
ঢাকার লালবাগ এলাকার শহীদনগরের চিত্র
পুরান ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের শেষ মাথায় অবস্থিত শহীদনগর গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গার তীরে। পুরান ঢাকার অন্য এলাকাগুলোর মতো এখানেও ভবন আর সরু গলির ঘিঞ্জি এক পরিবেশ। কিন্তু পার্থক্যটা হলো, এসব ভবন তুলনামূলকভাবে নতুন। শহীদনগরকে স্বল্প-আয়ের মানুষের আবাসস্থল হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ২০২০ সালে ‘ঘনত্ব, বাসযোগ্যতা ও ঢাকা শহরের উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছিল। ওই সময় লালবাগ থানা কেবল দেশের মধ্যে নয়, পুরো বিশ্বেই সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শহীদনগরের জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব সম্ভবত লালবাগের ঘনবসতিতে ভূমিকা রেখেছিল।
ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, লালবাগ থানা এলাকার প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন বাস করেন। অন্যদিকে, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার তকমা পাওয়া চকবাজারে প্রতি বগকিলোমিটারে বাস করেন এক লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন। এ দুটো সংখ্যাই জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০১১ এর তথ্য থেকে পাওয়া। সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ এলাকার তালিকায় এরপর রয়েছে মুম্বাইয়ের জাবেরি বাজার, ম্যাকাওয়ের সেন্ট অ্যান্থনি প্যারিশ ও সুরাটের করঞ্জ।
বলা বাহুল্য, ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরগুলোর একটি। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৯ হাজার ৩৫৩ জন। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৩০ হাজার ৪৭৪ জন।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, যদিও সর্বশেষ জনশুমারির অঞ্চলভিত্তিক জনমিতি এখনো প্রকাশিত হয়নি, তবে এটা স্পষ্ট যে জনসংখ্যার আকার বেড়েছে।
ঢাকা দক্ষিণের ২৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোকাদ্দেস হোসেন জাহিদ বলেন, লালাবাগে তার ওয়ার্ডই সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ। ওয়ার্ডটির আয়তন এক বর্গকিলোমিটারের মতো, কিন্তু এখানে প্রায় দুই লাখ মানুষ বাস করেন বলে তার দাবি। এর কারণ, শহরের অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখানকার ভাড়া তুলনামূলক কম বলে স্বল্প আয়ের মানুষরাই মূলত এ ওয়ার্ডটিতে বাস করেন।
তিনি বলেন, শহীদনগরে তিন বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিলে আপনাকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। অন্য এলাকায় এ ভাড়া ৪০ হাজারের কম হবে না। তিনি আরও জানালেন, আজিমপুরে একই ফ্ল্যাটের ভাড়া হবে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
তিনি জানান, এ এলাকার ১৪ হাজার পরিবারের মাঝে তারা টিসিবির কার্ড সরবরাহ করেছেন। টিসিবি থেকে পণ্য এলে প্রথম কয়েকদিন বিতরণ করতে গিয়ে তাদেরকে হিমশিম খেতে হয়। বেশিরভাগ মানুষ অল্প আয়ের হওয়ায় সরকারি জিনিসপত্র সবার মাঝে বিলাতে আমাকে সমস্যায় পড়তে হয়।
কেল্লার মোড়ে একটি টেম্পু স্ট্যান্ডের কাছে যানজট প্রায় লেগেই থাকে। এ এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কম বলে জানান জাহিদ। মানুষজন যাতায়াতের জন্য সাধারণত রিক্সা বা অটোরিক্সাই ব্যবহার করেন। শহীদনগরের বেশিরভাগ মানুষ নিউ মার্কেট অথবা চকবাজারে কাজ করেন। ফলে যাতায়াতের জন্য তাদেরকে বেশি খরচ করতে হয় না।
বেশি ঘিঞ্জি ও জনবহুল এলাকা হওয়ায় এখানে অপরাধের মাত্রাও বেশি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানান, শহীদনগরে কিশোর গ্যাংও গড়ে উঠেছে। তবে এ এলাকার বেশকিছু ভালো দিকও রয়েছে।
ঢাকার আধুনিক অংশে প্রতিবেশীদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন আজকাল দুর্বলই বলা চলে। কিন্তু লালবাগ কিংবা শহীদনগরের দৃশ্যপট একটু ভিন্ন। বেশিরভাগ মানুষ একে অপরকে জানে এবং সাধারণভাবে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
কাউন্সিলর বলেন, নগরীর অন্যান্য এলাকার মতো এই এলাকায় গ্যাসের সংকট রয়েছে। তবে পানির কোনো সংকট নেই। বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিকঠাক।
নদীর কাছাকাছি হওয়ায় শহীদনগর এলাকায় বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও বরিশালের বাসিন্দা। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে তিনটি প্রধান সড়ক রয়েছে। জাহিদ দাবি করেন, জেএন সাহা রোড এলাকায় ৬০ শতাংশ লোক স্থানীয় এবং বাকি ৪০ শতাংশ শরীয়তপুর, মাদারীপুর কিংবা বরিশালের।
জাহিদ বলেন, শহীদনগরের জনসংখ্যা গণনা করলে দেখা যায়, মাত্র পাঁচ শতাংশ ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা, বাকিরা শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও বরিশালের।
৬০ বছর বয়সী ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান লালবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের ভেতরে বসে টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখছিলেন। তিনি জানান, ছয় বছর আগে তিনি লালবাগ থেকে চকবাজার এলাকায় বাসা বদল করেন। হাবিবুর বলেন, শহীদনগর এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় লালবাগ এলাকার জনসংখ্যা বেড়েছে।
লালবাগে জন্মগ্রহণকারী এবং বেড়ে ওঠা হাবিবুর রহমান বলেন, শহীদনগর এক সময় চর ছিল; পরে জায়গাগুলো উন্নত হয়েছে এবং এখন এই এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ বসবাস করে। শহীদনগরে ভাড়া কম হলেও এবং বেশিরভাগ মানুষই স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে আসা। লালবাগের পুরনো এলাকায় বাড়ি ভাড়া বেশি। যেমন ঢাকেশ্বরী রোড এলাকা।
ঢাকেশ্বরী রোড এলাকায় জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘যানজট এই এলাকার একটি বড় সমস্যা, তবে বাসিন্দাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের অধিকাংশই স্থানীয় এবং আমরা একে অপরকে চিনি, কিন্তু শহীদনগরের মতো জায়গায় যেখানে নতুনরা বাস করে, সেখানে অপরাধমূলক কর্মকা- এবং অন্যান্য সমস্যা বেশি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, যখন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় উচ্চ ঘনত্ব থাকে, তখন সাধারণ সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে ইউটিলিটি পর্যন্ত সবকিছুতে বড় ধরনের চাপ পড়ে।
তিনি বলেন, উচ্চ ঘনত্বের এলাকার মানুষজন সঠিকভাবে সুযোগ-সুবিধা পাবে না এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ বঞ্চিতও হবেন। যানজট বেশি হবে। মজার বিষয় হলো, এলাকার অনেক মানুষই বুঝতে পারেন না যে, তারা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে আসছেন।
আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- মানুষের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। তারা লক্ষ্য করে না যে, পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে তারা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা ভাবছে এটি স্বাভাবিক।
এখানে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার চাইলে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে বলে মত দেন আদিল মোহাম্মদ খান। তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে নগরীতে নতুন নতুন এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারের।