ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১

ব্রাহমা জাতের গরু কি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ?

প্রকাশিত: ১২:১৯, ৩ জুলাই ২০২৪

ব্রাহমা জাতের গরু কি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ?

ব্রাহমা জাতের গরু।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিতর্ক চলছে ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি ও পালন নিষিদ্ধ কি না। সম্প্রতি এক ঘটনায় এ আলোচনা আরও বেড়েছে। সরকারি আইন-কানুনের পাশাপাশি অভিজ্ঞজনরাও বলছেন, ব্রাহমা নিষিদ্ধ নয়। তবে দেশে দুধের উৎপাদন যেন না কমে সেজন্য এটি বাণিজ্যিকভাবে লালন-পালনে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
 
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২০২৪-র অনুযায়ী, আদেশের ৩৪ ধারায় গবাদিপশুর হিমায়িত সীমেন (এইচএস হেডিং ০৫.১১ এর অধীন শ্রেণিবিন্যাসযোগ্য) আমদানি বিষয়ে জানানো হয়েছে। ক-উপধারায় দেখা যাচ্ছে, (ক) গবাদিপশুর হিমায়িত সীমেন ও এমব্রায়ো, ফ্রিজিয়ান, ফ্রিজিয়ান ক্রস, শাহিওয়াল, শাহিওয়াল ক্রস, ফ্রিজিয়ান-শাহিওয়াল ক্রস, এএফএস, এএফএস ক্রস জাতের গবাদি পশুর হিমায়িত সীমেন (ডিপ ফ্রোজেন সীমেন) ব্যতীত অন্যান্য গরুর সীমেন আমদানি নিষিদ্ধ। তবে শর্ত থাকে যে, ফ্রিজিয়ান, ফ্রিজিয়ান ক্রস, শাহিওয়াল, শাহিওয়াল ক্রস, ফ্রিজিয়ান-শাহিওয়াল ক্রস, এএফএস, এএফএস ক্রস, ব্রামাহ, মুরাহ, নিলিরাভি এবং Mediterannean মহিষের জাতের গবাদি পশুর হিমায়িত সীমেন (ডিপ ফ্রোজেন সীমেন), এমব্রায়ো আমদানি করা যাইবে। অর্থাৎ এই নীতি আদেশে ব্রাহমা জাতের গরুর সীমেন আমদানিতে কোনো বাধা দেওয়া নেই। 

২০১৬ সালে করা বেসরকারি পর্যায়ে গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনার সংশোধিত নীতিমালাতে সীমেন আমদানি ও ব্যবহারে শর্ত জুড়ে দেওয়া থাকলেও কোথাও উল্লেখ করা হয়নি বাংলাদেশে ব্রাহমা গরু নিষিদ্ধ বা ব্রাহমার সীমেন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। ২০০৭ সালের জাতীয় প্রাণিসম্পদ নীতিমালাতেও ব্রাহমাকে নিরুৎসাহিত করার মতো কিছু লেখা নেই।

এর মধ্যে আবার ২০১৩ সালের জুলাইয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২৫ কোটি ৫৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল কীভাবে টেকসই মাংস উৎপাদনকারী গরুর জাতের উন্নয়ন করা যায় আর সেই সঙ্গে কর্মংস্থানের একটি সুযোগ তৈরি করা যায়। ৩৮টি জেলার ৮০টি উপজেলায় চালানো হয় ওই প্রকল্প। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও কিছুটা বরাদ্দ ও সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। 

ওই সময়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আইনুল হক ওই প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্রাহমা জাতের গরুর লালন পালন কতোটা বা কেন দরকার প্রসঙ্গে লেখেন, বাংলাদেশে ইতোপুর্বে একটি টেকসই, লাভজনক এবং অধিক মাংস উৎপাদনকারী গরুর কোন জাত না থাকায় চাহিদার তুলনায় প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন অত্যক্ত কম ছিল। ইতোমধ্যে দেশ মাংসে স্বয়ংসম্পুর্ণতা অর্জন করেছে। এখন প্রয়োজন এর ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখা। একটি দেশিয় গরুর প্রাপ্ত বয়সে মাংস উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে মাত্র ৭০-৮০ কেজি, সেখানে ব্রাহমা জাতের একটি প্রাপ্ত বয়স্ক (২০-২৪ মাস) গরুর মাংস উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ৭০০-৮০০ কেজি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। তাই, মাঠ পর্যায়ের কৃষক/খামারীদের মধ্যে ব্রাহমা জাতের গবাদিপশু পালনে আগ্রহ ও উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এই প্রকল্পটি পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে ২-৩ বছর বয়সে একটি গরুর ওজন প্রায় ২৭ মণ বা ১ মেট্রিক টন পর্যন্ত হতে পারে। সঠিক মাত্রায় খাদ্য প্রদান করলে বাংলাদেশে একটি ব্রাহমা জাতের বাছুর দৈনিক গড়ে ৯০০-১০০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি পায়।

ব্রাহমা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ ইমরান জানান, বাংলাদেশের কোনো আইন ও নীতিমালার কোথাও ব্রাহমা জাতের গরু লালন পালন, সীমেন আমদানি ও বিধি মেনে ব্যবহারেও বাধা দেওয়া হয়নি। তবে, কেন যেন এই জাতের গরু লানন-পালন সম্প্রসারণে বাধা দেওয়া হয় মানে নিরুৎসাহিত করা হয়। যদিও তিনি দাবি করেন, এই জাতটির আদি নিবাস যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশ তাই বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য বেশ উপযোগী। এমনকি ফ্রিজিয়ান জাতের গরু পালতে যেখানে তুলনামূলক ঠাণ্ডা আবহাওয়া তৈরিতে খামারিকে ফ্যান-এসি চালাতে হয় সেখানে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও স্বাভাবিক থাকে ব্রাহমা।

এ পরিস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো আইনেই ব্রাহমা গরু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। তবে আমদানিতে কঠোরতা আছে। নিষিদ্ধ না হলে কেন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এ জাতকে- এর জবাবে ডা. রেয়াজুল বলেন, দেশি গাভীতে ব্রাহমার শুক্রাণু দিয়ে প্রজনন ঘটানো হলে যেসব ফিমেইল ক্যাটল জন্ম নেয়, সেগুলো থেকে কোনো দুধ পাওয়া যায় না। এখানেই দুধের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে সররকার প্রকল্প থেকেও সরে আসে। দুধও দেবে, মাংসও দেবে এমন জাতের গরু চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০ থেকে ২৪ মাসে একটি দেশি গরুর মাংস উৎপাদন ক্ষমতা যেখানে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ কেজি; সেখানে ব্রাহমা থেকে পাওয়া যায় ১০ গুণ বা তারও বেশি। এর আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০টি ব্রাহমা গরু আমদানি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেইরি সান প্রাইভেট লিমিটেড। প্রথমে বাজেয়াপ্ত ও পরে সেটি খালাস করা হয়। আমদানিকারক বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে যান। হাইকোর্ট ‘আমদানি নিষিদ্ধ নয়’ বলে আদেশ দেন। 

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘খামারিকে স্বপ্ন দেখিয়ে কার স্বার্থে আবার প্রকল্প বন্ধ করা হলো, সেটিও খোঁজা দরকার। প্রকল্পের অধীনে ছড়িয়ে পড়া ব্রাহমা গরুর ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে প্রাণিসম্পদ খাতে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তা ঠেকানো না গেলে কয়েক বছরের মধ্যেই বিপর্যয় নামতে পারে। এতে কমতে পারে সার্বিক মাংস উৎপাদন।’

এম হাসান

×