নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দৃষ্টিনন্দন বিবি মরিয়মের সমাধি সৌধ অযত্নে পড়ে আছে
দৃষ্টিনন্দন ও কারুকাজে ভরপুর বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধ। ঐতিহাসিক এ নির্দশনটি কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। অনেক পর্যটক বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধের নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ হন। এটি মুঘল আমলে নির্মিত একটি সমাধিসৌধ। এটি নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর থানার ফতুল্লার হাজীগঞ্জ এলাকায় ঈশা খাঁ রোডে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক নির্দশন। এটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার অধীনে পড়েছে। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত ঘোষিত পুরাকীর্তির তালিকায় নারায়ণগঞ্জের ২১টি স্থাপনার মধ্যে বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধটি তিন নম্বরে রয়েছে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক একটি নিদর্শন স্থাপনা। কিন্তু প্রতœতাত্ত্বিক এ নিদর্শনটি এখন অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে। কিন্তু এ সমাধিসৌধের নেই কোনো সংস্কার বা মেরামত কাজ। দিন দিন কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শনটি আদি রূপ হারিয়ে যেতে বসেছে। বিবি মরিয়মের সমাধির দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে ইট-সুরকি। নেই রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ। স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই বলছেন, এটিকে কোনোদিন সংস্কার করতে দেখেননি। আবার অনেকে বলছেন, প্রায় ১৮-২০ বছর আগে একবার সংস্কার করতে দেখেছেন। কিন্তু সরেজিমনে গিয়ে সংস্কারের কোনো লক্ষণ চোখে পড়েনি। বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধস্থল সরেজমিন ঘুরে ও দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও সমাধিসৌধের দেখাশুনার দায়িত্বে থাকা লোকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, এ সমাধিসৌধের অতীত ও বর্তমান এবং অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকার নানা দুরবস্থার কাহিনী।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এ সমাধি তৎকালীন মুঘল স¤্রাট নিয়োজিত সুবেদার শায়েস্তা খান কর্তৃক নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। অনুমান করা হয়, সমাধি ও এর লাগোয়া মসজিদের নির্মাণকাল ১৬৬৪-৮৮ খ্রিস্টাব্দ। সমাধিতে শায়িত বিবি মরিয়মকে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরনা দুখতের বোন তুরান দুখত বলেই অবহিত করেছেন ঐতিহাসিকরা। সমাধিসৌধটি সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি আয়তাকার প্রাঙ্গণের মাঝখানে ভূমি থেকে উঁচু ভেতের মাঝে নির্মিত। বর্গাকার ইমারতটিতে একটি গম্বুজ বিশিষ্ট। এ ছাড়াও ভবনের চারদিকে খিলান ছাদবিশিষ্ট বারান্দা ঘিরে রয়েছে। সমাধিসৌধটির কেন্দ্রস্থলে চতুষ্কোণ কক্ষে রয়েছে তিন ধাপবিশিষ্ট সমাধি। সমাধিটি শ্বেত পাথরে নির্মিত ও লতাপাতার নকশা অঙ্কিত রয়েছে। এ ছাড়া কবর ফলক ও সমাধিলাগোয়া বারান্দায় আরও ছয়টি সাধারণ কবর রয়েছে। এ সমাধিস্থল এক নজর দেখতে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন নারায়ণগঞ্জে। স্থানীয়দের মতে, এটি আজ অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে নেই কোনো সংস্কার কাজও। এটির আস্তর খসে খসে পড়ছে। সমাধিস্থলের চারদিকে প্রাচীর দেওয়াল ঘেরা। বিবি মরিয়মের নামের সঙ্গে মিল রেখে সেখানে পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে একটি মসজিদ ও দক্ষিণ পাশে নির্মিত হয়েছে বিবি মরিয়ম গালস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ। স্থানীয়দের দাবি, সমাধিস্থলের পূর্বদিকে পরিত্যক্ত ভবন সন্ধ্যা হলেই মাদকাসক্তদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়। যা পরিবেশকে নোংরা করছে। কিল্লারপুল এলাকার বাসিন্দা বলেন, সন্ধ্যা নামলেই সমাধিসৌধটি হয়ে পড়ে অন্ধকার। সমাধিসৌধটির ভেতর ছাড়া আশপাশে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। সমাধিসৌধের পশ্চিম পাশের মসজিদে বৈদ্যুতিক বাতি থাকলেও পুরো সমাধিসৌধটির জায়গাটি থাকে অন্ধকারাচ্ছন। এ নিদর্শনটির দেখাশুনার জন্য একজন লোক নিয়োজিত থাকলেও স্থানীয়দের কারণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না বলে সচেতন মহল অবহিত করেছেন। ফলে দিন দিন এ নিদর্শনটি দেখতে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমে আসছে।
কিল্লারপুল এলাকার বাসিন্দা মো. রবিন বলেন, দৃষ্টিনন্দন ও কারুকাজে ভরপুর এ বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধ আজ অবহেলায়-অযত্নে পড়ে আছে। তাই দর্শনার্থীর আগমনও কমে গেছে। এ সমাধিসৌধকে ঘিরে এক সময় মেলা বসত। ১০-১২ বছর আগে মেলাটিও বন্ধ হয়ে গেছে। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা বিবি মরিয়মরের সমাধিসৌধ দেখতে ছুটে আসেন। যদি কেউ পাশর্^বর্তী ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থাপনা দেখতে আসেন, তবে তাদের মধ্যে হয়তো কেউ বিবি মরিয়মের সমাধিতে ছুটে আসছেন। তিনি দাবি করেন, বিবি মরিয়মের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে একটি বিশাল সুড়ঙ্গ রয়েছে। শুনেছি, এ সুড়ঙ্গ দিয়ে এক সময়ে হাজীগঞ্জ কিল্লাসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থাপনায় যাতায়াত করা যেত। সুড়ঙ্গটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এ সমাধিসৌধটি দেখাশুনার জন্য একজন দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তিনি স্থানীয়দের দাপটের কারণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। তিনি বলেন, রাত হলেই এ সমাধিসৌধের পূর্ব দিকে পরিত্যক্ত ভবনে নেশাখোরদের আড্ডা বসে। তখন একটি ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
বন্দরের কদমরসুল কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী ও একই এলাকার বাসিন্দা মো. ফেরদৌস বলেন, যারা নিয়মিত নারায়ণগঞ্জে ঘুরতে আসেন তারাই বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধ দেখতে আসেন। অনেকেই বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধে আগরবাতি, মোতবাতি জ্বালিয়ে যান। ফেরদৌস বলেন, অনেক দর্শনার্থী এসে বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধের ছবি তুলে নিয়ে যান। এ সময় নিজেরাই সৌধের সঙ্গে সেলফি তুলতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে অনেক পর্যটক বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধের নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধও হন। তবে এখন এ দৃষ্টিনন্দন ও কারুকাজে ভরপুর সমাধিসৌধের ইট-আস্তর খসে খসে পড়ছে। আমি কখনো এ সমাধিসৌধটির সংস্কার বা মেরামত কাজ করতে দেখিনি। আদি রূপ অক্ষত রেখে পুরনো ও ঐতিহাসিক এ সমাধিসৌধের সংস্কার করে আরও দৃষ্টিনন্দন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একই এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেনও দাবি করেন এ সমাধিসৌধটি কোনোদিন সংস্কার করতে দেখেননি। তবে এখন সংস্কার প্রয়োজন বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, এই ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থাপনার জরুরি মেরামত বা সংস্কার করা হলে তবেই পর্যটকদের বেশি আর্কষণ করতে পারবে। বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধের দেখাশুনার দায়িত্বে থাকা কর্মচারী মো. রায়হান হোসেন বলেন, এটি সংস্কারকাজের জন্য বাজেট করার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু কবে সংস্কার কাজ করা হবে তা জানি না।
২০১২ সাল থেকে আমি এটির দেখাশুনার দায়িত্বে রয়েছি। এলাকাবাসাীর কাছ থেকে শুনেছি, ২০০১ সালে এটির সংস্কারকাজ হয়েছিল। আর কোনো সংস্কারকাজ করা হয়নি। তিনি বলেন, বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধ ও হাজীগঞ্জ দুর্গ মিলে মোট ১৯ একর জায়গা রয়েছে। ২০১৯ সালে হাজীগঞ্জ দুর্গের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এরপর এ দুটি স্থাপনার সংস্কারকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কবে সংস্কারকাজ করা হবে তা জানি না। তিনি বলেন, বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধটি খোলা জায়গায় হওয়ায় কিছুটা আড্ডা হতে পারেই।