যশোরের মণিরামপুরে দমদম পীরের কবর খনন করে পাওয়া গেছে প্রাচীন স্থাপনা
এক সময় ঢিবিটি সেন বা সুলতানী আমলের বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু কিছুটা খনন করার পর সে ধারণা পাল্টে গেছে। এখন আর একে কেউ তিন-চারশ’ বছরের প্রাচীন বলে মনে করে না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রাচীনত্বে এটি লালমাই পাহাড়ের বৌদ্ধবিহার সভ্যতার সমসাময়িক, এমনকি আরও কিছু প্রাচীন হতে পারে। ঢিবিটির অবস্থান যশোরের মণিরামপুরের ভোজগাতি ইউনিয়নের দোনার গ্রামে, যশোর-মণিরামপুর সড়কের পশ্চিমপাশে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, এটি ২০০৪-০৫ অর্থবছরে খনন করা হয়েছিল। ধারাবাহিকভাবে পর পর চার বছর খননের ফলে একটি পূর্বমুখী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। গর্ভগৃহস্থ অসম আকৃতির ও আয়তনের ২৪টি কক্ষের সমন্বয়ে এই মন্দির গঠিত। মন্দিরে দুটি নির্মাণযুগের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম নির্মাণযুগে মন্দিরটি প্রায় বর্গাকার (২২মি থেকে ২১মি) ছিল। খননের পর আবার সেটি মাটি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছিল। এখন মাটি সরিয়ে আবার খনন করা হচ্ছে পুরো বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবার জন্য।
প্রথম যুগের মন্দিরকে মোটামুটি অবিকৃত রেখে দ্বিতীয় যুগে তা পূর্বদিকে আরও সম্প্রসারিত করা হয় এবং এ ক্ষেত্রে স্থাপনা আয়তাকার (৩৩.০৫মি থেকে ২১মি) রূপ ধারণ করে। প্রথম যুগের প্রদক্ষিণ পথ পরিত্যক্ত হয় এবং নতুন করে প্রদক্ষিণ পথ নির্মাণ করা হয় এবং মন্দিরের বহির্গাত্র পদ্মফুলের সঙ্গে দেব-দেবী সম্বলিত পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সজ্জিত করা হয়। মন্দিরের পূর্বদিকে আরও একটি ক্ষুদ্রাকার মন্দির, সূতপ, খোলামঞ্চ প্রভৃতি নির্মাণ করা হয়। এ থেকে মনে করা হয় যে, আলোচ্য সময়ে মন্দিরের কর্মকা-ের বিস্তৃতি ঘটেছিল।
এ প্রতœস্থলে আবিষ্কৃত অন্যান্য অস্থাবর প্রতœবস্তুসহ এন্টিমনির কাজল শলাকা ও রুলেটেড তার আবিষ্কার হওয়ায় প্রথম যুগের মন্দির নির্মাণকালকে খ্রিস্টীয় দুই শতক - তিন শতকে নির্ধারণ করা যায়। সে হিসাবে বাংলাদেশে এ যাবৎ প্রতœতাত্ত্বিক খননে উন্মোচিত মন্দিরসমূহের মধ্যে এটিকে অন্যতম প্রাচীন মন্দির বলে মনে করা যায়।
জানা যায়, লালমাই সভ্যতা ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর। সে হিসাবে তেরো-চৌদ্দশ’ বছরের প্রাচীন। দমদম পীরের ঢিবিকে স্থানীয় লোকজন ছাড়াও পুরাতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন ১৮শ’ বছরের প্রাচীন। এখানে যেসব জিনিসপত্র পাওয়া গেছে এর মাঝে ছোট আকারের পাথরের তৈরি বুদ্ধমূর্তি, ছয়টি কক্ষ, পোড়ামাটির ফলক ও পদ্মফুল, ধাতব আংটি, হাঁড়ি, চুড়ি, কড়াই প্রভৃতি প্রধান। কক্ষগুলোর দেওয়াল জ্যামিতিক নকশার তৈরি। সিঁড়ির কারুকাজও প্রায় একরকম। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, প্রথমে এখানে ছিল বৌদ্ধদের বাস। এর পর আসে হিন্দু এবং সব শেষে মুসলমান। হয়ত ধর্ম প্রচারে এসে তৈরি করা হয় পীরের আস্তানা। সে যাই হোক, এখানে, ছড়িয়ে আছে তিনটি সভ্যতার নিদর্শন।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দমদম পীরের ঢিবি থেকে কিছু দক্ষিণে মঙ্গল শাহ নামে এক পীরের আস্তানা ছিল। এলাকার মানুষ এক সময় এখানে তাদের নানা রোগের জন্য টাকা, মুরগি ও ছাগল মানত করত। রোগ মুক্তির পর ওই স্থানে মানত করা পশু-পাখি জবাই করে মিলাদ মাহফিল করত। এখনো হয় তবে আগের তুলনায় অনেকটা কম। এটা কবে থেকে চলে আসছে তা কেউ জানে না।
১৯৮৬ সালে এলাকার মানুষ ঢিবি সংলগ্ন এটি মাদ্রাসা স্থাপন করে। মাদ্রাসা নির্মাণকালে ঢিবি থেকে মাটি কাটার সময় ইটের তৈরি গাঁথুনি বেরিয়ে পড়ে। এ ঘটনা এলাকায় ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দীর্ঘকাল মাটির নিচে পড়ে থাকা ঘর দেখতে বিভিন্ন স্থান হতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে যায় সেখানে। দমদম পীরস্থানের পরিচিতি ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে। ২০০৪-০৫ সালে সরকারিভাবে প্রথম খনন করা হয় এই ঢিবি। খননকালে ছাদবিহীন ৮টি পূর্ণাঙ্গ কক্ষ আবিষ্কৃত হয়। ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মোট কক্ষ পাওয়া যায় ১৮টি। এই সময় মন্দিরের নকশার মধ্যে পদ্মপাপড়ি খচিত ইট থেকে ধারণা করা হয় এটা জৈন মন্দির ছিল। যার স্থাপনাকাল ১০০ খ্রিস্টপূর্বে।
পোড়াপাটির সাপের ফণাযুক্ত পাত্র থেকে ধারণা করা হয়, এখানে পঞ্চনাগ বা সপ্তনাগের অর্চনা হতো যা জৈন ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাছাড়া ১৩ তম জৈন তীর্থ মল্লিনাথের বিগ্রহ জৈনধর্মকে সমর্থন দেয়।
প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, ২০০৫ সালে খনন কাজ শুরু করে সেখান থেকে যেসব জিনিস পাওয়া যায় তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। পরে যাতে স্থানটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে কারণে মাটি দিয়ে আবার ঢেকে দেওয়া হয়। এখন আবার মাটি খুঁড়ে নতুন করে আরও খনন করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে গবেষণা করা হবে। এখন পর্যন্ত আমাদের ধারণা এটি প্রথম শতাব্দীর কোনো স্থাপনা। পুরো গবেষণার কাজ শেষ হলে আরও নতুন কিছু বলা যাবে।