ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১

চোখ রাখুন অনিন্দ্য সুন্দর চালতায়

বৃষ্টিস্নাত যে ফুল বর্ষা চেনায়, মুগ্ধ করে

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ১ জুলাই ২০২৪

বৃষ্টিস্নাত যে ফুল বর্ষা চেনায়, মুগ্ধ করে

অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে রাজধানীর বলধা গার্ডেনে ফুটেছে চালতা ফুল

ফুলের কথাই বলব। তার আগে একটু দুর্নীতির কথা বলে নেওয়া যাক। এই ইস্যুতে প্রচুর কথা হচ্ছে এখন। আমরা দেখছি একটু সুখী হতে, একটু আনন্দে কাটাতে দিব্যি ‘ছাগলকা-ে’, মানে, চুরি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ। অথচ ভালো থাকার জন্য, মনটাকে তাজা রাখার জন্য সর্বগ্রাসী হওয়ার আবশ্যকতা নেই। বরং অতি অল্পতেও সুখী হতে পারে মানুষ। আন্দোলিত হতে পারে। বর্ষা শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজতে হবে না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিন। বৃষ্টির ফোঁটা এসে হাতের তালুতে পড়ুক। দেখবেন রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি হচ্ছে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দটাও কান পেতে শুনুতে পারেন। নিশ্চিত বলতে পারি, একটা সুখানুভূতি অপনার ভেতরে হবে। 
এবার মূল আলোচনায়, অর্থাৎ, ফুলের আলোচনায় ফিরি। নানা জাতের ফুল ফুটে আছে এখন। বিশেষ করে বলতে পারি চালতা ফুলের কথা। বর্ষার এটি অন্যতম সেরা দান। কদমের পর চালতা ফুল দিয়েই বর্ষাকে চেনা যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একসময় বিপুল পরিমাণে চালতা গাছ দেখা যেত। এখন কিছুটা বিরল। তবে ফুলপ্রেমীদের মুগ্ধ করে রেখেছে আগের মতোই।

নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, আমি চ’লে যাব ব’লে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে...। কবি আর নেই। চলে গেছেন চিরতরে। তবে তার প্রিয় চালতা ফুল একইভাবে ফুটছে। কবি দেখতে পারছেন না। তাই কবিতায় সেই বিচ্ছিন্নতার কষ্টের কথা আগাম লিখে গিয়েছিলেন। একই রকম মুগ্ধতা নিয়ে বিষ্ণু দে লিখেছিলেন: আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে/চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে...। 
চালতার আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কিছু দেশে হয়। বিশেষত এটি ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। এ কারণেই বৈজ্ঞানিক নাম ডিলেনিয়া ইন্ডিকা। ইন্ডিকা শব্দটি ইন্ডিয়া থেকে নেওয়া। আর ডিলেনিয়া নামটি নেওয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত তরুবিদ জে জে ডিলেনিয়াসের নাম থেকে। চালতার ইংরেজি নাম এলিফ্যান্ট এ্যাপেল। বাংলাদেশে চালতাকে চালিতা চাইলতে ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
চালতা ফুলের সাদা পাঁচটি পাপড়ি। বেশ মোটা ও মাংসল। গোলাকার ফুলের পরাগকেশর অসংখ্য। দৃষ্টিনন্দন ফুল কয়েকটি পর্যায়ে নিজেকে বিকশিত করে। ক্রমে বাড়তে থাকে সৌন্দর্য। পাতার সৌন্দর্যও বলে শেষ করা যাবে না। আয়তাকৃতি পাতার খাঁজকাটা আউটলাইন। করাতের দাঁতের মতো  দেখতে। ভয়ঙ্কর নয় মোটেও। মনে হয়, কেউ কাঁচি দিয়ে কেটে চমৎকার নক্সা করে দিয়েছে। পাতার শিরা উঁচু। সমান্তরাল। গ্রামে বাসা বাড়ির পেছনে ঝোপ জঙ্গল থেকে উঁকি দিচ্ছে চালতা গাছ।

চালতার কথা উঠলে তাই গ্রামের কথা মনে পড়ে যায়। শহরের সৌন্দর্য বাড়াতেও চালতা গাছ লাগানো হয়। রাজধানী ঢাকায় বেশ কিছু গাছ আছে। মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেনে আছে। আছে শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরের পেছনের অংশে। জাদুঘরের পুকুর ঘিরে বেশ কয়েকটি গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বেইলি রোড সংলগ্ন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ ভবনের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে আছে একটি গাছ। অনুসন্ধিৎসু হলে দেখা যাবে আরও। 
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা মতে, মধ্যমাকৃতি চিরহরিৎ বৃক্ষ চালতা। উচ্চতায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। শাখা-প্রশাখা এলোমেলো। বাকল লালচে মসৃণ। গাছের আয়ু মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ বছর। পাতা ৮ থেকে ১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ হয়। বছরের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল ফুটে। ফুলের ব্যাস হয় ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। বৃতির সবুজ, দলের শুভ্রতা, পরাগের হলুদ ও তারকাবৃতি গর্ভমু- সব মিলিয়ে চালতা ফুলের গড়ন অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
ফলের জন্যও পরিচিতি আছে চালতার। এর বৃতিই এক সময় ফলে রূপান্তরিত হয়। টক স্বাদের ফল গ্রামীণ নারীরা ভীষণ পছন্দ করেন। লবণে মেখে নিয়ে গল্প করতে করতে খান। শরৎ হেমন্ত ফল পাকার সময়। শীতকাল পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। চালতার ফল হয় টক মিষ্টি। আচার, চাটনি, টক ডাল রান্নায় ব্যবহৃত হয়। পাকা ফল পিষে নিয়ে লবণ কাঁচামরিচ দিয়ে মেখে খাওয়া যায়। চালতার শাঁস নানা খাদ্যে ব্যবহার করা হয়। জেলি ও শরবত তৈরি হয় চালতা ফল থেকে। চালতার শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি হয় নৌকা। তবে শুরুতে যে সুখ শান্তির কথা বলছিলাম, সেটা দিতে পারে কেবলই ফুল। তাই অনিন্দ্য সুন্দর চালতার ফুলেই চোখ রাখুন এখন।

×