ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

হারিয়ে যাচ্ছে শীতলপাটি

প্রচন্ড গরমে গাছতলায় বসে আয়েশি গল্পের দিন এখন আর নেই

বাবু ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ৯ এপ্রিল ২০২৩

প্রচন্ড গরমে গাছতলায় বসে আয়েশি গল্পের দিন এখন আর নেই

সিরাজগঞ্জে শীতলপাটি তৈরিতে ব্যস্ত দুই নারী

গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহে বাড়িতে কিংবা গাছতলায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে গল্প করা বা একটু আরাম করার সেই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য শীতল পাটির কদর নেই। আর্থিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতা এবং ক্রেতা স্বল্পতার কারণে এই শিল্পের কারিগরেরা চরম দুর্দিনে পড়েছেন। এখন এই শীতল পাটি কোথাও বিক্রি হচ্ছে এমন  দৃশ্য খুবই কম চোখে পড়ে। বর্তমানে প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে  ঐতিহ্যের এই শীতল পাটি শিল্পটি হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রান্তিক পর্যায়ে শিল্পটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। শীতল পাটি তৈরি করে তা বিপণন করা হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে মাত্র কিমি দূরে। গ্রামের অনেকের বাড়ির ঘর থেকে আকাশের চাঁদ দেখা যায়। তবে গ্রামের মানুষ পরিশ্রমী। কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। উপজেলার এই গ্রামটির বেশিরভাগ মানুষই সনাতন ধর্ম হিন্দু সম্প্রদায়ের। গ্রামে নারী-পুরুষেরা বাপ-দাদার আমল থেকেই শীতল পাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। শীতল পাটি বুনন বিক্রি করেই তাদের সংসার চলে। বর্তমানে প্লাস্টিকের পণ্যের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শীতল পাটি শিল্প। বেচা- বিক্রি বেশি না থাকায় কারিগর পাচ্ছে না পরিশ্রম অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য। এর পরও এই এলাকার নারীরা শত কষ্টে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবারের প্রায় ৮০০ নারী-পুরুষ তাদের এই পৈতৃক পেশা হওয়ায় এখনো টিকিয়ে রেখেছেন শিল্প।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের তরুণ, বৃদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম সম্প্রদায়ের সকল ধর্মের কারিগর রয়েছেন। পুরুষেরা জমি থেকে পাটি বেত কেটে আনছেন। পরে সেগুলো দা দিয়ে এক ধরনের বেতী বানিয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হচ্ছে। বেতীগুলো রোদে শুকানোর পর বাহারি রং দিয়ে আবার রোদে শুকানো হয়। এর পর নারী পুরুষ শ্রমিকরা নিপুণ হাতে তৈরি করছে শীতল পাটি। প্রকারভেদে এক একটি শীতল পাটি বিক্রি হয় প্রায় এক হাজার থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। সোহাগী, অনিতা, সিথী রানী, রাত্রী বৃষ্টি এই নারী কারিগরেরা বলেন, তাদের শীতল পাটির টাকায় চলে সংসার। শীতল পাটির কদর অনেকটা কমে গেছে। শীতল পাটির দাম কিছুটা বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি। পাটির আকার অনুযায়ী কারিগরেরা পান ২শ ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৩শ টাকা পর্যন্ত। তাদের একটি পাটি বুননে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগে। একটা পাটি বুননে যে পরিশ্রম আর সময় লাগে সে অনুযায়ী ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না বলে জানান।

একটা সময় চাঁদপুরের এই শীতল পাটি উপজেলা এবং জেলার চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করা হতো। কিন্তু কালের আবর্তে এখন আর গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য শীতল পাটি কোথাও বিক্রির দৃশ্য চোখে পড়ে না। আর্থিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতা এবং ক্রেতা স্বল্পতার কারণে এই শিল্পের কারিগরেরা চরম দুর্দিনে দিন কাটাচ্ছেন।

বর্তমানে প্লাস্টিকের পাটি মোটা পলিথিন কাগজসহ নানা প্লাস্টিক পণ্যের জন্য শীতল পাটির কদর কমে গেছে। গ্রামের শীতল পাটি শিল্পের তরুণ উদ্যোক্তা ধঞ্জয় বলেন, শীতল পাটি শিল্পটির বাণিজ্যিকভাবে ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। আমার পূর্বপুরুষেরা স্বাধীনতার পর থেকেই শীতল পাটির সঙ্গে জড়িত। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শহিদুল্লাহ সবুজ বলেন, উপজেলার ঝাঐল চাঁদপুরের গ্রামের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যগত ভাবে কাজ অত্র এলাকার গরিব সাধারণ মানুষ করে এবং এই শিল্পটা আগে যেভাবে বিস্তৃত ছিল এখন একটু সংকুচিত হয়ে আসছে। এই শীতল পাটির সবচেয়ে বড় গর্ব এটি দেশের বাইরেও রপ্তানি হয়। অথচ সেই শীতল পাটির কাঁচামাল বেত বাণিজ্যিকভাবে চাষ এবং উৎপাদন সংকুচিত হচ্ছে। আমরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কারিগরদের সঙ্গে বিভিন্ন পরামর্শ করে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে একটা ঋণের ব্যবস্থা করেছিলাম। আরও সহযোগিতার প্রয়োজন, যাতে করে এই শিল্পটাকে আরও বেশি পরিমাণে বাণিজ্যিকীকরণ করা যায়।

এই শীতল পাটি শিল্পের মাধ্যমে আরও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং শীতলপাটি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা বিদ্যমান।

বিষয়ে কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেরিনা সুলতানা বলেন, কামারখন্দেও শীতলপাটি  পল্লি  গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। এই পল্লিতে বহু বছর আগে থেকেই পাটি তৈরি হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হয়। প্রতিবছরে / বার তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় এনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কীভাবে আরও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানো যায়, মানুষের চোখে পড়ার মতো হয় এবং মানুষ যেন সেটা কিনতে আগ্রহী হয় সেই প্রশিক্ষণগুলোই দেওয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে তাদের যে সমস্যাটা হচ্ছে প্লাস্টিক পণ্য বাজার দখল করে ফেলেছে।

×