ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১

‘কী চমৎকার দেখা গেল...’

বাপ-দাদার পেশা বহু কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ

গৌতম পান্ডে 

প্রকাশিত: ০০:০৯, ৬ জুলাই ২০২৪

বাপ-দাদার পেশা বহু কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ

গ্রামবাংলার এক সময়ের ঐতিহ্য বায়োস্কোপ এখনো আঁকড়ে রেখেছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন

‘আমি প্রায় ২০ বছর ধরে বায়োস্কোপ চালানোর সঙ্গে জড়িত। আমার পূর্ব পুরুষের এটাই ছিল পেশা। গ্রাম্য মেলা, এমনকি পাড়া মহল্লায়ও এক সময় বায়োস্কোপ দেখার জন্যে ভিড় পড়ে যেত। গ্রাম-গঞ্জের মেলায় এখন বায়োস্কোপ চালালে চালের দামও ওঠে না। অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। এই পেশা অনেকেই ছেড়ে দিয়েছে। এখনো আমি সেই পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি’ এসব কথা বলছিলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের বায়োস্কোপওয়ালা তাপস চন্দ্র মোদক।
‘কী চমৎকার দেখা গেলো/ তারা সবে চইলা গেলো/ ঢাকা শহর আইয়া পড়লো/ মীরজুমলার কামান দেখেন/ সদরঘাটের জাহাজ দেখেন/ ও দাদা দেখেন নজর কইরা ওইযে দেখা যাচ্ছে..। এসব চটকদারি কথার মালা আর সুরের বয়ান দিয়ে গ্রাম্য মেলা বা বাজারে শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষদের আকর্ষণ করত বায়োস্কোপ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বায়োস্কোপের ব্যাপক প্রচলন ছিল। কাঁধে বায়োস্কোপের বাক্স ঝুলিয়ে ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে যেতেন এর চালকরা। পেছন পেছন ছুটত শিশু-কিশোররা। চাল বা সামান্য কিছু টাকা দিলেই তাদের দেখাতেন বায়োস্কোপ। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। টেলিভিশন আসার পর থেকে বায়োস্কোপের গুরুত্ব কমতে শুরু করে। রঙিন টেলিভিশন, স্যাটেলাইট চ্যানেল বায়োস্কোপের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। বর্তমানে জাদুঘরে রাখার পরিস্থিতিতে এটি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না ‘বায়োস্কোপ’ নামের একটি ঐতিহ্য ছিল।
আধুনিক প্রযুক্তির দাপটে গ্রাম বাংলার মেলা ও হাট-বাজারে এখন আর বায়োস্কোপের দেখা মিলে না। এতে দেশ-বিদেশের নানা ঐতিহ্য স্থিরচিত্রে মাধ্যমে ইতিহাসের কথা জানতে পারত। বায়োস্কোপ দেখতে বায়না ধরত শিশু-কিশোররা। ক্ষণিকের জন্য হলেও গ্রামের সহজ-সরল মানুষেরা আনন্দ উপভোগ করত। কেউ আর ডিজিটাল যুগে এসে এই বায়োস্কোপ দেখতে চায় না। এমনকি কেউ খোঁজ-খবরও নিচ্ছে না বায়োস্কওয়ালার।
তাদেরই একজন ঢাকার কেরানীগঞ্জের তাপস চন্দ্র মোদক। প্রায় ২০ বছর ধরে বাপ-দাদার দেখানো বায়োস্কোপের ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন। বিভিন্ন মেলা বা অনুষ্ঠানে গিয়ে এখনো প্রেমজুড়ির সঙ্গে সঙ্গে সুর করে বলেন, এই যে মজা লাইগ্যা গেল কি চমৎকার দেখা গেল তাজমহল চইল্যা আইল, এই যে মজা লাইগ্যা গেল কি চমৎকার দেখা গেল টাইগার আইয়া পড়লসহ বিভিন্ন রকম মজাদার কথার গাঁথুনি।
তাপস চন্দ্র মোদক জানালেন, এটা দিয়ে এখন সংসার চালানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। গ্রাম-গঞ্জের মেলায় এখন আর তেমন দেখান না বায়োস্কোপ। কারণ সেখানে গেলে চালের দামও ওঠে না। শুধুমাত্র কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলে সেখানে যান। পূর্ব পুরুষের যে ঐতিহ্য ছিল তার একমাত্র পেশা, সেটাকে বাদ দিয়ে এখন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ইজিবাইক চালানো।
তাপস চন্দ্র মোদক জনকণ্ঠকে বললেন, আমি প্রায় ২০ বছর ধরে বায়োস্কোপ চালানোর সঙ্গে জড়িত। আমার দাদা শম্ভু নাথ চন্দ্র মোদক এটা দেখাতেন। এর আগে আমাদের আরেক ঐতিহ্য ছিল সার্কাস দেখানো। মূলত আমার পূর্বপুরুষ সার্কাসে খেলাধুলা করত। সেটাও এখন আর নেই। আমার দাদা বেঁচে নেই। এখন আমি সেই পারিবারিক ব্যক্তিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। মাঝেমধ্যে কোনো অনুষ্ঠানে বায়োস্কোপ দেখাই। মেলায় এখন তেমন চলে না। অনেক কষ্টে থাকা লাগে। এক জায়গায় নিয়ে বসলে চালের টাকাও হয় না। বড়জোর ২০০/৩০০ টাকা হয়। এ দিয়ে আমার পরিবার কি করে চালাব! পাশাপাশি ইজিবাইক চালাই। বায়োস্কোপ এখন আমার পেশা নাই। ঐহিত্যকে ধরে রেখেছি। এখন মেলাতে গেলে নিজের খোরাক হয় না। এতে দর্শকদের কি দেখান? এমন প্রশ্নের জবাবে তাপস বলেন, আমার বায়োস্কোপে আছে তাজমহল, বাংলার ঐতিহ্য কাঁঠাল, দোয়েল পাখি, ইলিশ মাছ, টাইগার, পুরনো রাজবাড়ী, ঢাকার নবাব বাড়ী, জয়দেবপুরের রাজবাড়ী, নাটোরের রাজবাড়ী, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, বাগের হাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, বঙ্গবন্ধুর ছবি, ইন্দিরাগান্ধী, ইয়াহিয়া খানসহ বহু রাজনৈতিক নেতা ও সংস্কৃতির মানুষ।  
বয়োস্কোপওয়ালা কুমিল্লার রহমত মিঞা। এক হাতে প্রেমজুড়ি বাজিয়ে অন্য হাতে বাক্সের চাবি ঘুরিয়ে স্থির চিত্র প্রদর্শন করে বেড়াতেন তিনি। বললেন, বাক্সের আতশ কাঁচে চোখ রেখে স্থিরচিত্র দেখে উৎফুল্ল হতো শিশু, কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষ। আমি বায়োস্কপে কী কী প্রদর্শন করা আছে, তা ছন্দে-নেচে গেয়ে তার বর্ণনা দিতাম। বর্ণনাটা এমন ছিল ‘এইতো দেখেন গোলাগুলি বাইজ্যা গ্যাছে, হাজার হাজার সৈন্য আছে, কত সৈন্য শহীদ হলো, ডানে-বামে লক্ষ্য করেন, এবারেতে দেখেন ভাল শহীদ মিনার কাছে আছে, এবারেতে দেখেন ভাল বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে।

এবারেতে দেখেন ভাল শেখ হাসিনা সামনে আছে, ইন্দিরাগান্ধী পাশে আছে, দেখেন কত বাহার আছে, এবারের দেখেন ভাল, কলকাতা শহর আছে, বড় লোকের বাড়ি আছে, হাইকোর্টের কাচারি আছে, এবারেতে দেখেন ভাল আমেরিকা শহর আছে, এক শ’ তলা বাড়ি আছে। এবারেতে দেখেন ভাল ভীষণ যুদ্ধ ব্যাইজা গ্যাছে, কত বিমান উড়া গেছে, কত বিমান পড়াই রইছে। এবারেতে দেখেন ভাল দিল্লীর শহর আছে। লন্ডন শহর দেখা যাচ্ছে, সারি সারি বিল্ডিং আছে, পাহাড় আছে, ঝর্ণা আছে, নবারের বাড়ি আছে, তাজমহল আছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। আর কত কি আছে, এবারেতে দেখেন ভাল ফাঁকা ময়দান পড়ে রইল’। রহমতের বাপ-চাচা ও দাদার পেশা এটি। রক্তের সঙ্গে মিশে আছে তার এ পেশা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আধুনিক যুগে এখন আর কেউ বায়োস্কোপ দেখতে চান না। টিভি, ডিশ, মোবাইল ফোন এসে যাওয়ায় এখন বায়োস্কপের কদর কমে গেছে। আগে বায়োস্কপে দেখানো হতো বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার ছবি, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, রাম লক্ষণের যুদ্ধ, স্বর্গ ও নরকের কাল্পনিক চিত্র, মক্কা ও মদীনাসহ আরও অনেক স্থিরচিত্র। তিনি জানান, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবিও পাল্টাতে হয়। বর্তমানে তার বায়োস্কোপে রয়েছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, তাজমহল, বিশাল অট্টালিকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছবি। ঝর্ণা, পাহাড় পর্বতের ছবি রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ছবি, কলকাতা শহরের ছবি ও হাইকোর্টের ছবি নানা দর্শনীয় স্থান। তার বায়োস্কোপ দেশের ঐতিহ্য। কিন্তু কারও সহযোগিতা পাচ্ছেন না তিনি। কেউ তাদের খোঁজ-খবরও নিচ্ছেন না।
বায়োস্কোপের মালিক নওশের আলী জানান, তার বাড়ি রাজশাহী জেলার বাগমারা থানার চাইসারা গ্রামে। দাদার আমল থেকে ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ প্রদর্শন করছেন তারা। সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে তৈরি করা হয় বায়োস্কোপ প্রদর্শনের চিত্র। বিনোদনের মাধ্যমে আয় করে প্রায় ৪০ বছর যাবত সংসার চালাচ্ছেন তিনি। স্ত্রী দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। আগে সব বয়সের মানুষ দেখত বায়োস্কোপ। এখন আর আগের মতো দেখে না। এখন শুধু বাচ্চারা একটু দেখে। আগের মতো চলে না তাই তার চাচারা বায়োস্কোপ বন্ধ করে দিয়েছে। শুধুমাত্র বাপ দাদার স্মৃতির জন্যই ঐতিহ্যবাহী এই বায়োস্কোপ ধরে রেখেছেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন মেলায় বায়োস্কোপ দেখান তিনি। হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, লোকজ উৎসবে আমাকে ডাকা হয় না। খোঁজ খবর নিয়ে আমিই স্যারদের ফোন করি আসার জন্য। বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর জন্য ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কোনো সম্মানী দেওয়া হয় না।

×