ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

তাদের জন্য কিছু করতে না পারার আক্ষেপও ছিল

একাত্তরের বীরদের বঙ্গবন্ধু বলতেন লালঘোড়া 

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ৬ জুলাই ২০২৪; আপডেট: ০১:২০, ৭ জুলাই ২০২৪

একাত্তরের বীরদের বঙ্গবন্ধু বলতেন লালঘোড়া 

মাত্র ১২ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম লালুর লড়াইয়ের গল্প শুনে অভিভূত বঙ্গবন্ধু তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন

আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধকে বোঝা, ভেতর থেকে উপলব্ধি করা আসলেই একটু কঠিন। দেশমাতার প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া কোনো মামুলি ব্যাপার ছিল না। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেই আত্মত্যাগের কথা, লড়াইয়ের কথা ক’জন আর মনে রেখেছে? বরং দালালদের রাজাকারদের সন্তানরা নাতিপুতিরা সুযোগ পেলেই হুক্কাহুয়া ডাক দিচ্ছে। ডাক শুনে কিছু মানুষ বিভ্রান্তও হচ্ছেন। 
তবে যে মহান নেতার নামে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই শেখ মুজিবুর রহমান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। সম্মানের আসন দিয়েছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি বলতেন, ‘তোমরা আমার লালঘোড়া।’ এই লালঘোড়া দিয়ে দেশবিরোধীদের অন্যায়কারীদের প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন তিনি। 
১৯৭৩ সালের ২১ জানুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলনে বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নিজের গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন তুলে ধরেন তিনি। পুরনো পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা তোমরাই আমার লালঘোড়া। বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে তোমরা যেমন সর্বস্ব ত্যাগ করিয়াছ, আশা করি, আমি হুকুম দিলে তোমরা সমাজবিরোধী গাড়ি-বাড়ি হাইজ্যাককারী, চোর ডাকাতদের নির্মূল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করিবে।’ 
অর্থাৎ, যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে যখন অরাজকতা বাড়ছিল তখনো  বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিই আস্থা রেখেছিলেন তিনি। তাঁদের সহায়তা নিয়ে, শক্তি কাজে লাগিয়ে দেশ গঠন করতে চেয়েছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আসন কত উঁচুতে তা বোঝাতে একই মঞ্চে  শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যতদিন আছে, বাংলার ইতিহাস যতদিন থাকিবে, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের ইতিহাস ততদিন অবিস্মরণীয় গাথা হইয়া বিরাজ করিবে।’ 
১৯৭১ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনে অস্ত্র সমর্পণ করেন মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা। এই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু যে বক্তৃতা করেন সেখানেও রণাঙ্গনের বীরদের ত্যাগের কথা এসেছে। সমবেত বীরদের উদ্দেশ্যে  তিনি বলেন, স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের যুবকরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তাতে বাংলাদেশ জাতি সারা দুনিয়ায় চিরকাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি জানি, যে জাতি সংঘবদ্ধ হয়, মুক্তির জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, সে জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। 

কিন্তু বাস্তবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা তখন দিশেহারা। দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসেছেন বটে। অনেকের মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুও ছিল না। ছেলে যুদ্ধে গেছে জেনে পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা পুড়িয়ে দিয়েছিল ভিটেবাড়ি। কারও বাবাকে হত্যা করেছিল। কারও বোনকে ধর্ষণ করেছিল। এ অবস্থায় রণাঙ্গন থেকে ফেরা মানুষগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলেন। খাওয়ারও ঠিক ছিল না। কোনো কাজ ছিল না বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারগুলো।

মুজিব নিজেও তা জানতেন। কিন্তু সরকারপ্রধান নিজেও তো তখন রিক্ত। তাই নিজের বেদনার কথা, ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে পল্টনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আজ আপনাদের দেবার মতো আমার কিছুই নেই। আছে শুধু প্রাণঢালা ভালোবাসা। সে প্রাণঢালা ভালোবাসাই আজ আপনাদের দিচ্ছি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আপনাদের কাছে কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি জানি, যে জাতি সংঘবদ্ধ হয়, মুক্তির জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, সে জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। 
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আবেগ ভালোবাসা কত গভীর ছিল তা বিশেভাবে বোঝা গিয়েছিল ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। ওই দিন টাঙ্গাইলে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এক কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কোলে তুলে নেন তিনি। ১২ বছর বয়সী যোদ্ধা দেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক। নাম শহীদুল ইসলাম লালু। মুক্তিযুদ্ধের সময় লালু ছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীতে। একাধিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, তখন উচ্চতায় তিনি ছিলেন একটি রাইফেলের সমান।

তাই রাইফেল বাদ দিয়ে স্টেনগান চালনা এবং গ্রেনেড ছোড়ার প্রশিক্ষণ নেন তিনি। অত্যন্ত সাহসী কিশোর ছদ্মবেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্কারে ঢুকে পড়েন। তাঁর গ্রেনেড আক্রমণে একাধিক বাঙ্কার ধ্বংস হলে গোপালপুর থানা হানাদারমুক্ত হয়। অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে এসে তিনি তাঁর স্টেনগান জমা দিয়েছিলেন। এ সময় খুদে বীরকে আদর করার পাশাপাশি একেবারে কোলে তুলে নেন সরকারপ্রধান। 
বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কোলে তুলে নেওয়ার সেই ছবি এখনো ইন্টারনেটজুড়ে ছড়িয়ে আছে। ছবিতে ধরা পড়া মুহূর্তটির কী ব্যাখ্যা? এতকাল পর দেখে কী মনে হয়? জানতে কথা হচ্ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে। তার বক্তব্য : সাদা-কালো ঝাপসা ছবি। তবে এটি শুধু ছবি নয়। প্রতীকী অর্থ আছে। বঙ্গবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কোলে তুলে নেওয়ার মধ্যদিয়ে জাতিকে জরুরি একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।  তাঁদের যেন অমর্যাদা না হয় কোনোদিন। তাঁদের অবদান যেন কেউ কোনোদিন ভুলে না যায়। 
জাতির পিতা সময় পাননি। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে। ছিল আরও অনেক সীমাবদ্ধতা। নানা ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। ফলে স্বাধীনতার স্বাদ তৃণমূলের বীর যোদ্ধারা একদমই পাননি। অথচ সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রাষ্ট্র আজ যখন বীর মুক্তিযোদ্ধা-পরিবারগুলোর দায় শোধের ন্যূনতম চেষ্টা করছে তখনই ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে নির্লজ্জ রাজাকার আলবদরদের প্রজন্ম। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তকে তারা অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে।  
হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর লালঘোড়া বয়সের ভারে ন্যুব্জ এখন। কাউকে আর তাড়া করতে পারছে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম কি নির্বিকার থাকবে? ইতিহাস কি ক্ষমা করবে বিভ্রান্ত প্রজন্মকে? নিশ্চয়ই না।

×