ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২

বিলুপ্ত হয়নি আজও

মধ্যযুগীয় সাহিত্য চর্চার অনন্য নিদর্শন পুঁথি

সঞ্জয় সরকার

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ৬ নভেম্বর ২০২২

মধ্যযুগীয় সাহিত্য চর্চার অনন্য নিদর্শন পুঁথি

টং দোকানে বসে বই বাঁধাই করছেন আব্দুর রহমান বয়াতি

মধ্যযুগের সাহিত্যচর্চার অনন্য নিদর্শন পুঁথি। লোকগবেষকদের মতে, পৃঁথির ব্যপ্তিকাল আঠারো থেকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত। তবে বিশ শতকেও কোনো কোনো এলাকায় পুুঁথিচর্চার কিছুটা প্রচলন ছিল। কিন্তু একুশ শতকে এসে পুঁথির প্রচলন সম্পূর্ণভাবে উঠে যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে, গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু-একজন লোককবি এখনও নীরবে-নিভৃতে পুঁথিসাহিত্যের ঐতিহ্যটি ধরে রেখেছেন। তেমনই একজন নেত্রকোনার পুঁথিকার আব্দুর রহমান বয়াতী। যদিও বিলুপ্তপ্রায় এ সাহিত্যচর্চায় কোনো স্বীকৃতিই মিলেনি তার। এমনকি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি তার একটি লেখাও।
সত্তরোর্ধ আব্দুর রহমান বয়াতীর বসবাস নেত্রকোনা সদর উপজেলার তেলিগাঁতি গ্রামে। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় লেখাপড়ার খুব একটা সুযোগ পাননি। কিছুদিন মাদ্রাসায় আবার কিছুদিন একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে শিক্ষাজীবনের ইতি টানেন। এরপর জীবিকার তাগিদে মক্তবে শিক্ষকতা করেন।

ঢাকায় ফেরি করে বিক্রি করেন গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বই। কিন্তু তা করে সংসার চলছিল না। তাই একসময় বেছে নেন বই বাঁধাইয়ের কাজ। নেত্রকোনা শহরের মোক্তারপাড়া মাঠের এক কোনার একটি টংঘরে বসে এখনও প্রতিদিন বই বাঁধাই করেন তিনি। আর এর উপার্জন দিয়েই চালান সংসার।
শৈশবকাল থেকেই আব্দুর রহমান সঙ্গীতানুরাগী। কিশোরকালে কবিগানের আসরে কবিয়ালদের যুক্তিতর্ক ও উপস্থাপনা দেখে কবি হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। তখনই শুরু করেন লেখালেখি ও সঙ্গীতচর্চা। বার্ধক্যে পৌঁছেও সে চর্চা ধরে রেখেছেন। টং দোকানে বসেই লিখে যাচ্ছেন পুঁথি, ভাট কবিতা, বাউলগান, কবিগান ও জারিগান। তার উল্লেখযোগ্য দুটি পুঁথি হচ্ছেÑ বাঙালির ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম অবলম্বনে লেখা ‘রক্তে লেখা পুঁথি’ এবং মহররমের কাহিনী অবলম্বনে লেখা ‘ইমাম হাসান ও হুসাইনের জারি’। এছাড়াও ’৭১ এর দলিল, প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক কবিতা, নারীর অধিকার, মুক্তা কাহিনী, মে দিবসের কবিতা, নেত্রকোনা ট্র্যাজিডি দিবস প্রভৃতি নামে বেশকিছু ভাট কবিতা এবং বঙ্গবন্ধু বিষয়ক জারি, শিক্ষার জারি, কৃষি বিষয়ক জারি, একুশের চেতনার জারি, পদ্য-বিষাদ জারি প্রভৃতি নামে বেশকিছু জারিগান লিখেছেন তিনি। এর বাইরে লিখেছেন কয়েক’শ বাউল গানও। আব্দুর রহমান নিজেও গান করেন। বাজাতে পারেন একতারা, দোতারা, বেহালাসহ অনেক ধরনের লোকবাদ্য যন্ত্র। এ কারণে স্থানীয় বিভিন্ন মেলা-উৎসবেও ডাক পড়ে তার।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আব্দুর রহমানের একটি লেখাও বই আকারে প্রকাশ হয়নি। দারিদ্র্যের কারণে বই প্রকাশের চিন্তা করারও সুযোগ পাননি তিনি। আক্ষেপ করে আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমার প্রত্যেকটি লেখাই ইতিহাসের দলিল। এগুলো পাঠ করলে নতুন প্রজন্ম দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানবে এবং পুঁথি বা ভাট কবিতার মতো লোকসংস্কৃতির বিলুপ্তপ্রায় প্রকরণগুলোর সঙ্গে পরিচিত হবে।’
ইতিহাসবিদ আলী আহাম্মদ খান আইয়ুব বলেন, আব্দুর রহমান বা তার মতো লোককবিরাই আমাদের মূলধারার কবি। তাদের লেখায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন আছে। আছে আদি সাহিত্যের পরিচয়। তাই এসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, স্থানীয় প্রশাসন বা বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন।’ কিন্তু পুঁথিচর্চায় নিমগ্ন সাধক আব্দুর রহমানের এ আর্তি কি তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছবে?   

 

×