হেমন্তে ছাতিম তরুতে ফুটেছে ম ম গন্ধের ফুল
হেমন্তে ছাতিম ফুল জানান দিচ্ছে নবান্ন আসছে সঙ্গে শীত আসছে। পিঠাপুলি খাওয়ার দিন আসছে। প্রায় দুর্লভ দর্শন হয়ে পড়েছে অসাধারণ সুন্দর ছাতিম তরু। তারপরও দেখা মিলল পথ চলতে।
মাঝ রাত পেরিয়ে গিয়েছে। শিশির ঝরছে একটু করে। পথ নির্জন প্রায়। মাঝে-মধ্যে রিক্সার ক্রিংক্রিং শব্দ। বগুড়া নগরীর সার্কিট হাউসের সামনের সড়কটি একটু অন্যরকম। নিশুতি রাত ছিমছাম। স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় গাছের পাতাগুলো চিকচিক করছে। শোনা গেল প্রহর গোনা পাখি পেঁচার ডাক। মনে হচ্ছিল স্বপ্নের ঘোর। হঠাৎ নাকে ঝাপটা দিয়ে গেল ম ম গন্ধে মাখা হেমন্তের মৃদু হাওয়া। যেন এক মধুময় সৌরভ। উপেক্ষা করা গেল না মোটেও। ইতি উতি তাকাতেই বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (সাবেক ভিএম স্কুল) এক কোণায় চোখে পড়ল ঝাঁকড়া পাতা পল্লব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু এক বৃক্ষ। অতি পুরনো। এই বৃক্ষের নাম ছাতিম। যে ফুলের গন্ধ ভেসে যাচ্ছে।
বৃক্ষটি ১৮৬৯ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আছে। গুঁড়িতে বাকলগুলো কুন্দের মতো ফুলে আছে। যাতে বৃদ্ধের মুখের বলি রেখার মতো অজস্্র সরু স্ফীত রেখায় ভরা। ওপরে গুচ্ছ গুচ্ছ পাতা। ফোটা ফুলের থোকায় কি মায়াময়তা। নীরবে দাঁড়িয়ে সৌরভের মিতালী করছে রাতের ঝিরিঝিরি হাওয়ার সঙ্গে। মমতার স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছে পত্র পল্লবে। ছাতিম তরুর সঙ্গে ছাতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কান্ড কিছুটা লম্বা হয়ে শাখা-প্রশাখায় পাতার বিস্তারে মেলে ধরে। কান্ডের কয়েক ধাপ গাঢ় সবুজ পাতায় সাজানো। এই পাতা থাকে ভর বছর। তাই ছাতিম তলা ছায়াময়ও থাকে ভর বছর। ঘন ছায়ার জন্য সাধু সন্ন্যাসী ও মুনি ঋষিরা ধ্যানে বসতেন ছাতিম তরু তলে। পাতার ধরন বর্ষার ফলকের মতো। কান্ডের গ্রন্থিতে সাধারণত সাতটি পাতা বৃত্তাকার হয়ে থাকে। যে কারণে সংস্কৃতিতে এর নাম ‘সপ্তপর্ণী’। ড. নওয়াজেশ আহমেদ তাঁর বাংলা বনফুল গ্রন্থে ছাতিমের অনেক নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন- সুপর্ণক, পত্রবর্ণ, শুক্তিপর্ণ, গন্ধিপর্ণ, গুচ্ছপুষ্প, শারদী বিনক ইত্যাদি।
ছাতিম তরুর বড় একটি তথ্য আছে শান্তি নিকেতনে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি নিকেতনে সমাবর্তনের সময় প্রথম উপহার দিতেন ছাতিম পাতা। বর্তমানে যারা মধ্যবয়সী তারা ছাতিমের সঙ্গ পেয়েছেন একটু ভিন্ন ভাবে। নিকট অতীতে স্কুল- কলেজের শ্রেণিকক্ষে ব্ল্যাক বোর্ডের ওপর সাদা চক পেন্সিলে লেখা হতো। সেদিনের সেই ব্ল্যাক বোর্ড তৈরি হতো ছাতিম কাঠ দিয়ে। ছাতিমের কাঠ হালকা ও মসৃণ। কাঠ পেন্সিল তৈরিতেও ব্যবহার হয় ছাতিম কাঠ।
ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাল্সটোনিয়া স্কলার। তবে ছাতিম গাছের ইংরেজি নামটি একটু বিদঘুটে- ‘ডেভিল ট্রি’। বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় ভূতের গাছ। যদিও ভূতপ্রেত কুসংস্কার তারপরও অতীতে গভীর রাতে এই গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় গা ছমছম করত। এই গাছকে নিয়ে লোক ছড়া আছে ‘শ্যাওড়া গাছে পেতনী ঠাসা, ছাতিম গাছে ভূতের বাসা’। প্রযুক্তির এই যুগে ভূত প্রেত কবে পালিয়েছে। দুর্লভ এই গাছকে রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ নেই। বর্ষায় বৃক্ষরোপণের মৌসুমে অনেক গাছের চারা রোপিত হয়। শুধু থাকে না ছাতিম তরুর চারা বা বীজ।
একটা সময় দেশে অনেক ছাতিম তরু ছিল। যা ছিল প্রকৃতির ছাতা। ছাতিম কাঠের বাণিজ্যিক মূল্য না থাকায় ‘বাণিজ্যিক যুগে’ এই গাছ কেউ রোপণ করে না। উল্টো ছাতিম গাছ কেটে ফেলে। কে আর সৌন্দর্য ও মধুগন্ধে এই তরু রোপণ করে। এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে ছাতিম তরু। যা আছে তাও কর্তনের খাতায় উঠছে। কতদিন আর রক্ষা করা যাবে। বর্তমান প্রজন্ম ছাতিম তরু ঠিকমতো চেনে না।
ছাতিমের ফুল ফোটা শুরু হয় হেমন্তে। শীতের মধ্যভাগ পর্যন্ত থাকে। গাছের সকল প্রশাখা পাতা লুকিয়ে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ছাতিমের ফুলও সবুজাভ। ফুলের নিচের অংশ নলের মতো। ওপরের অংশে পাঁচটি পাপড়ি সামান্য বাঁকানো। পরাগ কেশ ও গর্ভকেশ পরস্পর সংযুক্ত। ফলে তীব্র মধুগন্ধ হাওয়ায় ভেসে যায় দূর বহুদূর। ছাতিমের ফল অনেকটা লম্বা। শীতের শেষে ফলগুলো গাছের আরেক শোভা এনে দেয়। এর বীজ রোমশ সহজেই চারা গজিয়ে ওঠে।
ছাতিমের রয়েছে অসাধারণ ভেষজ গুণ। ছাল, আঠা, জ্বর, হাঁপানি, ক্ষত, আমাশয় ও কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় বহুকাল থেকে ব্যবহৃত। ছাতিম তরুর আদি নিবাস বাংলাদেশ সহ ভারত চীন মিয়ানমার শ্রীলঙ্কা।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে- ছিটিয়ে ছাতিম তরু আছে। যে সংখ্যা খুবই কম। ছাতিম তরু এখনো ফুলের গন্ধে অস্তিত্ব জানান দেয়। আর কতদিন তা দিতে পারবে! মুনিঋষিরা ধ্যানে বসে জপতপের জন্য ছাতিম তরু খুঁজে ফেরে।