পরিচালিত আরও কিছু ছবির নাম জেনে নেওয়া যাক, ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’, ‘এক যে ছিল দেশ’, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘অতিথি’। ভারতের এই চলচ্চিত্রকাকে বলা যায় ছোটদের জন্য এক পথিকৃৎ। জীবনের বেশির ভাগ সময় ছোটদের ছবি নির্মাণ করেছেন। আর বাংলাদেশে ছোটদের জন্য বেশ ক’টি ছবি বানিয়েছেন মোরশেদুল ইসলাম।
ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘চতুর গোয়েন্দা চতুরাভিযান’ নামের গোয়েন্দা সিরিজ অবলম্বনে গত বছর বের হলো টাটকা ছবি ‘গোয়েন্দা তাতার’। তোমরা যারা কিশোর মুসা-রবিনহুড পড় এবং দেখো তাদের জন্য তো বলা চলে পোয়াবারো। আর কী লাগে!
বাংলা ছবির রুটিন শেষ আপাতত, এবার একটু ইংরেজি দেখা যাক।
তোমাদের মধ্যে অনেকেই আছ বয়েজ/গার্লস স্কুলে পড়, ছেলেদের স্কুলে শুধু ছেলে, আর মেয়েদের স্কুলে শুধু মেয়ে আর মেয়ে। তোমাদের নিয়ে দারুণ একটি ইংলিশ সিনেমা আছে। রকফোর্ড নামে আমেরিকার একটা বিখ্যাত শহর আছে জান তো? ১৯৯৯ সালে ‘রকফোর্ড’ নামের একটা ফিল্ম বের হয় ভারতে, ওটা ইউটিউবেই পাবে। রকফোর্ডে দেখবে বয়েজ স্কুলের ছেলেদের জীবনটা কেমন অদ্ভুত। মাত্রই বাড়ি ছেড়ে এসেছে তেরো বছরের একটা ছেলে, এসে সে পাল্লায় পড়ে নানা নিষিদ্ধ জিনিসের। মেধাবী সেই ছেলেটার জীবন গোল্লায় যায় আর কি। এ সময় একটা মেয়ে এসে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর কী হয় জানতে ঝটপট বসে যাও সিনেমাটা দেখতে।
তোমরা হয়তো চাচ্চু-কাকুদের কাছে এক ধরনের কয়েন গেমের কথা শুনে থাকবে। স্কুল পালিয়ে গেমের দোকানে গিয়ে কয়েন ফেলে এক ধরনের গেম খেলত তারা। লোকে ওটাকে মোস্তফা গেম বললেও ওটার আসল নাম ছিল ‘ক্যাডিলাক অ্যান্ড ডায়নোসরস’। তো গেমের চরিত্র নিয়েই বানানো হয়েছে ‘র্যাক ইট রালফ’ নামের একটি সিনেমা। ছবিটাতে কোনো মানুষের চরিত্র নেই। আছে গেমের চরিত্রগুলোর জীবন্ত হয়ে ওঠার কাহিনী। ভালো কথা, ইংরেজি ছবি শুরুতে সাবটাইটেলসহ দেখলে ভালো। তোমার ইংরেজিও পোক্ত হবে আর গল্পটা বুঝতেও সহজ হবে।
বিখ্যাত পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ ‘ইটি দ্য এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়াল’ নামের দুর্দান্ত একটি সায়েন্টিফিক মুভি বানিয়েছেন। ওখানে এলিয়েন-মানুষের বন্ধুত্ব কিভাবে হয় তা দেখায়, বন্ধুত্বে জাত-পাত-রাষ্ট্র-গ্রহ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নাÑ এই হলো ছবিটার মেসেজ। এরপর আর্থার সি ক্লার্কের গল্প অবলম্বনে ছবি ‘ডলফিন আইল্যান্ড’ ও ‘চাইল্ড অব দ্য সান’ও তোমার রুটিনে রেখো। ভয়ের গল্প বলতে জুড়ি নেই যে মানুষটির, তিনি হচ্ছেন স্টিফেন কিং। তার লেখা দ্য বডি গল্প থেকে ‘স্ট্যান্ড বাই মি’ নামে একটি ফিল্ম বানান বেন ই কিং। এই ফিল্মে আছে ভয় আর বন্ধুত্বের গল্প, গল্পটা অদ্ভুত। চার বন্ধু একটা ডেডবডির সন্ধানে নামে। তাদের একেকজন একেক ধরনের ফ্যামিলি থেকে আসে। এই বন্ধুদের কেউ হয়তো বস্তি থেকে এলো, কেউ বড় লোক ফ্যামিলি থেকে; আদৌ কি তারা সেই লাশ উদ্ধার করতে পেরেছিল? দেখে ফেল।
‘ফ্রি উইলি’ নামের একটি ছবি বানানো হয়েছে কিকো নামের এক তিমিকে কেন্দ্র করে। তিমিটা ধরা পড়েছে শিকারির জালে। তারপর এক বিশাল অ্যাকুরিয়ামে তাকে প্রদর্শনের জন্য রাখা হলো। সেখানে জেসি নামের এক মেয়ে তার বন্ধু হয়ে যায়। জেসি চায় তিমিটা আবার সমুদ্রে ফিরে যাক। কিন্তু কিভাবে ফিরে যাবে? সে এক মস্ত কাহিনী। দেখতে পার ‘ফ্রি উইলি টু : দ্য অ্যাডভেঞ্চার হোম’, ‘ফ্রি উইলি থ্রি : দ্য রেসকিউ’Ñ চাইলে তুমি এই কিকো নামের তিমিটিকে নিয়ে করা প্রামাণ্য চিত্র ‘কিকো : দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ও দেখে ফেলতে পার।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশকিছু ছবি সম্পর্কে জেনেছো উপরের বাংলা ছবির আলোচনায়। এবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে করা দারুণ এক ছবির নাম শোনো। ‘দ্য বয় ইন স্ট্রাইপড পাজামাস’, দ্যাখো বিভৎস এবং সুন্দর একটা কাহিনী। আরেকটা ছবির নাম তো তোমরা জানোই, ‘দ্য জাঙ্গল বুক’। এটা নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছ। না দেখলে সিলেবাসের প্রথমে রাখ এটা। ‘লাইফ অব পাই’ দেখেছ? না দেখলে এটাও রাখ রুটিনে। আর রাখ ‘দ্য লায়ন কিং’।
তোমাদের বয়সে একটি মেয়ে নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, মালালা ইউসুফজাই। পাকিস্তানি এ কিশোরীকে নিয়ে ‘গুল মাকাই’ নামের এক অসাধারণ ফিল্ম আছে। তোমাদেরকে আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি। জাতিসঙ্ঘ ১২ জুলাইকে ‘মালালা ডে’ ঘোষণা করেছে। তোমাদের বয়সী আরেকটা মেয়ে এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে। মাত্র ১৩ বছরের পূর্ণা মালাভাতের এভারেস্ট জয় করাকে নিয়ে একটা দারুণ ফিল্মও আছে ‘পূর্ণা’ নামে। দেখে ফেল আর স্বপ্ন আঁকো কবে পূর্ণার মতো বড় কিছু করতে।
এসো, তোমাদের সঙ্গে এবার ইরানি কিছু ছবি নিয়ে গপ্পোসপ্পো করি। তোমরা এর আগে নিশ্চয়ই ‘চিলড্রেন অব হেভেন’ (১৯৯৮) সিনেমার নাম শুনেছ। নির্মাতা মাজিদ মাজিদির ঝুলিতে অস্কার পুরস্কার এনে দেয় এই সিনেমাটি। এরপর থেকেই তিনি নিজের জগৎ তৈরি করতে থাকেন। ছোটদের জন্য নির্মান করতে থাকেন একের পর এক দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র। তার অন্য ছবিগুলোর মধ্যেÑ ‘দ্য কালার অব প্যারাডাইজ’ (১৯৯৯), ‘মুহাম্মাদ: দ্য ম্যাসেঞ্জার অব গড’ (২০১৫), ‘দ্য সং অব স্প্যারোস’, ‘দ্য উইলো ট্রি’ অন্যতম। সম্প্রতি এই গুণী নির্মাতা বাংলাদেশেও এসেছিলেন। শিশু-কিশোরদের জন্য তার কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। বলেন, ‘যাদের কথা কেউ শোনে না, চলচ্চিত্র তাদের কথা বলে।’
আরেকটি ইরানি ছবি হলো ‘হোয়াইট বেলুন’। এছাড়া আমির নাদেরির ‘দ্য রানার’ দেখতে পার। ইরানে বিপ্লবের ঠিক পরপর যুদ্ধ-সংঘাত-অস্থিরতা যে কিশোরদের মনে কী মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে তা দেখানো হয়েছে। মহামতি গৌতম বুদ্ধকে নিয়েও দারুণ এক ইরানি ফিল্ম আছে। ‘বুদ্ধ কলাপসড আউট অফ শাম’ নামে। এই ছবিটাও সুন্দর।
যে ছবিগুলোর কথা লেখা হলো এগুলো দেখতে তোমার স্রেফ ১২ মাস লাগবে। তুমি যদি মাজিদ মাজিদি, সত্যজিৎ রায় কিংবা মোরশেদুল ইসলামের মতো চমৎকার চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চাও তাহলে প্রতি সপ্তাহে একটা করে ছবি দেখে ফেল। ছবিগুলো থেকেই পেয়ে যেতে পার ঝিলিমিলিতে গল্প লেখার আইডিয়াও!
তোমাদের জন্য বিশাল আয়োজনে প্রতি বছর ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন ফিল্ম ফ্যাস্টিভাল হয়। সেখানে তোমার আইডিয়া পাঠিয়ে হয়ে যেতে পার বিশ্বসেরা। এখন তো সার্চ ইঞ্জিন গুগল তোমাদের হাতের মুঠোয়। আর ইউটিউব তো আছেই। তাহলে আর দেরি কেন? নেমে পড় চলচ্চিত্রের দুনিয়ায়।