
.
বর্তমান যুগকে প্রযুক্তির যুগ বলা হয় যার সমাহার ঘটেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। বর্তমানেও গ্রামে-গঞ্জে এমন সব প্রথা আর নিয়ম দেখা যায়, যা উন্নত চিন্তাধারার পরিচয় বহন করে না। যৌতুক প্রথা, আজও আমাদের সমাজে প্রভাব বিস্তার করছে।
আশ্চর্যজনকভাবে ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যৌতুক প্রথার প্রচলন শুরু হয় ‘কন্যাদান’ নামক বৈদিক যুগের একটি ধর্মীয় রীতিকে কেন্দ্র করে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের প্রথা অনুযায়ী পিতার সম্পত্তিতে কন্যার কোনো অধিকার থাকে না। কন্যার বিয়ের পর পিতার আর কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না কন্যার ওপর। সেই যুগেই হিন্দুধর্মের উচ্চবংশের বা ব্রাহ্মণ বংশে যৌতুক প্রথা সীমাবদ্ধ ছিল। হিন্দুধর্মের এই রীতি ছিল যে কন্যার বিয়েতে কন্যার পিতা তার স্বামীকে খুশি করার জন্য তার সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু উপহার দেন। পিতার এই দক্ষিণা ছাড়া কন্যার বিয়ে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পরবর্তীতে, নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তা অনুসরণ করতে থাকে। বৈদিক যুগের এই দক্ষিণা কালক্রমে বাধ্যবাধকতায় প্রকাশ পায়। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান যুগেও যৌতুক প্রথার প্রভাব বিস্তারের কারণ-
১. হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের প্রভাব, যা আজ ও লক্ষ্য করা যায়।
২. মানুষের উন্নত চিন্তাধারার অভাব, যার কারণে মানুষ এখনো সেই যৌতুক প্রথায় অভ্যস্ত।
৩. সমাজের সবার সচেতনতার অভাব।
৪. আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবহেলা। যৌতুক প্রথার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত, আইন প্রণয়ন করা সত্ত্বেও আইনের যথাযোগ্য প্রয়োগ হয় না। হিন্দুসমাজের এই শ্রেণিবৈষম্য বা কুলিনত্বের কারণে হিন্দুসমাজে আজও যৌতুক প্রথা বেশি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেখা যায়, উচ্চবর্ণের বাহ্মণরা প্রচুর যৌতুক পাওয়ার আশায় শতাধিক বিবাহ করত। এসব স্ত্রী তাদের পিতৃগৃহেই থাকত। স্বামীরা বছরে একবার দেখা করতে আসত এবং প্রচুর আতিথেয়তা ভোগ করে যাওয়ার সময় অনেক যৌতুক নিয়ে যেত। (বাংলা পিডিয়া ৮/৪৫৫)। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও কুলিনত্বের মর্যাদা লাভ করে। তখন হিন্দুসমাজে একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়। তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ডিগ্রি অর্জন করে। এতে চাকরির বাজারে তাদের দাম বেড়ে যায় এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তখন কন্যাপক্ষ বিভিন্ন উপহার-উপঢৌকন দিয়ে বরপক্ষকে আকর্ষণের চেষ্টা করত। তাদের উপহারের মান ও পরিমাণের ওপর নির্ভর করত পাত্রের পিতা-মাতার সন্তুষ্টি। এককথায় এটি দাবি করে নেওয়ার পর্যায়ে চলে যায়। আশা ছিল শিক্ষার ফলে কুলিনত্বের ক্ষতিকর দিকগুলো দূরীভূত হবে। কিন্তু তা না হয়ে বরং কুলিনত্ব আরও শক্তিশালী হয়েছে। (বাংলা পিডিয়া ৮/৪৮৮)।
আইনের চোখে যৌতুক :
২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। তাতেও যৌতুকের ব্যাপক সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ আইনটি ২০০৩ সালে সংশোধন হয়। সংশোধিত আইনে যৌতুকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা এই : যৌতুকের অর্থ (অ) কোনো বিবাহে বর বা বরের পিতামাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সঙ্গে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বিবাহের পণ হিসেবে বিবাহের অন্য পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রি বা অন্যবিধ সম্পদ। অথবা (আ) কোন বিবাহের কনেপক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সঙ্গে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তিকে উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপরে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বিবাহের পণ হিসেবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ। (ধারা-২, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩)। (যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা-২ এর খ উপধারায়) ‘যৌতুক’ অর্থ বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের নিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে, বিবাহের পণ বাবদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, দাবিকৃত বা বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষেকে প্রদত্ত বা প্রদানের জন্য সম্মত কোনো অর্থসামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ, তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ্) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে না।’ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এর ২(ঞ) ধারায় যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, ‘(অ) কোন বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সঙ্গে জড়িত বর পক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা পূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসেবে কনে পক্ষের নিকট দাবিকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ;’ অথবা ‘(আ) কোনো বিবাহের কনে পক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সঙ্গে জড়িত বর পক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তিকে উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসেবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদসমূহ কে যৌতুক বলা হবে।’
উচ্চ আদালতে যৌতুক বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যে রায় প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
‘যৌতুক সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত তখনই যৌতুক হইবে যখন বিবাহের পূর্বে বা বিবাহের সময় দাবি করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত (Victim) মহিলার স্বামী, স্বামীর পিতা মাতা, অভিভাবক বা যে কোনো ধরনের আত্মীয়স্বজন যে কোনো সময় বিবাহের প্রতিদান হিসেবে যৌতুক দাবি করলেও অত্র ধারায় অপরাধ করিয়াছেন।
[৯ বি এল ডি (এইস সি ডি) ৭৩]
ধারা ২, ৪, ৬-স্বামী কর্তৃক তাহার স্ত্রীকে তাহার বাড়িতে নেওয়ার জন্য ১০০০০ টাকা দাবি যৌতুক কিনা।
যৌতুকের ব্যাখ্যা : ধারা ২ তে দেওয়া হইয়াছে। বিবাহ শুধু উৎসব নয় ইহার উভয়ের মর্যাদার পরিচায়ক-টাকা অথবা মূল্যবান জামানত বিবাহের বিনিময়ে চাওয়া হইলে উক্ত টাকা যৌতুক।
[৪০ ডি এল আর ৩৬০]
আইনসভা খুব সতর্কতার সহিত লক্ষ্য করেন যে, শুধু বিবাহের পূর্বে বা বিবাহের সময় যৌতুক গ্রহণ করা বা সহযোগিতা করাই অপরাধ নহে। কিন্তু বিবাহের পরে যৌতুক চাওয়া হইলেও এই অপরাধের আওতাভুক্ত হইবে।
[৪৬ ডি এল আর (১৬৯) এডি]
বিবাহের প্রতিদানে সম্পতি দেওয়া বা দেওয়া হইবে একই মর্মে স্বীকার করাকে যৌতুক বলা হয়। যৌতুক বলিতে গেলে যে কোনো সম্পতি বা মূল্যবান জামানত যাহা দেওয়া হইবে বা প্রত্যয় বা পরোক্ষভাবে দেওয়ার জন্য পক্ষগণের সঙ্গে সম্মতি সৃষ্টি হইয়াছে যাহা, যাহা ক্লজ (ক) এবং (বি)-এর অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয়ত যাহা দেওয়া হইয়াছে বা দেওয়া হইবে বলিয়া স্বীকার করিয়াছে এবং যাহা বিবাহের প্রতিদানে বিবাহের পূর্বে বা পরে যখনই দেওয়া হোক না কেন। কোনো সম্পতি বা মূল্যবান জামানত দেওয়া হইবে বা দেওয়ার জন্য বিবাহের চুক্তিবদ্ধ হইয়া থাকিলে তাহা যৌতুক হিসেবে গণ্য হইবে।
[৩৭ ডি এল আর ২২৭]
যৌতুক দাবি করিবার দন্ড (Penalty for demanding dowry)
‘যদি বিবাহের কোনো এক পক্ষ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বিবাহের অন্য কোনো পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন, তাহা হইলে উহা হইবে এই আইনের অধীন একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কিন্তু অন্যূন ১ (এক) বছর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন।’ (যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা-৪)।
মামলা প্রমাণের দায়িত্ব
যিনি মামলা দায়ের করেছেন, সেই পক্ষকেই সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা মামলা প্রমাণ করতে হবে, ব্যর্থতায় আসামিকে খালাস দিতে হইবে। আসামিকে তাহার নির্দোষিতা প্রমাণের আবশ্যকতা নাই। (১৯৮৬ বি. এল. ডি (এডি) পৃষ্ঠা-১ মো. খলিল উদ্দিন বনাম রাষ্ট্র মামলার সিদ্ধান্ত)।
তালাকের পর যৌতুক মামলা
যৌতুকের অপরাধ প্রমাণ করতে হলে ঘটনার তারিখ থেকে এক বছর কাল সময়ের মধ্যে যৌতুকের কেস করতে হবে। উক্ত সময় অতিক্রান্তের পর মামলা রুজু করলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি হবে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ (এ) ধারামতে বাতিলযোগ্য হবে। (১৬ বিএলডি, এডি, ১১৮)।
যৌতুকের লোমহর্ষক পরিণতি সমাজে চলমান থাকলে পারিবারিক সৌহার্দ্য ও সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যৌতুকের সহিংসতা বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।