ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

আজ মধু কবির মৃত্যুদিন

তার আকাক্সক্ষা ছিল মানুষের মাঝে অমর হয়ে থাকা

​​​​​​​সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ২১:৫৭, ২৮ জুন ২০২৪

তার আকাক্সক্ষা ছিল  মানুষের মাঝে  অমর হয়ে থাকা

যশোরের সাগরদাঁড়িতে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি

জীবনের পড়ন্ত বেলায় আশার ছলনায় ভুলে মাইকেল কী ফল লাভ করেছিলেন? কিন্তু সারা জীবন তার প্রত্যাশা এক ছিল না। তরুণ বয়সে তার অগ্রাধিকার ছিল কবি হয়ে যশ লাভ করার, এমন কি, নীল নয়নার প্রেম লাভ করার। তবে অর্থস্বাচ্ছন্দ্য এবং আদরের মধ্যে মানুষ হন বলে সেই তরুণ বয়স থেকে বস্তুগত ভোগ এবং সুখের প্রতিও তার লোভ কিছু কম ছিল না। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসঙ্গতিও দেখা দিতে আরম্ভ করে সেই হিন্দু কলেজের আমল থেকে। বিয়েকে কেন্দ্র করে বাবা মার সঙ্গে তার মতানৈক্য থেকে তার হতাশার সূচনা। আর কাক্সিক্ষত ভোগ-সুখে ঘাটতি পড়েছিল বিশপস কলেজ ত্যাগ করার আগে থেকেই। কিন্তু সাহিত্যিক হয়ে ইংরেজি সাহিত্যের আসরে স্থান পাওয়ার স্বপ্ন তখনো ভেঙে যায়নি। সেই আঘাতটা এসেছিল ক্যাপটিভ লেডি প্রকাশের পর। তবে তখনো হতাশা এসেছিল সাময়িকভাবে। কলকাতায় এসে বাংলা সাহিত্যের দরবারে রাতারাতি একেবারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি এবং নাট্যকার বলে স্বীকৃতি লাভের পর আগেকার হতাশা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগেনি। অতঃপর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর কবি নিজেকে কখনো কখনো কালিদাস, ভার্জিল, এমন কি মিল্টনের সমকক্ষ বলেও মনে করেছেন।

বস্তুত, যতদিন যশের তুঙ্গে উঠতে পারেননি, যতদিন তার সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, ততদিন তিনি গুরুত্বের সঙ্গে সাহিত্য সাধনা করেছিলেন। কিন্তু মাত্র চার বছরের মধ্যে যখন তার সামনে আর কোনো সাহিত্যিক লক্ষ্য থাকল না, যা কিছু প্রত্যাশা করেছিলেন, তার সবই সহজে অর্জন করলেন, তখন তিনি তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেলেন। বিশপস কলেজের অন্যতম অধ্যাপক তরুণ মাইকেল সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, মিশনারি হবার আকাক্সক্ষা তার মধ্যে কত প্রবল, বস্তুগত ভোগের লোভে তিনি সেটা বুঝতে পারছেন না।

একই রকম বলা যায় যে, সাহিত্য রচনা করে কেবল যশ লাভ করা নয়, সাহিত্যের প্রতি তার সত্যিকার প্যাশন কত জোরালো, ধনী হওয়ার লোভে তিনি তারও পরিমাপ করতে পারেননি। নয়তো ব্যারিস্টারি পড়ার কথা তিনি ভাবতেন না। এমন কি, সোনার হরিণের লোভে তিনি যখন ব্যারিস্টার হয়েছেন, তখনো আদালতের মতো -কাব্যিক স্থানেও তিনি বার বার আইনের বদলে তার সহজাত প্রেম যে সাহিত্যের প্রতি তা প্রমাণ করেছেন। বস্তুত, তিনি কেবল কবি নন, তিনি মনেপ্রাণে কবি। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন: যার ভাগ্য-সরোবরে মা কমলা সোনালি আলোতে কমলিনী-রূপে বিরাজ করেন না, পৃথিবীতে তার জন্ম কুক্ষণে হয়েছে-এমনটা মনে করা কারণ নেই। কারণ, কল্পনারূপ খনির মধ্য থেকে রতœ কুড়িয়ে এনে নিজের ভাষাকে যে সাজায় এবং ভাষার অঙ্গ-শোভা বৃদ্ধি করে, তার ধন কেউ কেড়ে নিতে পারে না, সে অমরত্ব লাভ করে। তিনিবড়ো লোকে মতো জীবনযাপন করতে চেয়েছেন, ঠিকই, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় আকাক্সক্ষা ছিল; তিনি মানুষের মাঝখানে অমর হয়ে থাকবেন। যা লিখেছেন, তা দিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন কিনা, সে চিন্তা তাই তাকে বার বার ভাবিত করেছে। তাই লিখেছেন-লিখিনু কি নাম মোর বিফল যতনে/ বালিতে, রে কাল, তোর সাগরের তীরে?/ ফেন-চূড় জল-রাশি আসি কি রে ফিরে,/ মুছিতে তুচ্ছেতে ত্বরা মোর লিখনে?/ অথবা খোদিনু তারে যশোগিরি-শিরে,/ ঘুণ-রূপ যন্ত্রে কাটি অক্ষর সুক্ষণে,-/ নারিবে উঠাতে যাহে, ধুয়ে নিজ নীরে,/ বিস্মৃতি, বা মলিনিতে মলের মিলনে?-

মনের মধ্যে সন্দেহ উঁকি দিলেও, কবি আশা করেছেন, উত্তর-কাল তাকে মনে রাখবে। অন্তত, তিনি সেই প্রার্থনাই জানিয়েছেন- ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে। বিলাসী জীবন যাপনের সাধনায় যদি প্রমাদ ঘটে, তবু তোমার মনের লাল পদ্মটিকে মধুহীন কোরো না।সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তিনি প্রমাদ ঘটিয়েছেন, বিলেত যাত্রার প্রাক্কালে লেখা তার এই কবিতায় তিনি নিজেই সে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তবে কত বড় ভুল করেছিলেন এবং পরে আরও বহু ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে সে ভুলকে কত বিশাল করে তুলেছিলেন-সেটা একেবারে শেষ মুহূর্তের আগে পর্যন্ত অনুভব করেছিলেন বলে মনে হয় না। এই প্রমাদের জন্যে এবং তিনি যে-এক সময়ে ভিন ধর্ম গ্রহণ করে প্রমাদ ঘটিয়েছিলেন, তার জন্যে বঙ্গ সমাজও সাময়িকভাবে তার প্রতি কম অবহেলা দেখায়নি। যে- অযত্নে মধ্যে তিনি মারা যান, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার তুলনা কমই আছে। মারা যাবার পর, বঙ্গসমাজ তার প্রতি যে- অবজ্ঞা এবং উদাসীনতা দেখায়, সে- বিরল। জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে কোনো কোনো কবি কাক্সিক্ষত যশ লাভে ব্যর্থ হন সে সম্পর্কে কবি নিজেও সচেতন ছিলেন। জীবিতাবস্থায় অনাদৃত কবিদের সম্বন্ধে তার বক্তব্য সুবিদিত। কবিতা লেখার সময়ে তার নিজের ভাগ্যের কথাও তিনি ভেবে থাকবেন।

ইতিহাস কথা কাঁদিয়া সদা বলে,/জন্মভূমি ছেড়ে চল যাই পরদেশে।/ উরুপায় কবিগুরু ভিখারী আছিলা/ ওমর (অসংখ্য কালে জন্ম তার) যথা অমৃত সাগরতলে। কেহ না বুঝিল/ মূল্য সে মহামণির; কিন্তু যম যবে/ গ্রাসিল কবির দেহ, কিছু কাল পরে/ বাড়িল কলহ নানা নগরে; কহিল/ নগর নগরে, ‘আমার উদরে/ জনম গ্রহিয়াছিল ওমর সুমতি।

কবি হিসেবে ঈশ্বর গুপ্তকে গভীর শ্রদ্ধা করার কোনো কারণ দেখেননি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ঈশ্বর গুপ্ত যে-জগতে বাস করতেন আর তার জগৎ- দুই ছিল একবারে আলাদা। তা সত্ত্বেও, ঈশ্বর গুপ্ত মারা যাবার পরে তার স্মৃতি রক্ষার জন্যে বাঙালিরা যে কিছুই করেননি, সে কথা বলে তিনি আক্ষেপ করেছেন। দেশের প্রতি হরিশ মুখার্জির অবদানের কথা চিন্তা করে তার অকাল মৃত্যুর পর কবি তার একটি স্ট্যাচু নির্মাণের জন্যে ওকালতি করেছিলেন। বিধবা বিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের অবদানের কথা মনে রেখে বলকাতার লোকেরা যখন শ্রদ্ধা নিবেদন করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তখনো তিনি তার জন্যে এক মাসের বেতন চাঁদা হিসেবে দিতে তৈরি ছিলেন। যিনি এভাবে অন্যের কীর্তির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যে উদগ্রীব ছিলেন, সেই কবির দুর্ভাগ্য যে, তার মৃত্যুর পরে তার কবরের ওপর একটি মানানসই স্মৃতিসৌধ তৈরি করার ব্যাপারে সাহিত্যামোদিরা তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেননি। অথচ সে সময়ে বাঙালিদের মধ্যে শিক্ষিত এবং ধনী লোকদের অভাব ছিল না। শ্রাদ্ধতে লাখ টাকা ব্যয় করা, অথবা লাখ টাকা দিয়ে রক্ষিতা রাখার ঘটনা ওই শতাব্দীতেই ঘটেছিল। তার মৃত্যুর বারো-চৌদ্দ বছর পরে যারা তার স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারা কেউ বাংলা সাহিত্যোকাশের গ্রহ-তারা-নক্ষত্র ছিলেন না। তাদের উদ্যোগ নেওয়ার কারণ কবির সঙ্গে তাদের এক কালের বন্ধুত্ব। তার বন্ধুর সংখ্যা যে একেবারে কম ছিল, তাও নয়। তবে সব বন্ধুই তার স্মৃতি রক্ষার ব্যাপারে এক রকমের ধারণা পোষণ করতেন না। যে-বিদ্যাসাগর-কবির ভাষায় তাকেনিজ হাতে টেনে তুলেছিলেনবিপদের সাগর থেকে, এক জীবনীকারের মতে, সেই বিদ্যাসাগরের কাছে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্যে যখন চাঁদা চাওয়া হয়, তখন তিনি তা দেননি। তিনি নাকি দুঃখ করে বলেছিলেন, যাকে জীবদ্দশায় রক্ষা করতে পারেননি, তার স্মৃতিসৌধ তৈরিতে কিছু দেওয়া অর্থহীন।

মাইকেল খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে এবং স্বসমাজ ত্যাগ করে ইংরেজ সাজতে চেষ্টা করেছিলেন এবং শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে ঘর করেছিলেন-আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়-তার এইঅপরাধে কারণে বাঙালিরা তার প্রতি সহানুভূতি হারিয়েছিলেন। নয়তো, বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যে তিনি যে-অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন, তাতে তাকে নিয়ে বাঙালিরা অনেক বেশি গর্ব করতে পারতেন। তা ছাড়া, তার -গতানুগতিক আচরণ সত্ত্বেও তার প্রতি তারা আর-একটু বেশি দরদি এবং শ্রদ্ধাশীলও হতে পারতেন। বিশেষ করে তার জীবদ্দশায় এবং তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বাঙালিরা তার প্রতি সমুচিত সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া, কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, কবি হিসেবে তিনি কত বড় ছিলেন, সেটা তার সমকালীন সাহিত্য-রসিকদের বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছিল। তার মৃত্যুর কয়েক দশক পরে ধীরে ধীরে ব্যক্তি মাইকেলের প্রতি বিতৃষ্ণা যখন কমে এসেছে, তখন কেউ কেউ তার যথার্থ মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করেছেন। সে ক্ষেত্রেও অবশ্য তিনি যে-অন্তরের অন্তস্থলে হিন্দু ছিলেন-এটাকে বড় করে দেখানোর প্রয়াস একেবারে দেখা যায় না, তা নয়। অর্থাৎ সেখানেও সাহিত্যের চেয়ে তিনিআমাদের লোকএই চিন্তাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

বস্তুত, মাইকেলের প্রতি সেকালের বাঙালি সমাজের মনোভাব ছিল একই সঙ্গে ভালোবাসা এবং ঘৃণার। সে জন্যে তাকে এক হাতে দূরে সরিয়ে রাখলেও, বাঙালি সমাজ তাকে ভুলেও যেতে পারেনি। বরং সময়ের দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি বাঙালিদের শ্রদ্ধা এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তার অনুকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ইতিমধ্যে যুগের এবং জীবনধারার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তা ছাড়া, পুরাণের জগৎও প্রাত্যহিক জগৎ থেকে আরও দূরে সরে গেছে। তদুপরি, দেশ বিভাগের পর, হিন্দু পুরাণের সঙ্গে বাঙালি সমাজের একাংশের অপরিচয়ও গভীর হয়েছে। ভাষার ব্যাপক পরিবর্তনও হয়েছে। তা সত্ত্বেও, মধুসূদন-রচিত সাহিত্যে সময়ের ছাপ পড়েছে বলে মনে হয় না। আজকের পাঠকের কাছে সে সাহিত্য আদৌ অপ্রাসঙ্গিক অথবা রসশূন্যও নয়। তার সৃষ্টির উৎসব শেষ হওয়ার একশএকান্ন বছর পরে এখনো তার রচনা লোকেরা পড়েন। কেবল তাই নয়, কালের ব্যবধান সত্ত্বেও তার কবিতার কোনো কোনো পঙ্ক্তি আমাদের ভাষায় প্রবচনের মতো গৃহীত হয়েছে।একি কথা শুনি আজ....’, ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে...’, ‘সম্মুখ সমর’, ‘আশার ছলনে ভুলি’, ‘কপোত-কপোতী’, ‘দাঁড়াও পথিকবর’, ‘অনিদ্রায় অনাহারে’, ‘ভিখারী রাঘব’, ‘ফুলদল দিয়া কাটিলা কি বিধাতা ... ?’ ইত্যাদি অনুবাক্য রকমের কয়েকটি দৃষ্টান্ত। যারা কোনো কালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা পড়েননি, তারাও অনেকে কথাগুলোর অর্থ জানেন এবং নিজেদের কথাবার্তায় এগুলো ব্যবহার করেন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কোনো বাঙালি কবির কবিতার কোনো পঙ্ক্তি অথবা অনুবাক্য এভাবে বাংলা ভাষায় প্রবচন হিসাবে গৃহীত হয়নি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে এক শতাব্দীর ব্যবধানেও কবি এখন অমর হয়ে আছেন।

কবি মধুসূদন দত্তের মৃত্যুবার্ষিকীতে এবার যশোরের সাগরদাঁড়িতে আজ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মধুসূদন একাডেমির আয়োজনে সকালে মধু কবির আবক্ষ মূর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। পরে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠ, ভারত থেকে প্রকাশিতপিলজুসপত্রিকার মধুসূদন সংখ্যার আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন। এখানে অংশ নেবেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী, সমীর দে রায়সহ অন্যান্যরা।

×