ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১

কাঠের আসবাব

যুগ যুগের ঐতিহ্য- শৌখিন পরিবারে কদর কমেনি

মো. খলিলুর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ২৬ জুন ২০২৪

যুগ যুগের ঐতিহ্য- শৌখিন পরিবারে কদর কমেনি

কাঠের তৈরি রেহালসহ ঐতিহ্যবাহী অনেক আসবাবপত্র আজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে

কাঠের তৈরি আসবাবপত্র গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। যুগ যুগ ধরে কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের কদর এখনো রয়েছে। শোভা পাচ্ছে শৌখিন পরিবারে। কাঠের তৈরি আসবাবপত্র নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়। থাকে নানা ধরনের কারুকাজ ও নকশাও। কাঠের তৈরি অনেক আসবাবপত্র এখন বিলীন হওয়ার পথে।

এক সময়ে খুবই জনপ্রিয় ছিল কাঠের তৈরি আলনা, ডাল ঘুটনি, কাহাইল ছিয়া, ঢেউয়া, বেলন-পিঁড়ি, জল চৌকি, রেহাল, খানাডুলি, ক্যাশবাক্স, টিভি ট্রলিও সিগারেটের অ্যাশট্রেসহ নানা ধরনের আসবাবপত্র। এগুলো আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। প্লাস্টিকের আসবাবপত্র বাজারে সয়লাব হওয়ায় কাঠের তৈরি এ সব আসবাবপত্র আজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের চেয়ে সস্তায় পাওয়া যায় বলে প্লাস্টিকের আসবাবপত্রের চাহিদা বেড়ে গেছে। ব্যবহার কমেছে কাঠের তৈরি অনেক আসবাবপত্রের।

দখল করে আছে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি আসবাবপত্র। তাই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের কারিগর ও বিক্রেতারা। ব্রহ্মপুত্রের আদি নদের তীরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সোনারগাঁও উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী কাইকারটেক হাটে সরেজমিনে দেখা যায়, কাজী আলমগীর স্টোরে বিক্রির জন্য কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের (বিলীন হওয়ার পথের) পসরা সাজিয়ে বসে আছেন এক বিক্রেতা। নেই তেমন কোনো ক্রেতা।

অলস সময় পার করতে দেখা গেছে ওই দোকানি কাজী আলমগীরকে। এ প্রতিবেদকের কথা হয় কাঠের তৈরি বিলীন হওয়ার পথের সেই আসবাবপত্রের বিক্রেতা কাজী আলমগীরের সঙ্গে। তিনি জানান, এ সব আসবাবপত্রের অতীত ও বর্তমান সময়ের নানান কাহিনী। 
কাজী আলমগীর। বয়স পঞ্চান্নের কোটায়। পিতা জহিরুল ইসলাম। বাড়ি সোনারগাঁও উপজেলার কাপরদী এলাকায়। আগে তাদের বাড়ি ছিল কাইকারটেকের হাটের কাছাকাছি। কাজী আলমগীর গত ২০-২২ বছর ধরে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি করে আসছেন। তিনি বলেন, এক সময়ে কাঠের তৈরি  আলনা, ডাল ঘুটনি, কাহাইল ছিয়া, ঢেউয়া, বেলন-পিঁড়ি, জলচৌকি, রেহাল, কাঠের ক্যাশবাক্স, টিভি ট্রলিও সিগারেটের ক্যাশবাক্সসহ নানা ধরনের আসবাবপত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল।

কিন্তু কালের বিবর্তনে এ সব আসবাবপত্রের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। এখন এ সব আসবাবপত্র দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন আলনা, ডাল ঘুটনি, কাহাইল ছিয়া, ঢেউয়া, বেলন-পিঁড়ি, জলচৌকি, রেহাল, কাঠের ক্যাশবাক্স, টিভি ট্রলিও সিগারেটের ক্যাশবাক্সের ক্রেতা হলেন নি¤œ মধ্যবিত্তের লোকজন। তিনি বলেন, এ দেশের প্লাস্টিকের পণ্য সামগ্রী চলে আসায় দিন দিন কদর কমতে শুরু করে এ সব আসবাবপত্রের। এ সব আসবাবপত্রগুলো এখন প্লাস্টিক, স্টিলের ও অ্যালুমিনিয়াম দিয়েও তৈরি করা হচ্ছে।

এগুলো কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের চেয়ে সস্তায় পাওয়া যায় বলে এ সব আসবাবপত্রগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আগে এ কাইকারটেকের হাটে অসংখ্য কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের দোকানে ভরপুর ছিল। এখন শুধুমাত্র আমার দোকানই অবশিষ্ট রয়েছে। কাজী আলমগীর বলেন, কাঠের তৈরি একটি আলনা ১২শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায়, ঐতিহ্যবাহী কাহাইল ছিয়া ৩ হাজার টাকায়, বেলন-পিঁড়ি ২৫০ টাকায়, গদি ক্যাশ ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায়, সিগারেটের ক্যাশবাক্স ৫শ’ থেকে ৮শ’ টাকায়, কাঠের খানাডুলি ২ হাজার ৫শ’ টাকায়, জলচৌকি ১৫০-২০০ টাকায়, রেহাল ১০০-১৫০ টাকায়, ডাল ঘুটনি ৩০-৬০ টাকায়, টেউ  (চুলো ভাত নাড়নি) ৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। তিনি বলেন, আগের মতো এখন আর এ ধরনের আসবাবপত্র বিক্রি হয় না। 
প্রতি রবিবার কাইকারটেকের হাটে এ সব আসবাবপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন তিনি। যদি একটি আসবাবপত্র বিক্রি হয় এ আশায় পসরা সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তিনি। তবুও এ সব আসবাবপত্র স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতেই তিনি এখনো এ পেশায় ডুবে আছেন। তিনি এ সব আসবাবপত্র দূর-দূরান্ত থেকে পাইকারি কিনে এনে কাইকারটেকের হাটে বিক্রি করে কোনোমতে পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

আলমগীর বলেন, কড়ই, আম, কেরোসিন, মেহগনি ও গাব কাঠসহ বিভিন্ন ধরনের কাঠ দিয়ে এ সব আসবাবপত্র নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়। কাঠের তৈরি আসবাবপত্রে থাকে নানা কারুকাজ ও ডিজাইনের নকশাও। নকশায় আসবাবপত্রের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। এখন এ সব আসবাবপত্র এখন শোভা পাচ্ছে অনেক শৌখিন পরিবারেও। ব্যবহৃত হচ্ছে নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারে। এ সব আসবাবপত্রের ক্রেতাদের মধ্যে একজন শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্লাস্টিকের যুগে এখন আর এ সব আসবাবপত্রের চাহিদা নেই বললেই চলে। তবুও একটি কাঠের তৈরি টিভির ট্রলি কিনতে এসেছি।

সাতশ’ টাকা দিয়ে একটি টিভির ট্রলি কিনে নিয়ে যাচ্ছি। এগুলো এখনো ঐতিহ্যবাহী আসবাবপত্র হিসেবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিলুপ্তের পথে এ সব কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের বিক্রেতা কাজী আলমগীর বলেন, আমার এক ছেলে এক মেয়ে। তারা কেউ আমার এ আদি পেশায় আসেনি। তারা অন্য পেশায় ঢুকে গেছে। ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি আলনা, ডাল ঘুটনি, কাহাইল ছিয়া, ঢেউয়া, বেলন-পিঁড়ি, জলচৌকি, রেহাল, কাঠের ক্যাশবাক্স, টিভি ট্রলি ও সিগারেটের ক্যাশবাক্সসহ নানা ধরনের কাঠের আসবাবপত্র এখন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বহন করে আছে।

তাই এ সব আসবাবপত্র আজীবন বিক্রির পেশায় ডুবে থাকতে চান আলমগীর। যদি এ সব আসবাবপত্রের চাহিদা বাড়ে তখন বিক্রিও বাড়বে তার। তখন আয়ও বেড়ে যাবে। এ আশায় প্রহর গুনছেন তিনি।

×