
‘বুদ্ধদেব গুহ’ বাংলা সাহিত্যাকাশের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। ছবি আঁকাসহ ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তাঁর একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি নিজে এঁকেছিলেন। ‘বুদ্ধদেব গুহ’র সহধর্মিণী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী ‘ঋতু গুহ’ ২০১১ সালে মারা যান। প্রায় একশত ত্রিশটি গ্রন্থের রচয়িতা ‘বুদ্ধদেব গুহ’র রচনায় নিজস্ব দৃশ্যকল্প পরিলক্ষিত হয়। এক স্বপ্নালু বিমূর্ততা ও রোমান্টিক ভাবাবেগময় নৈসর্গিক নৈঃশব্দের অন্তর্জাল তাঁর রচনায় প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস জঙ্গলমহল। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে কোয়েলের কাছে, উষ্ণতার জন্য, মাধুকরি, কোজাগর, অববাহিকা, বালি, পঞ্চপ্রদীপ, কুমুদিনী, বাতিঘর, চন্দ্রায়ন, বনবাসর, শালডুংরি, গামহারডুংরী, সমুদ্র মেঘলা, অবরোহী, মহুলসুখার চিঠি, বিন্যাস, সবিনয় নিবেদন, ভোরের আগে, হলুদ বসন্ত, বাজা তোরা রাজা যায়, অববাহিকা, বাবলি, চারকন্যা, চারুমতি, লবঙ্গীর জঙ্গলে, খেলাঘরসহ অসংখ্য রচনা।
‘মহুলসুখার চিঠি’ নামক উপন্যাসে ‘বুদ্ধদেব গুহ’ বলেন- “মদের নেশা, প্রেমের নেশা, কামের নেশা, টাকার নেশা, নামের নেশা, ক্ষমতার নেশা, কোন নেশাই মাতাল করে না মানুষকে প্রকৃতির নেশার মতো। যে এসেছে, একবার মাতাল হয়েছে; তাকে অন্য কোন নেশাই ধরে রাখতে পারেনা বাকি জীবন।” (পৃঃ ৭) ‘বুদ্ধদেব গুহ’ তাঁর প্রকৃতি প্রেমের সীমাহীন নেশাকে স্বীকার করেছেন। সে নেশার প্রতিচ্ছবি প্রকাশে প্রায় সকল রচনাতে প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা, বন-জঙ্গল ভ্রমণ, জঙ্গলের জীবন, পশুপাখি, পাহাড়-নদী-বহুবর্ণিল মাছ মুখ্য হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির মনোহর রূপ বর্ণনার সঙ্গে উপন্যাসে সংযুক্ত করেছেন মানব-মানবীর মনস্তাত্তি¡ক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও প্রেমের বিভিন্ন রূপ। প্রকৃতি ও জঙ্গলের বর্ণনার সঙ্গে যেন পারস্পরিক সম্পর্কের বৈচিত্র্য, জীবনবোধ ও সমাজ মনস্ককতা অর্থাৎ সমাজের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নি¤œবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মনস্তাত্তি¡ক মিল-অমিল, ভাব-ভনিতা, মুখ ও মুখোশের আচ্ছাদন, অন্তঃসারশূন্যতা ও অসঙ্গতি, কৃত্তিম সাহেবিয়ানা, সম্পর্কের ফাটল ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সহাবস্থান ঘটেছে।
‘হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৬ সালে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ‘হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসটি নারী-পুরুষের মনস্তাত্তি¡ক সমীক্ষণ সংযোজিত প্রেমের উপন্যাস। এ উপন্যাসের প্রেমিক হৃদয়ের শূন্যতা ও শুদ্ধতা যেন বুদ্ধদেব গুহর অন্য রচনাতেও লক্ষণীয়। তাঁর উপন্যাসের নায়ক নায়িকার মধ্যে পত্রমিতালির মাধ্যমে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। ‘হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসের নায়ক ঋজু গল্প লেখক। প্রকাশিত গল্পের কাহিনীর মাধ্যমে বন্ধুর ছোট বোন নয়নাকে ভিখিরির মতো প্রেম নিবেদন করেছে। নয়নার নিষ্ক্রিয়তায় বারবার বেদনার্ত হয়ে নব প্রত্যাশায় কলম ধরেছে ঋজু। ‘সবিনয় নিবেদন’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম রচনা। একটি পূর্ণাঙ্গ পত্রোপন্যাস। নায়ক রাজর্ষি বসু ও নায়িকা ঋতি রায়ের পত্রের মাধ্যমে তাদের মনস্তত্ত¡, জীবন জটিলতা, বন-জঙ্গল পাহাড়ের প্রাকৃতিক বর্ণনা উঠে এসেছে। এই উপন্যাসের নায়ক বিবাহিত এবং নায়িকা অন্যের বাগদত্তা। নিঃশঙ্ক নিষ্কলঙ্ক প্রেম নয় নিষিদ্ধ পরকীয়া প্রেমের বৈপরীত্য সূচক সম্পর্কের জটিলতা ‘বুদ্ধদেব গুহ’র রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। ‘মহুলসুখার চিঠি’ নামক উপন্যাসেও নায়ক মহুলসুখা থেকে কলকাতা নিবাসী পরস্ত্রী ‘পদ্মার’ কাছে নিয়মিত চিঠি লিখেছেন। ‘অবরোহী’ উপন্যাসের নায়ক নায়িকারও বন্ধুত্ব ও মনোবৃত্তি প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে চিঠি। এই উপন্যাসে লেখকের জীবনাভিজ্ঞতার ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে সীমাহীন আক্ষেপ ধ্বনিত হয়েছে নায়ক অর্যমার চিঠিতে। লেখকদের সমাজের একে অন্যের প্রতি তীব্র ঈর্ষা, প্রবল ক্ষোভ, পারস্পরিক নিন্দা ও মৎসর্য দেখে বিক্ষিপ্ত মনে যেন লেখক কলম ধরেছিলেন। ব্যক্ত করেছেন অসংখ্য অব্যক্ত কথা। এ উপন্যাসের নায়ক শিক্ষক অর্যমা ও নায়িকা ছাত্রী যোজন গন্ধার পত্রালাপের বিষয় নিছক প্রেমালাপ নয়। ‘অবরোহী’ উপন্যাসে নায়ক-নায়িকার পত্রালাপে প্রেমালাপের পাশাপাশি লেখক প্রকাশ করেছেন সাহিত্যের আদর্শ, সমকাল ও ভাবীকালের সাহিত্যের স্বরূপ, লেখকের আদর্শ ও জীবনযাপন এবং ঈশ্বরবোধ চেতনা। ‘শালডুংরি’ ও ‘গামাহারডুংরী’ নামক উপন্যাস লেখকের অরণ্য প্রিয়তা ও নৈসর্গ প্রেমের অন্যতম উপখ্যান। পাহাড়-জঙ্গলের, টিলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অজানা তথ্য উপাত্ত সংযোগে উপন্যাসের অবয়বকে তিনি গড়ে তুলেছেন। শিকার প্রেমী ‘বুদ্ধদেব গুহ’র শিকারের বর্ণনা শালডুংরি উপন্যাসে এবং সবুজায়ণ-বৃক্ষায়ণচেতনা তথা টিলার মাথায় ছায়াদানকারী প্রাচীন গামাহার গাছ কেন্দ্রিক গামহারডুংরী উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। নৈঃস্বর্গিক প্রেম, পশু পাখির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার ভাবব্যঞ্জনা পরিস্ফুট হয়েছে ‘সমুদ্র মেঘলা’ ও ‘বাজা তোরা রাজা যায়’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসদ্বয়ে লেখক যেন প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। ‘বাজা তোরা রাজা যায়’ উপন্যাসে বনের পশুদের চরিত্রায়ণ দান করেছেন। পশুদের জীবনকাহিনী হয়েছে এ উপন্যাসে মুখ্য বিষয়। ‘সমুদ্র মেঘলা’ উপন্যাসে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে ‘দ্য হার্ণেট্স নেস্ট’ নামক একটি ছোট্ট দ্বীপে বসবাসকারী প্রকৃতি প্রেমিক আহুক বোসের প্রত্যাহিক জীবনচিত্র চিত্রিত হয়েছে। এ উপন্যাসে আহুক বোসের সঙ্গে সমুদ্রের গভীরে বসবাসরত টুনা মাছের কথোপকথনের বিষয়টি চমক সৃষ্টি করেছে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি নিবিড়তম সংযোগ ও পারস্পরিক দূরত্বের স্বরূপ এই উপন্যাসে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বিতর্কিত হলেও ‘মাধুকরী’- ‘বুদ্ধদেব গুহ’র বেস্টসেলার উপন্যাস। অনবদ্য এই উপন্যাসের বিশেষত্ব সাগর, বন-জঙ্গল, অরণ্যসহ বিভিন্ন নয়নাভিরাম স্থানের প্রকৃতির বর্ণনা। অসংখ্য গুণী কবি, লেখক ও তাঁদের সাহিত্য নিয়ে এ উপন্যাসে লেখক আলোচনা করছেন। প্রকৃতি ও জীবন বর্ণনার অন্তঃস্থলে সংযোজিত হয়েছে যাপিত জীবনে টানাপোড়েন। নায়ক পৃথু ঘোষ ও রূষার মনস্তাত্তি¡ক দূরত্ব। পৃথু ঘোষের ডাকাতের সঙ্গে সংঘর্ষে একটি অঙ্গহানির পরেই তার উপলব্ধির সত্যতা পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। প্রতিমুহূর্তে মাধুকরী মতো নানা বিষয়ে অপরের থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে জীবনের পূর্ণতা আসে। এককভাবে মানুষ পূর্ণাঙ্গ নয়। ‘মাধুকরী’ উপন্যাসের জনপ্রিয়তার অনুরূপ কিশোর উপন্যাস ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’ এর জনপ্রিয়তা রয়েছে।
এই উপন্যাসের অভিযাত্রিক গোয়েন্দা চরিত্র ঋজুদা ও তার সহযোগী রূদ্র বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য জনপ্রিয় চরিত্র। ‘মাধুকরী’ উপন্যাসের জীবনবোধ ও বাস্তবতার আলো ‘বিন্যাস’ উপন্যাসেও পরিলক্ষিত হয়। শুধু কথাসাহিত্যই নয় বুদ্ধদেব গুহ ছড়া ও কবিতাও রচনা করেছেন। এর মধ্যে ‘লাল মিঞার শায়েরী’ অন্যতম। মহৎপ্রাণ মানুষেরা তাঁদের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে অনাগতকালেও অমর, অজর, অক্ষয় রূপে বিরাজমান থাকেন। একথা স্বীকার্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কথাসাহিত্যের ভুবনে প্রকৃতি প্রেমিক, জীবনবাদী, সূক্ষমনস্তাত্তি¡ক জাল বুননকারী লেখক ‘বুদ্ধদেব গুহ’র নামটি অনাগতকালেও সমুজ্জ্বল থাকবে।