ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ ঘিরে মিলনমেলা

পাঁচশতাধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ, একাত্তরকে জানার সচেতন চেষ্টা

জনকণ্ঠ ফিচার

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৯ জুন ২০২৪; আপডেট: ০১:৪৭, ৩০ জুন ২০২৪

পাঁচশতাধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ, একাত্তরকে জানার সচেতন চেষ্টা

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শনিবার আলী জাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়

কেউ যখন বই পড়ে না, সবাই যখন ফেসবুকে ব্যস্ত তখন পাঁচ শতাধিক পাঠকের বিরল এক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রাজধানী ঢাকায়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এই পাঠকেরা মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা নির্বাচিত বই মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। পড়েই ক্ষান্ত হননি। লিখেছেন পাঠপ্রতিক্রিয়া। কেমন ছিল পড়ার অভিজ্ঞতা, বইয়ের কোন অংশটি ভেতরে বিশেষভাবে দাগ কাটল, কতটা জানা গেল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে- এই বিষয়গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন তারা।

ঢাকার তো বটেই, বাইরের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় অবস্থিত প্রায় অর্ধশত পাঠাগারের মাধ্যমে বই বিতরণ ও পাঠপ্রতিক্রিয়া সংগ্রহের প্রশংসনীয় কাজটি করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। অত্যন্ত সুচিন্তিত এ প্রয়াস যার নামে, তিনি দেশবরেণ্য নাট্যজন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রগতিশীল কর্মবীর আলী যাকের। প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসে পরিচালিত হচ্ছে ‘আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ উদ্যোগ।’

এবারের উদ্যোগে অংশ নিয়ে সারাদেশ থেকে সেরা নির্বাচিত হয়েছেন ৩০ জন। বিকেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাদের সকলকে পুরস্কৃত করা হয়। বাকিদের হাতেও তুলে দেওয়া হয় সনদ। সবশেষে ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। বই এবং মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে এমন আনন্দ আয়োজন সত্যি বড় আশাবাদী করেছে। 
বিকেলে আলী যাকেরের স্মৃতির প্রতি সঙ্গীতাঞ্জলি জানিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ গেয়ে স্মরণ করা হয় তাকে। পরে ছিল ‘কুণ্ঠে বাহে’ কবিতার আবৃত্তি নির্ভর ভিডিওচিত্র। এপারে থেকে আসাদুজ্জামান নূর যখন তার অনবদ্য আবেগী কণ্ঠে ওপারে থাকা আলী যাকেরকে খুঁজছিলেন তখন অনেকেই চোখে জল ধরে রাখতে পারেননি। ছোট্ট এবং ধ্রুপদী স্মরণ শেষে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী।

জাদুঘরের পক্ষে ছিলেন ট্রাস্টি আসাদুজ্জামান নূর, ডা. সারওয়ার আলী, মফিদুল হক ও সারা যাকের। আলী যাকেরের পরিবারের পক্ষে মঞ্চে ছিলেন সন্তান ইরেশ যাকের। অন্যদের মধ্যে জুরি বোর্ডের সদস্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর, নিশাত মজুমদার, গ্রন্থপাঠ উদ্যোগ-এর সমন্বয়ক মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মঞ্চে উপস্থিত বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বরা বিজয়ীদের প্রত্যেকের হাতে পাঁচ হাজার টাকার বই ও সমমানের অর্থ পুরস্কার তুলে দেন। এ ছাড়াও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক পাঠককে সনদ প্রদান করা হয়। 
এ সময় বক্তারা বলেন, সমাজে এখন অনেক রকম হিংসা বিদ্বেষ দুর্নীতি। নানা অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছেলে মেয়েরা এখন ফেসবুক টিকটকে বেশি সময় দেয়। বই পড়তে চায় না। অথচ বই আমাদের মনের জানালা খুলে দেয়। খোলা জানালা দিয়ে আলো বাতাস ঢুকতে পারে। তাই বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। জিপিএ ফাইভ ইস্যু তুলে ধরে তারা বলেন, এটা এক ধরনের নির্যাতন।

জিপিএ ফাইভের পেছনে ছুটতে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের মস্তিষ্ক শুকিয়ে যাচ্ছে। শুকনো মস্তিষ্ক দিয়ে ভালো কিছু সম্ভব নয়। বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করার তাগিদ দেন বক্তারা। বলেন, বই পাঠ ধর্মান্ধতা রক্ষণশীলতা সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি দেয়। আমাদের ইতিহাসকে মুক্তিযুদ্ধকে জানতে হলে বই পড়তে হবে। 
বদলে যাওয়া বাস্তবতায় বই যারা পড়েন তাদের পাগল টাগলও ভাবেন অনেকে। আলী যাকেরও এমন পাগল ছিলেন জানিয়ে তার সন্তান অভিনেতা ইরেশ জাকের এই পাগলদের জয়গান করেন। বলেন, পাগলামী চলবে। এ সময় করতালির মাধ্যমে তার বক্তব্যকে স্বাগত জানান ক্ষুদে পাঠকেরা। 
এদিন স্কুল পর্যায়ে পুরস্কার লাভ করেন  ফারিহা ইসলাম ঐশী, আছিয়া আক্তার মীম, সালসাবিল বিশ্বাস, অপরাজিতা সাহা, সামিয়া আক্তার, মিথিলা হেহেজাবিন, মাবরুকা আক্তার মিন্না, আলী আশরাফ, রিহাম নুসাইবা বর্ণ, নিলীমা খান। 
কলেজ পর্যায়ে পুরস্কার জেতেন তামজিদ তাহসিন, প্রযুক্তা রায়, প্রতিভা রাণী দাশ, ইহসানুল হক সিয়াম, জান্নাতুল ফেরদৌসী, অনির্বাণ দাস, রায়মা আক্তার রিতু, শেখ ফাইজা, সিদরাতুল মুনতাহা প্রথমা এবং নূর নাহার আক্তার নেহা। 
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পুরস্কার পান মমতাজ আক্তার, জাকিয়া বেগম, ইশরাত জাহান লিয়া, সাদিয়া নাজনীন, আশরাফুল ইসলাম, মায়িশা বিনতে কালাম, নিয়াজ আরেফিন, রেজওয়ানা পারভীন, মরিয়ম আক্তার এবং শামসি আরফিন শমি। 
তিন বিভাগে সেরা পাঠকদের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে ফারিহা ইসলাম ঐশী বলেন, বই পড়া আমার শখ। সেই শখ বৃথা যায়নি। ব্যর্থ হয়নি। আজকের পুরস্কার তার প্রমাণ। বই পাঠ অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেন তিনি। 
২০১৯ সাল থেকে ‘আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ উদ্যোগ’ শুরু হয়। এই উদ্যোগে সহায়তা করছে মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশন। দ্বিতীয়বারের মতো তিন মাসব্যাপী বইপাঠ কর্মসূচির সূচনা হয় ২০২৩ সালের নভেম্বরে। প্রতিটি গ্রন্থাগারে নির্বাচিত তিনটি বইয়ের পাঁচটি করে সেট দেওয়া হয়। স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পাঠের জন্য নির্বাচন করা হয় আহসান হাবিব রচিত ‘৭১-এর রোজনামচা’, কলেজ পর্যায়ে শেখ তাসলিমা মুন রচিত ‘আমি একটি বাজপাখিকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম’ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক রচিত ‘জীবন আমার বোন’।

ঢাকা মহানগর ও সারাদেশ থেকে নির্বাচিত ৪৬টি পাঠাগার থেকে স্কুল, কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গ্রন্থ পাঠ শেষে প্রতিক্রিয়া জমা দেন। মোট জমা পড়ে ৫৪৮টি পাঠপ্রতিক্রিয়া। এগুলোর মধ্য থেকে সাংবাদিক আবু সালেহ রনি, ঝর্ণা মনি এবং মোরসালিন মিজানকে নিয়ে গঠিত নির্বাচক কমিটি প্রাথমিকভাবে খাতা দেখে সেরা পাঠকদের একটি তালিকা তৈরি করেন।

আরেক দফা পরীক্ষা করে তালিকা চূড়ান্ত করেন  মিনার মনসুর, অধ্যাপক ড. মিল্টন কুমার দেব এবং পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার। জুরিদের দেওয়া নম্বরের ভিত্তিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রতি বিভাগে সেরা দশজনের প্রত্যেককে পুরস্কৃত করা হয় অনুষ্ঠানে।

×