ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

হাঁড়িভাঙার মাতৃগাছ

৭৪ বছরের বৃক্ষ, জিআই স্বীকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও

​​​​​​​তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২২:০৯, ১৭ মে ২০২৪

৭৪ বছরের বৃক্ষ, জিআই  স্বীকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে  আছে আজও

ঐতিহ্যবাহী হাঁড়িভাঙা আমের আবিষ্কারক হিসেবে নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমজাদ হোসেন পাইকার হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছটি আজও আগলে রেখেছেন

ঐতিহ্যবাহী হাঁড়িভাঙা আমের উৎপত্তি মাতৃগাছটি এখনো বেঁচে আছে। যে গাছ থেকে লাখ লাখ চারাগাছ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রংপুর অঞ্চলে। মিঠাপুকুর উপজেলায় খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানী গ্রামে রয়েছে এই মাতৃগাছটি। প্রয়াত বাবা নফল উদ্দিন পাইকারের রোপণ করা মাতৃগাছটি আজও আগলে রেখেছন তার ছেলে আমজাদ হোসেন পাইকার।

তবে নতুন নতুন গাছের ভিড়ে আলোচনায় না থাকলেও মাতৃগাছটি এখনো ফল দিয়ে যাচ্ছে অগোচরে। প্রায় ৭৪ বছর আগে রোপণ করা সেই মাতৃগাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। তবে গাছ পুরনো হওয়ায় গাছ থেকে বছরে অন্তত -১২ মণ আম পাওয়া যায়। গাছ থেকেই হাঁড়িভাঙা জাতের আম ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পেয়েছে উত্তর জনপদের রংপুর অঞ্চলের বিখ্যাত জনপ্রিয় আম হাঁড়িভাঙা। অতি মিষ্ট, আঁশহীন, হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। কয়েক বছর ধরে ফলন ভালো হওয়ায় বেড়েছে আম উৎপাদনের পরিধিও। রংপুর সদর, মিঠাপুকুর বদরগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দর এলাকায়ও চাষ হচ্ছে। প্রচ- দাবদাহসহ আবহাওয়া তেমন অনুকূল না থাকলেও ফলন খুব একটা খারাপ হয়নি। রংপুর অঞ্চল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর রংপুর অঞ্চলর বিখ্যাত হাঁড়িভাঙা আমের চাষাবাদ করা হয়েছে হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে। বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার টন। আশা করা যাচ্ছে আগামী জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই আম বাজারে আসবে।

হাঁড়িভাঙা আমের নাম অবশ্য শুরুতে হাঁড়িভাঙা ছিল না। আমের আবিষ্কারক হিসেবে স্থানীয়ভাবে নফল উদ্দিন পাইকারকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন এক বৃক্ষপ্রেমিক। তার হাত ধরেই তেকানী গ্রামে হাঁড়িভাঙার গোড়াপত্তন। যদিও এর আদি নাম মালদিয়া। বৃক্ষপ্রেমী নফল উদ্দিন পাইকার বেঁচে নেই। তার ছেলে আমজাদ হোসেন বলতে পারেন তারা প্রয়াত বাবার হাত রোপণের মাতৃগাছটির আদ্যোপান্ত ভালো মানের হাঁড়িভাঙা আম চেনার উপায়।

আমজাদ হোসেন পাইকার জানান, সম্ভবত ১৯৪৯ সাল। রংপুরের মিঠাপুকুরের বালুয়া মাসুমপুর গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেই এলাকার একটি জমি থেকে দুটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তার বাবা। তবে একটি গাছ চুরি হয়ে যায়। বাকি গাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে পানি (ফিল্টার সিস্টেমে) দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে। যে গাছ থেকে হাজার হাজার চারাগাছ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রংপুর অঞ্চলে।

তিনি বলেন, গাছটিতে একসময় বিপুল পরিমাণ আম ধরত। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম ¤পর্কে জানতে চায়। তখন থেকেই গাছটির আম হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়। এখন হাঁড়িভাঙা আমের সুনাম মানুষের মুখে মুখে। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাগান। আমচাষি, বাগানি, ব্যবসায়ীরা সবাই দিন দিন লাভবান হচ্ছেন।

আমজাদ হোসেন বলেন, মাতৃগাছ থেকে কলম করা অনেক চারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশে বেড়েছে হাঁড়িভাঙার কদর। হাঁড়িভাঙা আম ঘিরে প্রতি বছর শত কোটির টাকা ব্যবসা হয় জানিয়ে তিনি জানান, এই আম আমাদের এলাকার চিত্র পাল্টে দিয়েছে। মৌসুমি ফল হলেও পুরো রংপুর অঞ্চলে হাজারো মানুষ এই আম ঘিরে লাভবান হচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় ¤পদ।  কিন্তু দীর্ঘদিনেও এই আমের সংরক্ষণে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই এলাকার হাটবাজারের উন্নয়ন যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হলেও বিশেষ করে হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণে হিমাগারের খুবই প্রয়োজন। এই আমের সংরক্ষণ বেশি দিন রেখে খাওয়ার উপযোগী করতে কৃষি বিভাগসহ সরকারপ্রধানের সুদৃষ্টি কামনা করে তিনি বলেন, যাদের কিছুই নেই, ভিক্ষা করে সংসার চালায়, তারাও এই মৌসুমে আম কুড়িয়ে ১৫-২০ হাজার টাকা বিক্রি করে। হাঁড়িভাঙা গাছ থেকে নামানোর পর এক সপ্তাহের বেশি রাখা যায় না। সমস্যা হলো এটা বেশি পাকলে খাওয়া যায় না, দ্রুত নষ্ট হয়। এই আম কীভাবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়, সে বিষয়ে কৃষি বিভাগের সহযোগিতা গবেষণা খুব বেশি প্রয়োজন। এই আমের স্থায়িত্ব বাড়লে চাষি ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। তখন বিদেশে রপ্তানি করাটা আরও সহজ হবে। কম ফলনের জন্য শুধু কীটনাশকই নয়, প্রকৃতির কাছেও অসহায় হাজারো আমচাষি।

আমজাদ হোসেন আরও বলেন, আমের উৎপাদন বা ফলন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ গাছের গোড়ায় হরমোন ব্যবহার। মৌসুমের শুরুতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী আমবাগান চুক্তিতে কিনে নেন। পরে তারা পরিচর্যা করতে গিয়ে বেশি উৎপাদন লাভের আশায় হরমোন ব্যবহার করছেন। এতে কয়েক বছর ফলন ভালো হলেও দিন দিন বাগানমালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই আমের জন্য কীটনাশক হরমোন ব্যবহার করা ঠিক না।

ভালো মানের হাঁড়িভাঙা আম চেনার উপায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের ওপরটা যত কালচে, ভেতরে ততই সুন্দর। এর স্বাদ মিষ্টি লোভনীয়। দেখতে সুন্দর পরিচ্ছন্ন আমে কীটনাশক   স্প্রে ব্যবহার বাগান কিনে নেওয়া ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভের জন্য করে থাকেন। এতে আম দেখতে ভালো, সুন্দর পাকা রঙের মনে হয়। হাঁড়িভাঙা আমের বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি সুস্বাদু। এই আমের আঁটিও খুব ছোট। ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০-৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙা আকারভেদে ৬০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে। গত এক দশকে দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা বেড়েছে হাঁড়িভাঙার। সঙ্গে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশেও রপ্তানির সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারক অনেকেই আছেন। তাদের মধ্যে লুৎফর রহমান আবদুস সালাম সরকারের রয়েছে আলাদা পরিচিতি। তারা ১৯৯০ সালের পর থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙা আম চাষ শুরু করেন।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে হাঁড়িভাঙা আমের ফলন হচ্ছে প্রায় ৩০ বছর ধরে।এই আমটা লোকালি পরিচিত ছিল। জাতীয়ভাবে পরিচিত হয় ২০১৫ সালে ঢাকায় ফল মেলায়। সেখানে এই আমের পরিচিতি পায়। তখন মানুষ জানলো যে হাঁড়িভাঙা আমটা রংপুরের বিখ্যাত আম যা জিআই পণ্য হিসাবে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পেয়েছে।

সূত্র মতে হাঁড়িভাঙা আম গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গাছের ডালপালা ঊর্ধ্বমুখী বা আকাশচুম্বী হওয়ার চেয়ে পাশে বেশি বিস্তৃত হতে দেখা যায়। ফলে উচ্চতা কম হওয়ায় ঝড়-বাতাসে গাছ উপড়ে পড়ে না এবং আমও কম ঝড়ে পড়ে। আমটির উপরিভাগ বেশি মোটা চওড়া, নিচের অংশ অপেক্ষাকৃত চিকন। আমটি দেখতে সুঠাম মাংসালো, শ্বাস গোলাকার একটু লম্বা। আমের তুলনায় শ্বাস অনেক ছোট, ভিতরে আঁশ নেই। আকারের তুলনায় অন্য আমের চেয়ে ওজনে বেশি, গড়ে ৩টি আমে কেজি হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি আম ৫০০/৭০০ গ্রাম হয়ে থাকে। পুষ্ট আম বেশি দিন অটুট থাকে। চামড়া কুচকে যায় তবুও পচে না। ছোট থেকে পাকা পর্যন্ত একেক স্তরে একেক স্বাদ পাওয়া যায়। তবে আমটি খুব বেশি না পাকানোই ভালো।

কৃষি বিভাগ বাগানিরা বলছেন এই আমের ফুল বা মুকুল আসার সময়- মাঘ-ফালগুন। পাকার সময় আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে। অর্থাৎ জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ।

আম চাষি সাজেদুর রহমান, জানান, বাগানে পোকার আক্রমণ দেখা দেওয়ায় কৃষি বিভাগের পরামর্শে ওষুধ ছিটানো হয়েছে। সেইসঙ্গে হাঁড়িভাঙা আমের বাগানে নিজ উদ্যোগে সেচও দেওয়া হয়েছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, বাগানে পোকা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে হাঁড়িভাঙা বাজারে আসবে।

×