ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

শামীম আহমেদ

টরোন্টোর চিঠি ॥ কোথাও একটা লুকোনো বিষাদ আছে

প্রকাশিত: ২১:২২, ২৭ অক্টোবর ২০২১

টরোন্টোর চিঠি ॥ কোথাও একটা লুকোনো বিষাদ আছে

কবি মোশতাক আহমদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশ পুরনো। কত গভীর কিংবা খাঁজকাটা সম্পর্ককে পুরনো বলা চলে তা অবশ্য নির্ণয় করার চেষ্টা করিনি সেভাবে। জনস্বাস্থ্যের কণ্টকাকীর্ণ রাস্তায় আমাদের পথচলার সূত্রপাতটা খানিকটা ভিন্ন হলেও, পথের অলিগলিতে দেখা হয়েছে বারংবার। মোশতাক ভাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে ২০০৬ সালে মাস্টার অব পাবলিক হেলথ শেষ করেন। এটি ছিল ব্র্যাকের প্রথম ব্যাচ যারা আন্তর্জাতিক মানের একটি জনস্বাস্থ্য প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে কোর্সটি সম্পন্ন করে। আমি ছিলাম দ্বিতীয় ব্যাচের সবচেয়ে কম বয়সী বাংলাদেশী ছাত্র। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই ব্র্যাকের এই কোর্সটিতে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। মূলত বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যে দীর্ঘদিন কাজ করছেন এমন অনেক চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তখন এই কোর্সে ভর্তি হতেন। পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপক, বিভিন্ন দাতা সংস্থা প্রদত্ত বৃত্তি প্রোগ্রামটিকে অনেকের কাছে লোভনীয় করে তুলেছিল। আমি অবশ্য ভর্তি হয়েছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির মাস্টার্স পরীক্ষা দেবার পর ফল প্রকাশে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। অনুভব করলাম, চারদিকে ইতোমধ্যেই চাকরি খোঁজার চাপ। আমার কবি-মন চাকরি করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। একদিন দুপুর বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম পত্রিকায় এই কোর্সটির বিজ্ঞাপন। দিলাম আবেদন করে। তারপর নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে ভর্তিও হয়ে গেলাম। মোশতাক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত এখানেই। এরপর পাস করে উনি ঢোকেন ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচীতে। আমিও একবছর পর পাস করে যোগদান করি ব্র্যাকের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য কর্মসূচীতে। কর্মসূচী প্রধান এক সকালে আমাকে নিয়ে গেলেন মোশতাক ভাইয়ের কুঠুরিতে। সুন্দর করে অনেকে অবশ্য বলেন ‘কিউবিকল’। ঘুপচির মতো বসার জায়গাকে কিউবিকল বলতে আমার বেশ দ্বিধা হয়, তাই আমি ওই কুঠুরিই বলি। মোশতাক ভাইর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন আমি যাতে আফগানিস্তানে আমার নিজের কর্মক্ষেত্রে যোগদান করার আগ পর্যন্ত মোশতাক ভাইর সঙ্গেই বসি, এই সুযোগে উনার কাছে কাজও শিখতে পারব! এই হচ্ছে মোশতাক ভাইর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত। তারপর বেশিদিন আমি ওই কর্মসূচীতে থাকিনি, কিন্তু উনার সঙ্গে যোগাযোগ রয়ে গেছে কবি হিসেবে। দুজনই কবিতা লিখি, পড়ি। লেখক কবিদের চেনা গ-িতে ঘোরাঘুরি করি। বইমেলার সময় চায়ের কাপে আড্ডা দিই। এভাবে দিন, মাস, বছর ঘুরতে থাকে। বেশ ক’বছর আগে এই টরোন্টোতে বসেই খবর পাই মোশতাক ভাই কবি আবুল হাসানকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখছেন। শুনে চমকিত হই। আমার অভিজ্ঞতা বলে কবিরা যখন গল্প বা উপন্যাস লিখেন, তা অনেক সময়ই অনবদ্য হয়। কবিদের ভাষাজ্ঞান চমৎকার। শব্দের দ্যোতনা সৃষ্টিতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। গুছিয়ে জীবনকে তুলে আনতে একজন কবির চাইতে বেশি কেইবা পারেন! মাঝে লেখক শাহাদুজ্জামান, কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লিখলেন উপন্যাস ‘একজন কমলালেবু’। সেই উপন্যাস নিয়েও বিস্তর আলাপ হলো বোদ্ধাদের মাঝে। শাহাদুজ্জামানের জীবনকে সাহিত্যে রূপ দেবার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তার গদ্য মনের মাঝে যে পুলক জাগায় তা একজন নবীন পাঠককেও পরিণত হতে সাহায্য করে। তো সেই শাহাদুজ্জামানের লেখা উপন্যাস নিয়ে অনেককেই বলতে শুনেছি, এটি উপন্যাস হয়নি। জীবনানন্দের জীবনী নিয়ে একটি আলেখ্য হয়েছে বটে, তবে তাকে আদৌ উপন্যাস বলা যায় না! উল্লেখ্য, কবি মোশতাক আহমদ এবং আমার- দুজনেরই শিক্ষক ছিলেন শাহাদুজ্জামান। মোশতাক আহমদের জীবনে, অন্তত তার লেখালেখিতে শাহাদুজ্জামানের ছায়া দেখা যায়। সাহিত্যের লঞ্চঘাটে যাদের নিত্যযাত্রা, তাদের কাছে এমন আলোচনা-সমালোচনা নতুন কিছু নয়। এই কারণেই বোধহয় পরিণত লেখকরা একসময় নিজেদের অন্য সাহিত্যিকদের থেকে দূরে সরিয়ে নেন। নিজের সবটুকু ঢেলে দেন লেখার কাগজে। মোশতাক আহমদ সম্ভবত এইসব বিবেচনায় জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা উপন্যাসকে আর উপন্যাস বললেন না। নাম দিলেন ‘ডকু-ফিকশন’। ডকু-ফিকশনের নাম রাখলেন ‘ঝিনুক নীরবে সহো’। এই বইটি প্রকাশের পর আবার সমালোচনার ঝড় উঠল। তবে সেই ঝড় বইয়ের বিষয়বস্তুকে নিয়ে নয়, বরঞ্চ এর মুখবন্ধ লেখকের অবিবেচনাপ্রসূত বিষয়বস্তুর অবতারণায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তরুণ প্রকাশক রুম্মান এবং লেখক মোশতাক আহমদ এই অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং মুখবন্ধ বাদ দিয়ে নতুন সংস্করণ প্রকাশ করলেন। এই ডকু-ফিকশনটি পড়ার আগ্রহ আমার বহুদিনের। প্রথম কারণ, কবি আবুল হাসানের জীবনীকে উপজীব্য করে এই বই। দ্বিতীয় কারণ, কবি মোশতাক আহমদ এর লেখক। যাকে আমি চিনি দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের মধ্যে একপ্রকার হৃদ্যতা আছে, এ কথা বোধহয় সঙ্কোচহীনভাবে প্রকাশ করা যায়। ক্যানাডার টরোন্টোতে বসে এই বই কিভাবে পাব? লেখক জানালেন তার বন্ধুর কাছে একটি অতিরিক্ত কপি আছে। আমাদের তিনি যোগাযোগও করিয়ে দিলেন। শনিবার যখন রুপেন ভাই, অর্থাৎ মোশতাক ভাইর বন্ধু, আমাকে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে নক করলেন, তখন আমি সপ্তাহান্তের সমস্ত কাজ গুছিয়ে ক্লান্ত। কলটা আর ধরা হলো না। সন্ধ্যার দিকে আমার নিয়মিত যাত্রা ড্যানফোর্থে পৌঁছে গরম গরম চিকেন প্যাটিসের সঙ্গে চিনি-ছাড়া চা সহযোগে আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরে দেখি রুপেন ভাই একাধিকবার কল দিয়েছেন। পরে একটা ছোট্ট মেসেজও দিয়েছেন যে, তিনি থাকেন মিসিসগা, টরোন্টো থেকে গাড়িতে ঘণ্টাখানেক দূরত্বের একটা শহরে। খুব একটা নিয়মিত আসেন না টরোন্টো। তাই বইটি নিতে হলে আজই নিতে হবে, অন্যথায় যোগাযোগ নাও ঘটতে পারে। আসা-যাওয়া মিলিয়ে ২৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছি সেদিন প্রায় নব্বই মিনিটে। এর মাঝে বাংলাপাড়ায় অবস্থানের সময় তো আছেই। আবার এত রাতে গাড়ি হাঁকিয়ে অতদূর ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। নানা জায়গায় ফোন দিয়ে অবশেষে নটর ডেমের বড় ভাই ড্যান হাকিমকে পেলাম, তার অফিসও ওই বাংলা পাড়াতেই। ড্যান ভাই বিনয়ী মানুষ, সম্মতি দিলেন আমার বইটি রুপেন ভাইর কাছ থেকে সংগ্রহ করে রাখবেন। রবিবার সন্ধ্যায় বাংলা পাড়ায় গেলাম বইটি সংগ্রহ করতে। ভিন্ন প্রচ্ছদের বইটি হাতে নিয়ে মনে হলো এক টুকরো বাংলা সিনেমা আমার হাতে চলে এলো। নীল-হলুদ-লাল রঙের প্রচ্ছদে প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার বইটি উল্টে-পালটে বুঝলাম পেন্ডুলামের প্রকাশক রুম্মান ভাল কাজ করেছেন। লেখালেখি কিংবা প্রকাশনা, যাই হোক না কেন, তরুণদের এই আশাবাদী পদযাত্রা আমার ভাল লাগে। দশ ডলার খরচায় মোশতাক আহমদের ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ হাতে পেয়ে কেমন যেন একটা শান্তির অনুভূতি হলো। আগামী সপ্তাহান্ত কাটবে এই বইটি পড়ে। কবি আবুল হাসান কিংবা তাকে নিয়ে বইয়ের মাঝে যেমন একটা শান্ত স্থিতধী ভাব আছে, গত এক সপ্তাহের টরোন্টোর বাংলাদেশী ক্যানাডিয়ানদের জীবনও কেমন যেন অনেকটা তেমনই বিষণœ ছিল। আমাদেরই এক মেয়ে, এক দুর্ভাগা বাংলাদেশী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, মাত্র সতের বছর বয়সী নাদিয়া এই টরোন্টোর বুকে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল। পুরো ঘটনায় নাদিয়ার কোন দোষ ছিল না। সে সমস্ত নিয়ম মেনেই রাস্তা পার হচ্ছিল, কিন্তু বাম দিকে মোড় নিতে যাওয়া একটি গাড়ি চলে যায় নাদিয়ার শরীরের উপর দিয়ে। হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা জানান নাদিয়া আর নেই। এদিকে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলা হলে এখানকার মানুষের মনও কেঁদে উঠে। মন্ট্রিয়াল, টরোন্টোর বাংলাদেশীরা গত দু’সপ্তাহে এই ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন ব্যানার, প্ল্যাকার্ডসহ। সঙ্গে নাদিয়ার এই অনাকাক্সিক্ষত প্রস্থান, সবাইকে বেদনাবিধুর করেছে। প্রবাসীদের জীবন আসলে বাইরে থেকে যতটা মনে হয়, ততটা ঝা-চকচকে নয়। হ্যাঁ, অনেকেই হয়ত দেশ ছেড়ে নিজেকে অন্য দেশের নাগরিক ভাবতে ভালবাসেন, অন্তত চেষ্টা করেন, কিন্তু বেশিরভাগের জীবনের অনেকটা অংশজুড়ে থাকে বাংলাদেশ। আজ যখন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠলাম, তখন বাইরে অন্ধকার। শরতের এই সময়টা ক্যানাডায় আঁধার জমা শুরু হয়। বাসার ভেতরে হিটারে তাপমাত্রা বাড়ে। জানালার অল্প খোলা ফাঁক দিয়ে শোঁ শোঁ করে হিমশীতল বাতাস আসতে থাকে। এই সময়টায় আমি কিছুক্ষণ একা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। এগারতলার উপর থেকে নিজেকে ভাসমান মনে হয়। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া দু’একজন মানুষকে দেখলে মনে হয় জীবনের চলার পথের অনিশ্চয়তায় তারা ক্লান্ত। দু-একটা গাড়ি সাঁ করে ছুটে চলে এদিক ওদিক। বাইরে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। শপার্স ড্রাগ মার্টের কোণায় জীবনের সবটুকু প্রাপ্তিকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে আছে দু’একজন ঘরহীন মানুষ। মেঘ কালো করে বৃষ্টি নেমেছে। কিন্তু বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য টিনের কোন চালা নাই এদেশে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে আমার প্রকাশিতব্য উপন্যাস ‘কোথাও একটা লুকোনো বিষাদের’ ভেতরে ঢুকে যাই। কাঁধে স্পর্শ অনুভর করি। বুঝি উপন্যাসের চরিত্র মুনা গরম এককাপ কফি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আমার টরোন্টোর এই নিঃসঙ্গ জীবনে। ২৭ অক্টোবর ২০২১ টরোন্টো, ক্যানাডা
×