কোভিড আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্নাতকোত্তর চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ১০ দিন অন্তরীণ ছিলাম। এই সময়ে অমর্ত্য সেনের ঐড়সব রহ ঃযব ডড়ৎষফ : অ গবসড়রৎ পড়েছি। বইটি গত বছর প্রকাশিত হয়ে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে পরম সমাদৃত হয়েছে। ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে মাতুলায়ে জন্ম অমর্ত্য সেনের। বাবা আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষক। মা অমিতা সেন তখনকার দিনের মঞ্চের সাহসী নৃত্যশিল্পী ও প্রখ্যাত সংস্কৃত অধ্যাপক ছিলেন। আশুতোষ সেনকে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অমর্ত্যর নাম রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। ঢাকাতে ওয়ারী এলাকায় জগত কুটিরে থাকতেন আশুতোষ, অমিতা, অমর্ত্য এবং তার ছোটবোন মঞ্জু। ১৯৩৯ পর্যন্ত ঢাকার শান্ত পরিবেশে থেকে আশুতোষ সপরিবারে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। অমর্ত্যর আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু হয় ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিস স্কুলে। শান্তিনিকেতন স্কুলে এসে তিনি প্রবেশিকার পর্যায় পার হয়ে ১৯৫১ সালে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। পড়েছেন অঙ্ক ও অর্থনীতি। এরপর তিনি পড়তে যান কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। সেখান থেকে ডক্টরেট নিয়ে ১৯৯৮-২০০৪ পর্যন্ত শিক্ষকতার পর যান আমেরিকার এমআইটিতে এবং তার পরে স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য। ১৯৯৮ সালে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি আমেরিকান অর্থনীতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক।
ছেলেবেলায় শান্তিনিকেতনে পড়তে আসার আগে অমর্ত্য বাংলার নদীগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। তার উপলব্ধিতে রয়েছে এই এলাকার মানুষের জীবন বাঁচায় ও ধারণ করে এবং ধ্বংসও করে নদী। সৃষ্টি ও ধ্বংসের এই প্রক্রিয়ায় ধর্মভিত্তিক কোন পার্থক্য স্থান নেয় না। প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার নামকরা প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি শান্তিনিকেতনের মুক্ত পরিবেশে পড়াশোনা করেছেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনায় তিনি রবীন্দ্রনাথের দর্শন অনুযায়ী স্বাধীনতা ও যুক্তিকে সামাজিক প্রশান্তির দুই ভিত্তি হিসেবে জেনেছেন। তার মতে, স্বাধীনতা থাকলে যুক্তি দিয়ে তা ব্যবহার ও পরিশীলিত করা যায়। শান্তিনিকেতনে প্রাপ্ত এই অধিজ্ঞান অমর্ত্য সারাজীবন গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করেছেন। ওখানে অমর্ত্যকে গান শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি শেখেননি, কিন্তু সারাজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগ করেছেন। তার প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে কনিকা, সুচিত্রা ও রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে তিনি স্মরণে রেখেছেন। শান্তিনিকেতনে তিনি জেনারেল চিয়াং কাইসেক, মহাত্মা গান্ধী ও ইলিনয় রুজভেল্টের বক্তৃতা শুনেছেন। ইলিনয় রুজভেল্টের বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণা বিষয়ক বক্তব্য তাকে সারাজীবন সজাগ রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাকে যে দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসোব ঘোষণা ও অনুসরণ করেছিলেন তা অমর্ত্যকে সারাজীবন ধরে চিন্তার ভিত্তি দিয়ে এসেছে। অমর্ত্য পুরনো ভারতের জাতিভেদ প্রথার অসমতা ও অযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বৌদ্ধ ধর্মের সাম্যভিত্তিক মূল্যবোধে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, এমনকি নিজেকে বৌদ্ধ ধর্মাবম্বলী হিসেবে নিবন্ধিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি সংস্কৃত সাহিত্য, অঙ্ক, এমনকি বিচারিক তত্ত্বে আকর্ষিত হয়েছিলেন, যা পরবর্তী জীবনের চিন্তার প্রলম্বনে তাকে খোরাক জুগিয়েছিল। এই প্রেক্ষিতে তিনি পুরনোকালের মুক্তবুদ্ধি চর্চাকেন্দ্র হিসেবে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ও কাহিনীতে মোহিত হয়েছিলেন। তার অভিমতে আলোচনার ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার সূত্র নালন্দাতে প্রথম সূত্রপাত হয়েছিল, যা পশ্চিমের দেশসমূহে জন স্টুয়ার্ট মিল ও ওয়াল্টার বাগেহট আরও পরে এক্ষেত্রে জ্ঞান উৎসারিত অভিজ্ঞান হিসেবে গ্রহণ ও প্রচার করেছিলেন।
১০ বছর বয়সে অমর্ত্য ১৯৪৩ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন দুর্ভিক্ষের মানবতা বিপর্যস্ত অবস্থা তৎকালীন দেশীয় পত্রিকাগুলো, উদাহরণত প্রবাসী ও দেশ যথাসত্য ও যথাসময়ে বিদিত করেনি। ভারতের ব্রিটিশরাজ একনায়কত্বভিত্তিক শাসক হয়ে এদেশের বুভুক্ষু মানবতাকে অবজ্ঞা করেছে। গণতান্ত্রিক ব্রিটেনে যখন ইংরেজ মালিকানায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা স্টেটসম্যানের ইংরেজ সম্পাদক আয়ান স্মিথ মন্বন্তরের ছবি ও সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন তখন তা দেখে ব্রিটেন থেকে নির্দেশ পেয়ে তখনকার ভারতের ইংরেজ সরকার দুর্ভিক্ষ নিরসনে যথাপ্রয়োজন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ’৭০-এর দশকে এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অমর্ত্য পৃথিবীব্যাপী দুর্ভিক্ষের বিশ্লেষণ করেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন যে, দুর্ভিক্ষ মূলত খাদ্যের লভ্যতার চেয়ে খাদ্যের অধিকারভিত্তিক প্রাপ্যতার অনুপস্থিতিতে সৃষ্ট হয় এবং এই প্রেক্ষিতেই অমর্ত্য সাহসিকতার সঙ্গে বলেছিলেন, কোন গণতান্ত্রিক সমাজে, যেখানে খাদ্যের অধিকারভিত্তিক প্রাপ্যতার সূত্র গৃহীত থাকে সেখানে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হতে পারে না। দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য দূরীকরণে গণতন্ত্রের এরূপ ইতিবাচকতা এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকরা গ্রহণ করেছেন।
১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অমর্ত্য কলকাতায় এসে তখনকার সরকারী প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। তার চর্চার বিষয় ছিল অর্থনীতি ও অঙ্ক। ওই সময়ে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে কলকাতা ছিল আঁতেলদের মিথস্ক্রিয়ার কেন্দ্র। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট, বইমেলা, কফি হাউস সাহিত্য সংস্কৃতির পথক্রম, ব্রিটিশদের প্রতিকূলে রাজনৈতিক চেতনা ও সংস্কৃতির প্রভাব অমর্ত্যকে মোহিত করেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজে পাঠকালীন তিনি প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বোস, পদার্র্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক, পরিসংখ্যান পথিকৃৎ প্রশান্ত কুমার মহলানবীশ এবং কিংবদন্তীয় অর্থনীতিবিদ সুখময় চক্রবর্তী ও অমিয় দাশগুপ্তের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। এই কলেজের শিক্ষক হেনরী ডি-রোজারিও তথাকথিত নবীন বাংলা বা ইয়ং বেঙ্গলের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ও সংস্কারের জন্মদাতা ছিলেন। কলেজে পাঠকালে অমর্ত্য জন হিকসের ‘মূল্য ও মূলধন’ এবং ‘সামাজিক কাঠামো’ পড়ে মোহিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভবতোষ দত্ত ও তাপস মজুমদার অর্থনীতির সুতীক্ষè শিক্ষক হিসেবে অমর্ত্যর মনে দাগ কেটেছিলেন আর অমর্ত্য কেনেথ এরোর তখন প্রকাশিত ‘সামাজিক পছন্দ ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধ’ শীর্ষক অর্থনীতির বই পড়ে মোহিত হয়েছিলেন। মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পরে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কঠিন মনে হলেও এই বইটি আমি পড়তে ও বুঝতে পেরেছিলাম। প্রেসিডেন্সিতে ১৯৫৩ সালে পড়াশোনা শেষ করে অমর্ত্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনার জন্য যোগ দিয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতন ও প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে অমর্ত্য বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে একে ধর্মীয় বিভেদ ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার ইতিবৃত্ত হিসেবে না দেখে সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ইতিহাস বলে অনুধাবন করেছেন। তার মতে এর ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে সুদূরপ্রসারী ও ইতিবাচক দূরদৃষ্টির আলোকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
১৯৪০-এ আসন্ন দেশ বিভাগের পটভূমিতে অমর্ত্যর পিতামাতা ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে যান। সেই সময়ে অমর্ত্যর বাবার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অর্থনীতিবিদ অমিয় কুমার দাশগুপ্ত ও সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। দেশ বিভাগের দাঙ্গার সময় প্রায় ১০ লাখ হিন্দু-মুসলমান প্রাণ দিয়েছিলেন। দেশ বিভাগের নারকীয় তা-বে উভয় ধর্মের প্রায় ১৫ লাখ অনুসারী গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হন, হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা হন। সাদাত হোসেন মান্টো আক্ষেপের সঙ্গে বলেছিলেন, দেশ বিভাগ এভাবেই লাখো মানুষকে ধর্মন্ধতা ও ধর্মীয় উন্মাদনার নামে পশুত্বের ও অসভ্য উন্মাদনায় নিপতিত করেছিল। এর অনেক পরে ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ডে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে অধ্যাপনাকালীন অমর্ত্য ভারত বিভাজনের কলমধারী সিরিল রেডক্লিফের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও এসব প্রশ্নের অবতারণা করতে সক্ষম হননি।
কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে অমর্ত্য ২ বছরে স্নাতক হয়েছিলেন। পড়াশোনা করেছিলেন মরিস ডব ও পিয়ারো ¯্রাফার মতো প্রখ্যাত বামপন্থী অর্থনীতিবিদদের তত্ত্বাবধানে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনায় ব্যাপৃত থেকে খ্যাতনামা ‘প্রাইজ’ ফেলো, বক্তা অধ্যাপক এবং শিক্ষক ফেলো বা সহযোগী হয়েছিলেন। ট্রিনিটি কলেজের সঙ্গে তার সম্পর্ক সারাজীবন অক্ষুণœœ ছিল।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনাকালীন অমর্ত্য জোন রবিনসনের ‘মূলধন সঞ্চয় ও অপূর্ণাঙ্গ প্রতিযোগিতার তত্ত্ব পড়েছিলেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা সত্ত্বেও তার সঙ্গে অমর্ত্যর হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি। ১৯৬২ সালে চীন থেকে ফেরার পথে জোন রবিনসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনের সংস্কার ও প্রগতি বিষয়ে একটি অপূর্ব বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তখন তাকে আমার কাছে চীনা কমিউনিস্টপন্থী মনে হয়েছিল। অমর্ত্য তাকে মার্কসীয় নৈতিক চিন্তার ভ্রান্ত অনুসারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। জোন রবিনসনের ‘মূলধন আহরণ’কে (১৯০৬) অমর্ত্য সমর্থক সমালোচকের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেননি। তার মতে জোন রবিনসন বাজার অর্থনীতির তৎকালীন অপূর্ণাঙ্গতার আলোকে জন মেনার্ড কেইনসের লেখা দ্বারা ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। নিকি কালডরের মূলধন বিষয়ক লেখা কেইনিসীয় চিন্তাধারায় প্রভাবিত বলে অমর্ত্য মনে করেছিলেন। তার মতে কেমব্রিজে অর্থনীতিবিদদের অনুশীলন তখনকার দিনে অসমতা, দারিদ্র্য ও শোষণ বিষয়ে সোচ্চার ছিল। এসব বিতর্কে ও মত গড়নে অমর্ত্য মরিস ডব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডবের ‘১৯১৭ সাল থেকে সোভিয়েত উন্নয়ন’-এর উৎসাহী পাঠক আমিও ছিলাম। এই সময়েই অমর্ত্য তার প্রখ্যাত অর্থনৈতিক অবদান ‘প্রযুক্তির নির্বাচন’ বিষয়ে কাজ জোন রবিনসন ও মাইকেল ডবের তত্ত্বাবধানে তাদের অনুসারী না হয়েও শুরু ও (সম্ভবত) শেষ করেছিলেন। কেমব্রিজে পড়াশোনাকালীন অমর্ত্য বাংলাদেশের রেহমান সোবহান ও ড. কামাল হোসেন এবং পাকিস্তানের ড. মাহবুবুল হকের সঙ্গে বন্ধুত্বের মোড়কে অনুন্নত দেশসমূহের প্রয়োজন ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত হন। রেহমান সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে আমাকে তার ছাত্র হিসেবে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। রেহমান সোবহান কেমব্রিজে থাকাকালীন সালমা (আক্তার) সোবহানকে বিয়ে করেছিলেন। সালমা ঢাকা ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্ণধার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার বন্ধু শ্রীলঙ্কার লাল জয়বর্ধন পরবর্তীকালে হেলসিনকিতে উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্ব ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হয়েছিলেন। কেমব্রিজে অমর্ত্য কল্যাণ অর্থনীতি বিশ্লেষণে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু একমাত্র মরিস ডব ও পিয়ারো ¯্রাফা ব্যতীত অন্য কাউকে উৎসাহী কিংবা অনুসারী করতে সমর্থ হননি। অমর্ত্য তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘উন্নয়ন পরিকল্পনায় মূলধন নিবিড়তার নির্বাচন’ যা পরবর্তীকালে ‘প্রযুক্তির নির্বাচন’ হিসেবে প্রকাশিত ও পেশাগত সম্মান পেয়েছিল। ১৯৫৫ সালে অমর্ত্য ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে কেমব্রিজে স্নাতক ছাত্র হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আর অমর্ত্য কেমব্রিজ থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে এসে ২ বছরে কলকাতায় অমিয় দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে তার অভিসন্দর্ভ শেষ করার সময় পেয়েছিলেন এবং ১৯৫৬ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে অমর্ত্য নবপ্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ গঠন করার দায়িত্ব নিয়ে এর প্রধান হিসেবে কাজ করেছিলেন। একই সময়ে বুদ্ধদেব বসু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রধান ছিলেন। এর পরে ১৯৫৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হয়ে অমর্ত্য কেমব্রিজে ফিরে আসেন।
১৯৬০ সালে অমর্ত্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা কবি ও সাহিত্যিক নবনীতার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। দুই কন্যা- অন্তরা ও নন্দনার জন্মের পর ১৯৭৩ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। এর আগে ১৯৬১ সালে অমর্ত্য বিখ্যাত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটিতে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি এ সময়ে প্রখ্যাত অর্থবিজ্ঞানী ম্যাকস মিলিবান ও রজেনস্টাইন রোডানের তত্ত্বাবধানে গবেষণায়ও লিপ্ত থাকেন। (১৯৭৫ সালে রজেনস্টাইন রোডানের বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক থাকাকালীন তার ছাত্র হওয়ার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল)। ওই সময়ে অমর্ত্য এমআইটির প্রখ্যাত অর্থবিজ্ঞানী পল স্যামুয়েলসন ও রবার্ট সলোর সঙ্গে কাজ ও গবেষণা করেন। এমআইটির অধ্যাপক স্যামুয়েলসন তার ছুটির সময়ে কল্যাণ অর্থনীতির শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে তাকে সম্মানিত করেন। এর পরে তিনি স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অর্থবিজ্ঞানের ওপর অধ্যাপনা করেন। তিনি বার্কলীর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৪-৬৫), দিল্লী স্কুল অব ইকোনমিক্সে (১৯৬৩-৭১) এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৭৮-১৯৮৪) অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৬-৭৭ পর্যন্ত তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে এবং ১৯৭৭-৮৮ পর্যন্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি হার্ভাডে লামন্ট অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে ও কাজ করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। অমর্ত্য সেন ১৯৮৪ সালে অর্থনীতি সমিতি, ১৯৮৬-৮৯ সালে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমিতি ও ১৯৮৪ সালে আমেরিকান অর্থনৈতিক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সুশীল পদক ভারত রতেœ ভূষিত হন। ২০১১ সালে তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্মারক সম্মেলনে উপস্থিত থাকেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের এ্যালবাম উন্মুক্ত করেন এবং বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন (বাংলা একাডেমিতে প্রদত্ত তার বক্তৃতায় তিনি ইংরেজী ভাষার সকল প্রতিশব্দ বাংলা ভাষায় নেই বলে অভিযোগের বিপরীতে হাসতে হাসতে বলেন যে, বাংলায় ব্যবহৃত ‘ফাজিল’ শব্দের সঠিক পরিভাষা ইংরেজীতে নেই)। ১৯৭৩ সালে নবনীতার সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি ইতালিয়ান অর্থবিজ্ঞানী ইভা কলরনির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ইভার সঙ্গে বন্ধনে তিনি মেয়ে ইন্দ্রানী এবং ছেলে কবীরের জন্মদাতা হন (একমাত্র পুত্র সন্তানের নাম কবীর রেখে অমর্ত্য ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান চিরায়তভাবে অববায়িত করেছেন)। ক্যান্সারে ইভার মৃত্যুর পর তিনি এমা জর্জিনা রথচাইল্ডকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেন।
১৯৮১ সালে অমর্ত্য সেন ‘দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ’ এবং ‘প্রাপ্যতা ও বঞ্চনা’ বিষয়ক বই ও প্রবন্ধে গণতান্ত্রিক প্রশাসনে জনকুশলে বিশ্বাসী সরকারাধীন দুর্ভিক্ষ হতে পারে না বলে কালজয়ী বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন। এর আগে তার অভিসন্দর্ভ হিসেবে তিনি প্রযুক্তির নির্বাচন শীর্ষক পুস্তকে সামাজিক নির্বাচনের সূত্র হিসেবে বিনিময়যোগ্য উদ্বৃত্ত সৃজনে শ্রমিকের অধিকার ত্যাগ স্বীকারের যুক্তি তুলে ধরেন। ১৯৭০-এর দশকে তার ‘উন্নয়ন অর্থবিজ্ঞান ও সামাজিক পথ বিদর্শক’ শিরোনামে দুটি নিবন্ধে তিনি গণতান্ত্রিক সমাজের নাগরিক অধার, উদাহরণত সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা সৃষ্টি ও রক্ষাকরণের ওপর জোর দেন। ১৯৯৯ সালে অমর্ত্য ‘মুক্তির ন্যায় উন্নয়ন’ শীর্ষক বইয়ে উন্নয়নের মৌল সূত্র হিসেবে প্রকৃত স্বাধীনতাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণের যুক্তি স্থাপন করেন। তিনি এই মুক্তির ৫টি উপকরণ যথা রাজনৈতিক মুক্তি, অর্থনৈতিক সুবিধাদি, সামাজিক সুযোগাদি, স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা ও প্রতিরক্ষণীয় নিরাপত্তার প্রয়োজন অকাট্য যুক্তিতে গ্রহণীয় অবয়বে উপস্থাপন করেন। এর আগে ১৯৭৫ সালে তিনি ‘সমষ্টিগত নির্বাচন ও সামাজিক কুশল’ শীর্ষক নিবন্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতার অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক সমৃদ্ধ করার যুক্তি তুলে ধরেন। ২০০৯ সালে অমর্ত্য তার প্রকাশিত ন্যায়বিচারের প্রত্যয় কুশল অর্থনীতি ও সামাজিক নির্বাচনের সঙ্গে দর্শনগত ধারণা সংযুক্ত করেন। বিশ্বজনীন মানব অধিকার এই পুস্তকের প্রতিপাদ্য হিসেবে বিস্তৃতভাবে পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হয়েছে।
তার আত্মজীবনীর শেষ অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন, জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের অনুকূলে বোধগম্যতা- যা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আধুনিক অর্থনীতির জনক এ্যাডাম স্মিথ যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন। তার অনুধাবন পৃথিবীকে নিশ্চিতভাবে আশান্বিত করে। অমর্ত্য সেন আপনি এই যুক্তিপূর্ণ আবেদন নিয়ে বেঁচে থাকুন পৃথিবীব্যাপী আশার উৎসাহ নিয়ে।
লেখক : এমপি, সাবেক মন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদ