ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

সম্প্রীতির বারতায় উজ্জ্বল রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:৪২, ১৫ অক্টোবর ২০২২

সম্প্রীতির বারতায় উজ্জ্বল রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন

শিল্পকলায় প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন উদ্বোধন করেন সৈয়দ আকরম হোসেন

সুরের  স্রোতধারায় রঙিন রূপে ধরা দিল শুক্রবারের সকালটি। সেই সুরের মাঝে ব্যক্ত  হলো অভয় বাণী।  প্রকাশিত হলো বাঙালিত্বের অহঙ্কার। যে অহঙ্কারে  ধর্মান্ধতাকে ছাপিয়ে সামনে এলো সম্প্রীতির বারতা। সেই সুুবাদে গানে গানে উচ্চারিত হলো সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রতিবাদ এবং মানবিক সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয়। আর সম্প্রীতির  সেই অঙ্গীকারে সঙ্গী হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর সৃষ্টির ঐশ্বর্যে এভাবেই ছুটির দিনের সকাল থেকে রাত অবধি বয়ে  গেল মানবিকতার সুরধ্বনি। শুরু হলো তিন দিনব্যাপী জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন। শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালা মিলনায়তনে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ আয়োজিত চল্লিশতম এই সম্মেলন চলবে রবিবার অবধি। কিশোর ও সাধারণ বিভাগের গানের প্রতিযোগিতার সঙ্গে সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা, গীতি আলেখ্য, কবিতার শিল্পিত উচ্চারণসহ বহুমাত্রিক বর্ণিলতায় সেজেছে এই বার্ষিক অধিবেশন। সঙ্গে চলবে প্রতিনিধি সম্মেলন।
শরতের সকালে বোধনসঙ্গীতের আশ্রয়ে উদ্বোধনী অধিবেশনের সূচনা হয়। মানবিকতার জয়গানে জেগে ওঠার প্রত্যাশায় অনেকগুলো কণ্ঠ মিলে যায় এক সুরে। সকলে মিলে গেয়ে ওঠেÑ  আপনি অবশ হলি, তবে বল তুই দিবি কারে? উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া ভেঙে পড়িস নারে ...। এরপর বাকি অতিথিদের সঙ্গী করে প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ আকরম হোসেন। উদ্বোধনী পর্বের সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের নির্বাহী সভাপতি ড. আতিউর রহমান। স্বাগত বক্তব্য দেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বুলবুল ইসলাম।
অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন,  পৃথিবীর দিকে তাকান। আমি ও আমরা ভোগ করতে চাই, লোপ করতে চাই, আমরা এটাকে অধিকার করতে চাই। আমরা বলি- এটা আমার ও আমাদের। তো এটা করতে  গেলে প্রতিপক্ষকে নিস্ক্রিয় করতে হবে। এভাবেই শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এরপর অন্তর্বর্তীকালীন লড়াই তো লড়ছে।  বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের তত্ত্ব তালাশ তিনি বলেন,  সমাজ বিচ্ছিন্ন বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যে আমি’র জন্ম হয়েছিল; সেই আমি’র প্রথম জিনিসটা হলো লোভ। প্রচন্ড লালসার কারণে প্রযুক্তিকে অন্তর্গত করে ক্রমশ একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্রমশ মানুষের সুকুমারবৃত্তি, কল্যাণবোধ, মানবধর্মকে বিনষ্ট করার জন্য সচেষ্ট থেকেছে সেই  আমি শক্তিটি। এই শক্তিটি গান, শিল্প, সাহিত্য বা সামগ্রিকভাবে নন্দনতত্ত্ব চর্চাকে বিনষ্ট করে মানুষকে শাসন- শোষণ ও প্রতিবাদহীন করে তোলার প্রয়াস নিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ধর্মের নামে যে সাম্প্রদায়িকতা তাকে স্রেফ সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে মনে করলে ভুল হবে। এটা কিন্তু বিশেষ পুঁজিবাদী, সেটা কর্পোরেট পুঁজি হতে পারে, ব্যবসায়িক পুঁজি হতে পারে, শিল্প পুঁজি হতে পারে। যাই হোক না কেন, তাদেরই স্বার্থে, তাদেরই আমি ও আমরা ভোগ করতে চাই এ মানসিকতা থেকেই তৈরি হয়েছে এই কৌশল। ধর্মান্ধতার নামে সাম্প্রদায়িকতা-এগুলো সবই কিন্তু একই উৎস থেকে এটা ভুললে চলবে না। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানবিক মূল্যবোধ ও বাঙালীর নন্দনতত্ত্বকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালীর আত্মপরিচয় বিকাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানের কথা তুলে ধরেন ড. আতিউর রহমান বলেন,  একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে কবিগুরুর গানের অনুভব  আমরা লক্ষ্য করেছি। সুরের আশ্রয়ে তিনি যে মুক্তির ডাক দিয়েছেন, স্বদেশ পর্যায়ে তার গানসমূহতে তার অনুরণিত হতে দেখেছি একাত্তরে। ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’, ‘আমি ভয় করব না ভাই, করব না’,  ‘সার্থক জনম আমার’, ‘ও আমার দেশের মাটি’ অসংখ্য গানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সে হীরন্ময় সময়ে আমরা রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়েছি। তরুণ প্রজন্মকে ডাক দিয়েছেন, এই বলে ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। তারুণ্যের প্রতি এই আস্থাই আমাদের মুক্তির বড় উপায়, তিনিই আমাদের শিখিয়ে গেছেন।’ বিশে^র চলমান সঙ্কটে বিশ^কবির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তিনি বলেন, চলমান বিশ্বে অর্থনৈতিক ও সভ্যতার সঙ্কট যখন দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে, তা  বোঝা ও মোকাবেলা করতে রবীন্দ্রনাথ ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। গ্রামীণ ও নাগরিক সংস্কৃতি বিকাশে দেশজ প্রয়োজন, রাজনৈতিক উদারতা তৈরির টেকসই জমিন তৈরির প্রয়োজন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন বাঙালীর প্রতিদিনের জীবন চলায়।
বুলবুল ইসলাম বলেন,  আমাদের সমাজে এক অশুভ শক্তি প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভুল বার্তা দিয়ে সমাজে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করতে চায়। সেই শক্তিকে ধিক্কার জানানোর পাশাপাশি এবার প্রতিহত করার সময় এসে গেছে। এবারের সম্মেলনজুড়ে আমরা সেই কথাই বারবার উচ্চারণ করব। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বারংবার সম্প্রীতির  বারতা ছড়িয়ে দেব।
আলোচনা শেষে পরিবেশিত হয় আতিউর রহমান রচিত সম্প্রীতির বাংলাদেশ শীর্ষক গীতি আলেখ্য। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে, নাচের নান্দনিকতা ও কথনে  সজ্জিত পরিবেশনায় সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দিয়ে সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মাণের রূপরেখা উপস্থাপিত হয়।   
এদিন দুপুরের কিশোর বিভাগের প্রতিযোগিতার পর সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় ‘তোমায় নতুন করে পাব’ শীর্ষক গীতি আলেখ্য। এরপর ছিল সঙ্গীতানুষ্ঠান, আবৃত্তি ও নৃত্যানুষ্ঠানে সাজানো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন  ‘সম্প্রীতির সমাজ গঠনে সংস্কৃতির দায়’  শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ড. সারওয়ার আলীর সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেবেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও অধ্যাপক সাধন  ঘোষ।
সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টায়। সেদিন প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষাবিদ ও কথাশিল্পী অধ্যাপক  সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সমাপনী অধিবেশনে রবীন্দ্র পদক দিয়ে গুণী-সম্মাননা জানানো হবে শিল্পী, শিক্ষক ও সংগঠক সঙ্গীতসাধক নীলোৎপল সাধ্য ও মিতা হককে।
জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় কিশোর বিভাগের চূড়ান্ত পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়েছে শুক্রবার দুপুরে। সাধারণ বিভাগের প্রতিযোগিতা হবে ১৫ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টায়। এবারের সম্মেলনের তিন দিনের সান্ধ্যকালীন অধিবেশন সাজানো হয়েছে গুণীজনের সুবচন রবিরশ্মি, গীতি আলেখ্য, আবৃত্তি, পাঠ, নৃত্য ও গান দিয়ে।
সুরের ধারার শারদোৎসব ॥ শুক্রবার সকালে শারদোৎসবের আয়োজন করে সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুরের ধারা। লালমাটিয়া মহিলা কলেজ মিলনায়তনে এ আয়োজনে শরতের গান, গান ও ছড়াগানের সঙ্গে নাচ করে উৎসব উদযাপন করেছে সুরের ধারার শিশু শিল্পীরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সুরের ধারার শিল্পী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে সুরের ধারার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, বিগত বছরগুলোতে করোনার কারণে আমরা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারিনি। এর মধ্যে আমাদের শিশুরা অনেকটা বড় হয়ে গেছে। পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর আমাদের যে নির্ভরতা সে প্রসঙ্গে শিশুদের আমরা বোঝাতে চেয়েছি। এর ওপর ভিত্তি করে কিছু গান দিয়ে আজকের অনুষ্ঠান সাজিয়েছি।
মিলনায়তনের ভেতরে উৎসবের আয়োজন করা হলেও কাশফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল শারদোৎসবের মঞ্চ এবং তার আশপাশ। শরতের গানের সঙ্গে সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে, একসঙ্গে নেচে উদযাপন করেছে শিল্পীরা। তারা গেয়ে শুনিয়েছে ‘দেখো দেখো শুকতারা’, ‘শরত আলোর কমলবনে’, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’, ‘আমারে ডাক দিল কে’, ‘শিউলি তলায় ভোর বেলায়’ ও ‘তোমরা যা বল তাই বলো’। শরতের বন্দনা করে সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা গেয়ে শোনান ‘তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে/জানি না কি মরণ নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে ...। এছাড়াও ছিল আবৃত্তি, একক গান ও ছড়াবাদ্যে নাচ।

 

×