ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

প্রকৃতির রহস্যটাই ছোটদের সামনে আনতে চেয়েছি

প্রকাশিত: ২০:১৭, ২৮ জুন ২০২৪

প্রকৃতির রহস্যটাই ছোটদের  সামনে আনতে চেয়েছি

.

আমিরুল ইসলাম বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান শিশু-সাহিত্যিক। দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে তিনি ছোটদের জন্য লিখছেন। লেখালেখিতে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছেন তিনি ছড়া লিখে। পাশাপাশি লিখেছেন প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক। সময়ে আধুনিক শিশুসাহিত্যের অন্যতম রূপকার হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন তিনি।রূপকথাতার লেখালেখির অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। লেখালেখিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ছাড়া অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশু-সাহিত্যসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হন।

তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- মেজবাহ মুকুল

লেখালেখিই হবে আমাকে দিয়ে’- এরকম বুঝলেন কখন থেকে?

হা হা, আমাকে দিয়ে শুধু লেখালেখিই হবে- এরকম বুঝি নাই কখনো। সবসময় মনে হয়েছে লেখালেখি করুম, ফুটবল খেলুম, ক্রিকেট খেলুম, ছবি আঁকুম, সংগঠন করুম। নিজের মতো করে একটা আনন্দময় জীবন কাটামু। এরকমই ভাবছি সবসময়। আর কিছু হবে না লেখালেখিই হবে এমনটা ভাবি নাই। টেলিভিশন হবে। টেলিভিশন প্রোগ্রাম বানাবো। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করবো। এরকম নানা কিছুই ঘটছে জীবনে। লেখালেখির বাইরেও অনেক আনন্দ ছিল আমার জীবনে।

সাহিত্য বিষয়ক পড়াশোনা কেমন করতেন ছোটবেলায়?

পড়তাম। প্রচুর পড়তাম। ক্লাসে যা পড়া দিত তা পনেরো মিনিটে শেষ হয়ে যেত। তারপর যে অফুরন্ত সময় আমি কি করুম। আরও ছিল মর্নিং শিফট ক্লাস। তখনই বইসা বইসা দুপুরের রোদে বই পড়তাম। দুপুরের আগে বই পড়তাম। অনেক সময় গোসল করতে দেরি হইতো। খাইতে দেরি হইতো। আমার এই পড়ার আকর্ষণ শুরু হইছে ক্লাস থ্রি থেকে। তখনই আমি লাইব্রেরির মেম্বার। আমি আর আমার বড় ভাই। ডেইলি একটা করে বই আনি আর গোগ্রাসে গিলি। লাইব্রেরিতে ফেরত দিয়া আবার নতুন বই আনি। তখন চিন্তার বাইরে বই পড়েছিলাম। এই আকর্ষণ পরবর্তী জীবনেও ছিল, আছে এবং এখনো বই পড়ি। সব ধরনের বই পড়ি।

সেই থেকেই লেখালেখি শুরু করেন, নাকি বই পড়তে পড়তে মনে এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হওয়ার পর?

বই পড়তে পড়তেই লেখালেখি শুরু করি। মনে হইলো আমিও তো এরকম লিখতে পারি। এবং খুব খেলতে খেলতে লিখছি আমি; লিখতে লিখতেই খেলা। মানে এটা যে অনেক গবেষণা, অনেক ভাবনা, মাথা ঝাঁকানিÑ এসব না। এই ভালো লাগলো একটা লেখা লিখলাম। এই যে তুমি আসছ যে আমি লিখতেছি কিন্তু। এর মধ্যে অফিসের লোক আসবে, কাজ হবে, কথা হবে, সব হবে। তো ক্লাস সেভেনে বইসা লেখালেখি শুরু করলাম। পরে পত্রিকায় পাঠালাম। ছাপা হয়ে গেল। উৎসাহ পাইলাম। এই তো, এভাবেই।

কৈশোরে দেখা স্বপ্ন বাকি জীবনে কতখানি পূরণ করতে পেরেছেন?

কৈশোরে ওরকম কোনো স্বপ্ন দেখি নাই আসলে। খুব দরিদ্র পরিবারে জন্ম এবং কোনো স্বপ্ন ছিল না। সে স্বপ্ন যে বাস্তব হবে এমনও জানতাম না। তবে কোনো স্বপ্ন না নিয়ে ছেলেবেলা থেকে যে লেখালেখি শুরু করছিলাম- সেটা লিখতে লিখতে যে এত বই হবে, এতগুলো রচনাবলি বের হবে, লোকজন কিছুটা নাম জানবে, খ্যাতি বা অখ্যাতি হবে, পুরস্কার পাব- এইরকম কোনোদিন ভাবি নাই। এখন পেছনে তাকালে একটু অবাকই লাগে যে, এতকিছু করলাম জীবনে, এগুলো তো করার কথা ছিল না। হয়তো আমি মাস্তান হতে পারতাম, পলিটিক্যাল ক্যাডার হতে পারতাম। সেগুলো না হয়ে জীবনের এই পর্যায়ে এসে দেখিÑ অনেক লিখছি। এই যে আনন্দ পাইছি লিখতে গিয়া... জীবনের সুন্দর সময় যে ব্যয় হইছে। জীবনটাকে যে সুন্দর করতে পারছি। এটা ভেবে খুব ভাল্লাগে। লেখা কি হইছে, ব্যাপার না। সেগুলো মহাকাল বিচার করবে। অথবা কিছুই হয়নি। ছাইভষ্ম হইছে। এইটা ব্যাপার না। ব্যাপার হইছে আমি কাজটা (লেখালেখি) যখন করতাম, তখন মনের আনন্দ নিয়া করতাম। মনের আনন্দে আমি লিখি। একটা বই বেরোলে খুশি হই। আবার পরের বইয়ের স্বপ্ন দেখি। এই যে একটা প্রসেস, জার্নি জীবনের, লেখালেখিটা যে এতদিন ধরে করলাম, এত যে লিখলাম, এত বই বেরোলো, এটা ভেবে যখন পেছনের দিকে তাকাই তখন অবাক লাগে। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না আমার এই জীবনে!

আমাদের শিশু-কিশোরেরা কী ধরনের বই পড়তে আগ্রহী বলে মনে করেন?

ওরা তো সব ধরনের বই পড়তেই আগ্রহী। যেমন- নানান কাহিনী পড়ে, গোয়েন্দা রহস্যও পড়ে, আবার খুব মানবিক গল্পও পড়ে, অ্যাডভেঞ্চারও পড়ে, রূপকথাও পড়ে। তাদের কচি মন। সবদিকেই তাদের ছোটাছুটি। অস্থিরতা। যে কারণে কিশোররা নির্দিষ্ট কিছু না, যা পায় তাই পড়তে চায়। তাদের এই খিদা চরম। যে কারণে যা পায় তাই গোগ্রাসে গেলে। জন্য তুমি নির্দিষ্ট করতে পারবে না কিশোররা ঠিক কী পড়ে। এটা রিসার্চ করেও বোঝা যাবে না। তারা সর্বভুক। সব ধরনের জিনিসই কিশোরেরা পড়ে।

শিশু-সাহিত্যের পরিবেশ এখন কেমন মনে হয়?

পরিবেশ বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?

আগে যেমন রবীন্দ্র-নজরুল বা অন্য কবিরা যেসব লিখেছেন শিশু-কিশোরদের জন্য সে মাপের লেখা এখন কি হচ্ছে? এটাই আরকি।

রবীন্দ্রনাথের লেখা তুমি বিচার করছো একশবছর পরে। আজকের লেখাকেও একশ বছর হইতে দাও! একশ বছর পরে আজকের দিনের যে লেখাগুলো টিকে থাকবে সেগুলোর এরকম মূল্যই হবে। যার জন্য সবসময় সব পরিবেশেই কোনো না কোনো মহিমা থাকে। কোনো পরিবেশই খারাপ না। অন্ধকার না। ব্যাপারটা এরকম। যে কারণে এখনকার মূল্য তো আমি সময়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারি না। এখনকারটা এখনকার। রবীন্দ্রনাথেরটা রবীন্দ্রনাথের আমলের। প্রত্যেকটা আমলের ভেতরেই কিছু উজ্জ্বল আলোকণা থাকে। সেটাকে চিহ্নিত করতে একটু সময় লাগে। এখন তো বানের জলের মতো অনেক কচুরিপানা। কিন্তু মুক্তা তো কোথাও লুকানো আছে! আমি সে মুক্তার সন্ধান করতে পারছি না। যার জন্য কচুরিপানার কথাই বলবো তা না। রবীন্দ্র-নজরুলের যুগেও তো অনেক কচুরিপানা ছিল। তারা তো আজকে সব হারিয়ে গেছে। যে কারণে তুমি হতাশ হয়ো না। এখনো অনেক বড় বড় লেখা হচ্ছে। যা বাংলা শিশু-সাহিত্যের কন্টেস্টে অনেক বড়।

আমাদের শিশু-সাহিত্যে কী ধরনের শূন্যতা অনুভব করেন?

নাহ, আমি তো কোনো শূন্যতা অনুভব করি না। পরিপূর্ণ শিশু-সাহিত্য। যা হওয়ার তাই হয়েছে। তবে মানবিক গল্প লেখা একটু কমে গেছে।

এককথায় বলতে গেলে শিশু-সাহিত্যে জীবনবোধটা তেমন আর নেই!

হঁ্যাঁ, এখনকার শিশু-সাহিত্যে কমে গেছে। এটা আবার ফিরে আসবে। এজন্য আমি হতাশ না।

সময়ে শিশুরা কি বই বিমুখ হচ্ছে বলে মনে করেন, কেন?

বই তৈরি হয়েছে এই পৃথিবীতে- ধরো, আনুমানিক ১৫০০ থেকে ১৬০০ সালের ভেতরে। গুটেন বার্গ প্রথম ছাপার মেশিন তৈরি করে। তার আগে বই মানে হচ্ছে হাতে লেখা। তার মানে বই হচ্ছে অল্প সংখ্যায়। অভিজাত শ্রেণি শুধু পড়তে পারবেন। কোরআন মজিদ মসজিদে থাকবে। টপমোস্ট হুজুররা কোরআন ধরে পড়তে পারবে, কারণ তখন কারো বাসায় তো কোরআন ছিল না। কারণ কোরআন তো প্রিন্ট হতো না, হাতের লেখা। তারও আগে পৃথিবীতে রোল করে করে প্যাপিরাস কাগজে বই লেখা হতো। এক একটা রোল করে রাখা আছে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে। এখন অবশ্য ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতেও আছে। তারও আগে রোজেটা পাথরে লেখা থাকতো কোনো একটা তথ্য, কথা, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর বই তো মাত্র সেদিনকার ব্যাপার। ১৫০০-১৬০০ সালে। আর আজকে ২০২৪; তার মানে আটশ বছর। আটশ বছর ধরে বইয়ের বিবর্তন। নানা ফর্মের বই ছাপা হলো। বই অ্যাভেইল্যাবল হইল।

তাও কি অ্যাভেইল্যাবল হইছে বই! তুমি যখন কোনো রেয়ার বই পেয়ে যাওÑ তখন তা কাউকে আর দেখাতে চাও না। এখন বই আছে কিন্তু বইয়ের ফর্মটা বদলে যাচ্ছে। সেই যুগে যেমন প্যাপিরাস পেপার বদলে গেল। আজকে বই বদলে তোমার ইন্টারনেটে ঢুকে গেল। একই তো ব্যাপার। তাতে পৃথিবীতে যে জায়গা নষ্ট হইতো, কাগজের জন্য যে বৃক্ষ নিধন হইতো, সবকিছু গুল্লি হয়ে যাবে। তুমি একটা বই পাওয়ার অধিকার রাখো, প্রত্যেকটা বই পাওয়ার অধিকার রাখো; কুক্ষিগত করার তো কিছু নেই। এই ইন্টারনেট সেটাই করে দিচ্ছে। একটা বইকে সকলের অধিকার করে দিচ্ছে। বইয়ের ফর্মটা বদলে যাচ্ছে। বইয়ের দোকান থাকবে না। বই এই ফর্মে (বাঁধাই) থাকবে না। বই থাকবে ইন্টারনেটে। তখন হয়তোবা আরও বেশি বইমুখো হবে ছেলেরা।

কতগুলো গল্প লিখছেন?

প্রায় পাঁচেক হবে বোধহয়। রূপকথার তিন খন্ড রচনাবলি বাইর হইছে পাঁচ পৃষ্ঠা করে। রূপকথা খুব প্রিয় বিষয় আমার। এটা হলো বাবার গল্প শুইনা অনুপ্রেরণা।

×